সোমবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৪ || ৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিটিভি ৬০ বছরে

টিকে থাকুক টেলিভিশন, আর টেলিভিশনে টিকে থাকুক শিল্প, নন্দন ও সত্য

ড. ইসলাম শফিক

২২:৪৫, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩

আপডেট: ১২:০৬, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩

১৫১৭

বিটিভি ৬০ বছরে

টিকে থাকুক টেলিভিশন, আর টেলিভিশনে টিকে থাকুক শিল্প, নন্দন ও সত্য

এক.
‘ইডিয়েট বক্স’ বা ‘বোকা বাক্স’। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার। বলছি টেলিভিশনের কথা। যা পুরো বিশ্বসমাজকে বদলে দিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে ছোট্ট একটা ইলেকট্রনিক বাক্সের মধ্যেই ঢুকে পড়েছিল মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা, প্রকৃতি, পাহাড়, সাতসমুদ্র তেরো নদী অর্থাৎ তাবৎ দুনিয়া। এগুলো আবার স্থিরচিত্র নয়; এসব নড়াচড়া করছে! চলছে, কথা বলছে! এই প্রযুক্তিগত উপস্থাপনা মানুষের মাঝে বিস্ময় তৈরি করেছিল! কেউ কেউ দূরদর্শন বাক্সকে মনে করতেন ‘যাদুর বাক্স’। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যে সময়টায় মানুষ অবাক বিস্ময়ে টেলিভিশন দেখতো! প্রযুক্তির মাধ্যমে টেলিভিশন এক মুহূর্তে সারাবিশ্বকে গৃহে উপস্থিত করে। সাধারণ জিজ্ঞাসা- এই বিস্ময় যন্ত্র বাংলাদেশে কবে চালু হয়েছিল? ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়- পশ্চিম পাকিস্তান সবসময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছিলো। সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক ক্রমশ প্রতিবাদী হতে থাকে। ১৯৬২ সাল থেকে আইয়ুব বিরোধী একটি ছাত্র আন্দোলন প্রকাশ্যে গড়ে উঠতে শুরু করে পূর্ব বাংলায়। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরকার নতুন পথে হাঁটা শুরু করে। সামরিক সরকারকে একটি অসামরিক রূপ দেবার ফন্দি আঁটে। এজন্য জনসাধারণের কাছে তদানীন্তন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচারণা শুরু করে। হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় সময়ের সবচেয়ে আধুনিক গণযোগাযোগ মাধ্যম টেলিভিশনকে। সাধারণ নির্বাচনের আগেই ঢাকা এবং লাহোরে একটি করে টিভি স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সামরিক সরকার। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ১০ পৌষ ১৩৭১ বঙ্গাব্দ সন্ধ্যায় ডিআইটি ভবনে ‘ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে’র পরীক্ষামূলক সম্প্রচারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান, গভর্নর মোনেম খান, এনইসি’র প্রেসিডেন্ট ওয়াতানাবে এবং কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিব আলতাফ গওহর। সেদিন টিভিতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবং এনইসি কোম্পানির প্রেসিডেন্টের বক্তব্য সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।  স্টেশন ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন জামিল চৌধুরী। ৯০ দিনের পরীক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার সম্পন্ন হয় ১৯৬৫ সালের ২৫ মার্চে। সেদিন  স্টেশন পরিচিতি প্রতীক ‘পাইলট টেলিভিশন ঢাকা’ পরিবর্তন করে ‘পাকিস্তান টেলিভিশন সার্ভিস, ঢাকা’ নামকরণ করা হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে আবার সম্প্রচার শুরু হয় টেলিভিশনের। টিভিপর্দায় প্রথম যে ছবিটি ভেসে উঠেছিল তা ছিল ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগোর নকশা করেন টেলিভিশনের তৎকালীন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক ও বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর সাদা-কালো সম্প্রচার কার্যক্রম অব্যহত থাকার পর ১৯৮০ সালের ০১ ডিসেম্বর থেকে ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। এই সম্পচার কার্যক্রম টেরিস্ট্রিয়াল। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নেটওয়ার্ক ও কারিগরী সহযোগিতা নিয়ে সম্প্রচারিত হচ্ছে- বিটিভি চট্টগ্রাম, বিটিভি ওয়ার্ল্ড ও সংসদ বাংলাদেশ।

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে আবার সম্প্রচার শুরু হয় টেলিভিশনের। টিভিপর্দায় প্রথম যে ছবিটি ভেসে উঠেছিল তা ছিল ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’। বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোগোর নকশা করেন টেলিভিশনের তৎকালীন অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক ও বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ১৬ বছর সাদা-কালো সম্প্রচার কার্যক্রম অব্যহত থাকার পর ১৯৮০ সালের ০১ ডিসেম্বর থেকে ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। এই সম্পচার কার্যক্রম টেরিস্ট্রিয়াল। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে ডিশ এন্টেনা অনুমোদন দেয় হয়। অতি দ্রুত বাংলাদেশে শহর, উপশহর এমনকি গ্রামাঞ্চলেও স্যাটেলাইট সংযোগ ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশ্বব্যাপি উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির সাথে টিকে থাকার লড়াইয়ে বাংলাদেশেও অনুমোদন দেয়া হয় বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলের। ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই ভারতের এটিএন নামের একটি স্যাটেলাইট চ্যানেল নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য ভাড়া করে বাংলাদেশী অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে মাল্টি মিডিয়া প্রোডাকশন লিমিটেড। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অনুষ্ঠানের সময় বাড়তে বাড়তে তা রূপ নেয় ‘এটিএন বাংলা’ নামের আজকের স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে। ‘চ্যানেল আই’ সম্প্রচার শুরু করে ১৯৯৯ সালের ০১ অক্টোবর। ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে ‘একুশে টেলিভিশন’। ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেল লিমিটেড নামের কোম্পানির নতুন মালিকানায় ২০০৩ সালের ৩ জুলাই সম্প্রচার শুরু হয় ‘এনটিভি’র। বিএনপি-জামায়াত জোট নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৫ ও ২০০৬ সালে ১০টি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স প্রদান করে- বৈশাখী টিভি, আরটিভি, বাংলাভিশন, ইসলামিক টিভি, দেশ টিভি, দিগন্ত টিভি, সিএসবি, চ্যানেল ওয়ান, এসএ টিভি ও যমুনা টিভি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ১০টি চ্যানেলের অনুমতি দেয়-এটিএন নিউজ, মোহনা টেলিভিশন, সময় টেলিভিশন, মাছরাঙ্গা টেলিভিশন, চ্যানেল নাইন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি, একাত্তর টিভি, গাজী টিভি, এসএ টিভি, মাই টিভি ও বিজয় টিভি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে সম্প্রচারের জন্য তরঙ্গ বরাদ্দ পায় আরো ১০টি চ্যানেল- ডিবিসি, আনন্দ টিভি, নাগরিক, দুরন্ত, বাংলা টিভি, যমুনা টিভি, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, গান বাংলা, দীপ্ত টিভি ও নিউজ টোয়েন্টিফোর। সবশেষ তথ্য মোতাবেক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ৪টি এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার এ পর্যন্ত ৪৫টির। বেসরকারি এই ৪৫টি টেলিভিশন চ্যানেলের মধ্যে বর্তমানে ৩৫টি চ্যানেল সম্প্রচারে আছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চ্যানেলগুলো হলো- বিটিভি, বিটিভি চট্টগ্রাম, বিটিভি ওয়ার্ল্ড ও সংসদ বাংলাদেশ। সম্প্রচাররত টিভি চ্যানেলের মধ্যে ৮টি সংবাদভিত্তিক বিশেষায়িত চ্যানেল- এটিএন নিউজ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, সময় টিভি, চ্যানেল টুয়েন্টিফোর, একাত্তর টিভি, যমুনা টিভি, নিউজ টুয়েন্টি ফোর, ডিবিসি। আরও ৫টি বিশেষায়িত চ্যানেল রয়েছে- শিশুদের জন্য ‘দুরন্ত টিভি’, সঙ্গীতভিত্তিক ‘গানবাংলা’, খেলাধুলা নির্ভর ‘টি-স্পোর্টস’, নন-ফিকশন ভিত্তিক প্রথম টিভি ‘নেক্সাস টেলিভিশন’, ব্যবসা-বাণজ্যি নির্ভর ‘এখন টিভি’। সর্বশেষ সম্প্রচারে এসেছে ‘গ্রিন টেলিভিশন’। বাকী ২০টি চ্যানেল সংবাদ ও বিনোদনের মিশ্র চ্যানেল। 

আশির দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে টেলিভিশন সেট ক্রয় ও ব্যবহারের জন্য বিধি-বিধান কার্যকর ছিল। বাড়িতে টেলিভিশন সেট রাখার জন্য ‘জাতীয় সম্প্রচার কর্তৃপক্ষ’ থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়ে টিভি সেটের লাইসেন্স করতে হতো। এখনই হয়তো রূপকথার মতো শুনাবে যে, দর্শকদের টেলিভিশন দেখার জন্য লাইসেন্স করতে হতো এবং বাৎসরিক ফি দিতে হতো, লাইসেন্স হালনাগাদ রাখার জন্য প্রতিবছর নবায়ন ফি দিতে হতো।  ১৯৬৪ সালে ‘ঢাকা টেলিভিশন’ সম্প্রচার শুরু করেছিল ৫০০টি ২০ ইঞ্চি সাদা-কালো টিভি সেট আর ৩০০ ওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটার দিয়ে। তাতে করে ঢাকার ও পার্শ্ববর্তী ১০ মাইল ব্যাসার্ধভূক্ত এলাকা টেলিভিশনের প্রচারের আওতায় ছিল। বর্তমানে সারাদেশের প্রতিটি প্রান্তসীমাই টেলিভিশন নেটওয়ার্কের আওতাধীনে আনা হয়েছে। দেশে অভূতপূর্ব অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। যার ফলে শহর, উপশহর এমনকি সাধারণ গ্রামাঞ্চলকেও বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়েছে। সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে যাবার ফলে টেলিভিশন দ্রুতগতিতে প্রসার লাভ করে। মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে পড়েছে টেলিভিশন। বাড়ির বৈঠকখানায় টিভি থাকা চাই! চাই! এক সময় বিত্তশালীদের ঘরে এই যন্ত্রটি শোভা পেত। এখন আর সে অবস্থা নেই। এখন টিভি সেট ঘরে ঘরে। সময় প্রবাহে টেলিভিশন বৈঠনখানা ছেড়ে শয়নকক্ষে জায়গা করে নিয়েছে। একদা টেলিভিশনের সুরক্ষার জন্য আলাদা করে কারুকার্যমণ্ডিত কাঠের বাক্স বানিয়ে তালা দিয়ে রাখা হতো। সেই সুরক্ষা বাক্স এখন আর দেখা যায় না। এখন টিভি বাক্স ও টেবিল ছেড়ে জায়গা করে নিয়েছে দেয়ালে। কোনো কোনো বাড়িতে রয়েছে একাধিক টিভি। আবার প্রতি কক্ষে টিভি রয়েছে এমন বাড়ির অভাবও নেই। বেড়েছে দর্শক। বিশেষজ্ঞদের ধারণা বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি আর টেলিভিশন দর্শক সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ টিভি দেখেন। সময় ও প্রয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এই দর্শক সংখ্যা। দর্শক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে টিভির আকৃতি ও প্রকৃতি। হরেক রকম ব্র্যান্ড আর হরেক রকম কোম্পানি। এলসিডি, এলইডি, এনড্রয়েড, স্মার্ট টিভি, ফোরকে টিভি, স্ক্রিনলেস টিভি ইত্যাদি। সংযুক্ত হয়েছে নানা প্রযুক্তির সুবিধা। রিমোট কট্রোল, টাচ্ স্ক্রিন কন্ট্রোল, ইউএসবি পোর্ট, ব্লু টুথ, ওয়াইফাই, ডাটা স্টোরেজ, মেমোরি, রেকর্ডিং প্রভৃতি নানাধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা যুক্ত হয়েছে টিভি সেটে। টেলিভিশন এক সময় ছিল সাদা-কালো। এরপর ১৯৮০ সালে এলো রঙিন টিভি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে টেলিভিশনের আকৃতি ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন হতে হতে বড় বাক্স থেকে এখন চলে এসেছে একেবারে হাতের মুঠোয়। মানুষ এখন টিভি দেখছে স্মার্টফোনে, ট্যাবে বা অনলাইনে। নির্দিষ্ট স্থানে বসে থেকে টিভি দেখার বাধ্যবাধকতা এখর আর নেই। যখন ইচ্ছে তখন, সেখানে খুশি সেখানে অবস্থান করেই টেলিভিশন দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছে প্রথাগত পদ্ধতির টিভি মাধ্যমে। টেলিভিশন নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ে নিয়ত যুদ্ধ করছে।

 
দুই.
দর্শকের হাতে রয়েছে রিমোট। টেলিভিশন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রিমোট যন্ত্রের সাহায্যে। দর্শকের সামনে টিভি সেট একটি কিন্তু অপশন বহু। দেশি বিদেশি মিলে প্রায় দুই শতাধিক টিভি চ্যানেল আর রঙ বেরঙের অনুষ্ঠান। কোন কিছুতে একটু মন না বসলেই রিমোটের বোতামে চাপ! ব্যস্! পাল্টে গেল টিভি দৃশ্য। নতুন বিষয়, নতুন জগত! রিমোটের বোতামে এতো টিভি আর এতো অনুষ্ঠান যা একজন দর্শকের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। দর্শক কোন টিভি বা অনুষ্ঠান দেখবেন অথবা দেখবেন না সেটা তিনি তার নিজের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচন করেন। ইচ্ছে মতো চ্যানেল পরিবর্তন করেন। অনেক দর্শক আছেন যে তিনি কী দেখবেন তা তিনি নিজেও জানেন না! পরিভ্রমণ করতে থাকেন এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে। ১৯৯৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে টিভি চ্যানেল মানেই ‘বিটিভি’। এটিই ছিল আমাদের টিভি দর্শকদের একমাত্র তথ্য ও বিনোদনের ভরসা। দর্শক প্রতিদিন অপেক্ষার প্রহর গুণতেন কখন টিভির অধিবেশন শুরু হবে তার জন্য। কখন ঘড়িতে তিনটা বাঝবে। তিনটা বাজার আগেই টিভি খুলে বসে থাকতো অতি আগ্রহীরা। ঝির ঝির করতো বা কালার বার থাকতো তবুও অবাক বিস্ময় নিয়ে সেটাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন। টিভিতে কী দেখাচ্ছে সেটা গুতুত্বপূর্ণ নয়, টিভি দেখতে পারাটাই ছিল আনন্দের। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিটিভি সফলভাবে সকল শ্রেণির দর্শকদের বিনোদন চাহিদা পূরণ করেছে। শিল্পসাহিত্য, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রিয়েলিটি শো, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, একক নাটক, ধারাবাহিক নাটক, সিনেমা, ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়াল, বিদেশি চলচ্চিত্র, কার্টুন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, ছায়াছন্দ, প্রামাণ্যচিত্র প্রভৃতি মানসম্পন্ন অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা ছিল একটির সঙ্গে অন্যটির। গত দু’দশক ধরে বিটিভিতে মানহীন অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েই চলছে ক্রমশ। সাধারণ মানুষ অনেক আগেই বিটিভির প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিটিভি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অধিকাংশ দর্শক। বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেল সম্প্রচার অনুমোদন ছিল অপার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। একুশে টেলিভিশন নানামাত্রিক অনুষ্ঠান দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল এবং মুগ্ধ করেছিল সকল শ্রেণির দর্শককে। এক যুগ ব্যবধানে বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা দাঁড়াল দুই ডজনে। শুরুতে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখে দর্শক অনেক বেশি আশাবাদী হয়েছিল। ভরসা ছিল স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোর সবসময় নতুনের কথা বলবে, সবসময় ভালো মানের অনুষ্ঠান প্রচার করবে। সকলের আকাঙ্খা ছিল বেসরকারি প্রতিটি টিভি চ্যানেল তাদের নিজ নিজ শ্লোগানে প্রদত্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবে। সকল ভালোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। চব্বিশ ঘণ্টা সম্প্রচারের একটি টিভিতে সাধারণত প্রতিদিন মোট আট থেকে দশ ঘণ্টার নতুন অনুষ্ঠানের যোগান দিতে হয়। এই দশ ঘণ্টার জন্য প্রতিদিন নতুন বিশটি অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। বাজেট ও কারিগরী বিবেচনায় প্রতিদিন  মানসম্মত বিশটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করা চাট্টিখানি কথা নয়!  তাই টিভিকে বলা হয় ক্ষুধার্ত মাধ্যম। অনেকে টেলিভিশনকে তলাবিহীন সমুদ্রের সাথে তুলনা করে থাকেন। একাডেমিকভাবে বলা হয় ‘ইরেজ মিডিয়া’।  বর্তমান প্রেক্ষিতে এমন ক্ষুধার্ত মাধ্যমের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন এতোগুলো মানসম্মত অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে দর্শকদের চাহিদা বা পছন্দের কথা বিবেচনায় না এনে নিম্নমানের অনুষ্ঠান ও জোড়াতালির পুনঃপ্রচার দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানসূচি। বাংলাদেশের অতি সম্ভাবনাময় স্বপ্নের বেসরকারি টিভিশিল্প আজ রুগ্ন শিল্পমাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এই অধঃমূখীতার কারণগুলো হলোজ্জ মানহীন অনুষ্ঠান সম্প্রচার, পুনঃপ্রচারের আধিক্য, স্বল্পবাজেটের রুচিহীন নাটকের আধিপত্য, বিবর্ণ পুরোনো বাংলা সিনেমা দিয়ে পর্দা দখল, মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন, অতিমাত্রায় টকশো নির্ভরতা, যাচ্ছেতাই লাইভ শো প্রভৃতি। এই অবস্থা কিন্তু হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। দিনের পর দিন বেশিরভাগ মানহীন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ফলে দর্শক টিভির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরাও হাঁটছেন ভিন্নপথে। টিভিপর্দাকে আর অনুষ্ঠান নির্ভরতায় রাখা হচ্ছে না। টিভি চ্যানেলগুলোর মূল আধেয় এখন খবর। বিনোদন নির্ভরতা পরিহার করে বাংলাদেশের অধিকাংশ টিভি চ্যানেল এখন টকশো ও সংবাদপ্রধান হয়ে উঠেছে। বলা চলে খবরের পাশাপাশি কতিপয় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু দর্শকের হাতে রয়েছে রিমোট। তারা আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান দেখার জন্য রিমোটের বোতাম টিপছেন। মুহূর্তেই চলে যাচ্ছেন ভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলে। আগে এই প্রবণতা শহুরে দর্শকদের মধ্যে পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু ক্যাবল নেটওয়ার্কের বিস্তৃতির ফলে গ্রামের মানুষও এখন ব্যাপকভাবে বিদেশি চ্যানেল দেখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। বিদেশি চ্যানেলের ব্যয়বহুল ও তারকা খচিত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অংশগ্রহণে নির্মিত সিরিয়াল, গেমশো, রিয়েলিটি শো প্রভৃতি অনুষ্ঠানে আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছেন আমাদের দর্শকেরা। এসব অনুষ্ঠানের গবেষণা, বাজেট, সেট, লাইট, কনটেন্ট, শিল্পীদের পারফরমেন্স, প্রেজেন্টেশন এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের টিভি চ্যানেলে মানসম্মত অনুষ্ঠান নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কতিপয় টিভিতে কিছু বিদেশি অনুষ্ঠানের সস্তা অনুকরণ করার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু দর্শকপ্রিয়তা পায়নি। টেলিভিশনে শিল্পসম্মত ও সৃজনশীল অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হলো ধারাবাহিক নাটক, একক নাটক ও টেলিফিল্ম। বাংলাদেশের টিভি নাটকের রয়েছে সোনালি অতীত। নাটকের সংলাপও মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। নব্বইয়ের দশকে টিভি নাটকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। শুরু হয় প্যাকেজ নাটক নির্মাণ কাল। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত নাটক সরকারি টেলিভিশনে প্রচার শুরু হয় ১৯৯১ সালে। যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলো উদ্যোক্তা কিংবা বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে। দ্বিতীয় ধাপে জাগরণ ঘটল বেসরকারি টেলিভিশনে। ধীরে ধীরে বেড়েছে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়েছে নাটকের সংখ্যা। এসব টিভি চ্যানেলের জন্য বহু ভালো ভালো নাটক নির্মিত হয়েছে। তৈরি হয়েছে বহু গুণী নাট্যকার, নির্মাতা, কলাকুশলী। সময়ের বিবর্তনে এখন মন্দ নাটকের সংখ্যাই বেশি! টেলিভিশনের ছোট্ট বাক্সে সিনেমা দেখেও দর্শক মুগ্ধ হয়েছে। সপ্তাহে একদিন বাংলা ছায়াছবি প্রচারিত হতো। টিভির সামনে উপচে পড়া ভীড়। ঘরে স্থান সংকুলান না হলে টিভির জায়গা হতো উঠানে। খোলা আকাশের নিচে পাটি-মাদুর বিছিয়ে সকলে মিলে টিভিতে সিনেমা দেখতো। ব্যাটারি ভাড়া করে আনা হতো।  সিনেমা দেখার জ্য ভাড়া কওে আনা হতো টিভি সেটও। এখন টিভি চ্যানেলগুলো পর্দা ভরার জন্য সিনেমাকে ব্যবহার করছে। প্রতিদিন একটি করে সস্তা মূল্যের সিনেমা পর্দায় টানিয়ে দেয়া হয়। পুরনো বাংলা সিনেমার খুব বাজে মানের প্রিন্ট থেকে ট্রান্সফার করে টিভি পর্দায় উপস্থিত করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি চ্যানেলে একই অবস্থা। প্রতিদিন দুই ঘণ্টার সিনেমার সঙ্গী আরও এক ঘণ্টার বিজ্ঞাপন। মোট তিন ঘণ্টার চাঙ্ক পারি দিচ্ছে সিনেমা দিয়ে। এই একই সিনেমা আবার রাতে পুনঃপ্রচার করা হচ্ছে। অর্থাৎ টিভি পর্দার সিংহভাগ সময় জুড়ে বাংলা সিনেমা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। টিভিতে প্রচারের উপযোগী সিনেমার সংখ্যাও খুব বেশি নেই। ঘুরে ফিরে সিন্ডিকেটবদ্ধ কিছু সিনেমা চক্রাকারে বিভিন্ন টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে। একজন টিভি দর্শক ঐ একই সিনেমা দু’চার দিন পরপর ভিন্ন ভিন্ন টিভিতে দেখতে দেখতে এখন মহাবিরক্ত। এমনকী গ্রামগঞ্জে চায়ের দোকানে ভীড় করে যারা বাংলা সিনেমা দেখতেন তারাও এখন টিভির সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। একসময় বাংলাদেশে টিভিপর্দায় বাংলা ছায়াছবি যেমন ছিল উচ্ছ্বাসের বিষয়, তেমনি অতিরিক্ত প্রচারের কারণে সিনেমাও এখন অবহেলার মাধ্যম হযে দাঁড়িয়েছে। সিনেমা টিভি চ্যানেলকে করেছে জীর্ণশীর্ণ রুগ্ন; আর টিভি চ্যানেল সিনেমাকে পরিণত করেছে সস্তা একটি শিল্পমাধ্যমে! প্রায় প্রতিটি চ্যানেল মানসম্মত অনুষ্ঠান নির্মাণ না করে বাংলা সিনেমা দিয়ে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানসূচি ভরাট করছে। দেশে চ্যানেলের সংখ্যা বাড়লেও দর্শকদের বিনোদন চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ বেশিরভাগ টিভি চ্যানেল। অধিকাংশ দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলের প্রতি। ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ দুর্বল মানের অনুষ্ঠান। একই সময়ে বিদেশি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত কনটেন্টের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকতে পারছে না দেশীয় টিভি চ্যানেল। অসম প্রতিযোগিতায় দৌড়ে দর্শকহীন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ টিভি চ্যানেল। উদ্দেশ্যহীন যাত্রা ও সমন্বয়হীনতার কারণে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দর্শকদের মনে ঠাঁই করে নিতে পারছে না। টিভি চ্যানেলের ‘’কনটেন্ট সঙ্কট ও শিল্পমান রক্ষা’ এই চলমান সঙ্কট উত্তরণের উপায় নিশ্চয়ই রয়েছে। প্রত্যাশা করছি প্রতিটি চ্যানেলের কর্তৃপক্ষ, চ্যানেলের নীতিনির্ধারণী কর্তাব্যক্তি, অনুষ্ঠান নির্মাতা, টিভি চ্যানেলের প্রযোজকবৃন্দ এই চলমান সঙ্কট উত্তরণের উপযুক্ত উপায় সহসাই খুঁজে পাবেন।  

 তিন.
ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিশ্ববাসী আজ উন্মুক্ত। জালের দুনিয়ায় সকল দুয়ার খোলা যখন তখন। তথ্য ও বিনোদন জগতে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে এই ওয়েব দুনিয়া। টেকনোলজি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। সম্প্রচার প্রযুক্তিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন মাধ্যম। টেকনোলজির বিকাশে মানুষের অভ্যাসে আসছে পরিবর্তন। নতুন প্রজন্মের দর্শক টিভি সেটের সামনে থেকে সরে গিয়ে ভার্চুয়াল বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বর্তমান সময়ে একজন মানুষের কাছে ইন্টারনেটসমেত একটি স্মার্টফোন হাতে থাকা মানে হাজারো বিনোদন তার হাতের মুঠোয় চলে আসা। হাজারো বিনোদন দেখার জন্য দর্শক এখন টিভি ছেড়ে অনলাইনে বা স্মার্টফোনে সময় কাটাচ্ছে। ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগ প্রভৃতি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিডিয়া। এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘নিউ মিডিয়া’। বর্তমানে এই ‘নিউ মিডিয়া’ গ্রাস করে চলেছে প্রচলিত গণমাধ্যমকে। আলাপ হতে পারে ‘নিউ মিডিয়া’ আসলে কী? ‘নিউ মিডিয়া’ মূলত অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বোঝানো হচ্ছে। মূলধারার মিডিয়া অর্থাৎ সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন বা হালআমলের অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে অন্য যে মাধ্যমগুলো রয়েছে সেগুলোই ‘নিউ মিডিয়া’। ‘নিউ মিডিয়া’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফরমেটের দিক থেকে ডিজিটাল আর এবং ইন্টারনেট নির্ভর। যেমন- ফেইসবুক,  টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব, ব্লগ প্রভৃতি। প্রযুক্তির সুবিধা ও বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান দেখার আকর্ষণে দর্শক প্রথাগত টিভি মিডিয়া পরিহার করে ‘নিউ মিডিয়া’র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। খবর, নাটক, সিনেমা, প্রামাণ্যচিত্র, খেলাধুলা, রান্নাবান্নার অনুষ্ঠান যখন যা চাই পাওয়া যাচ্ছে ‘নিউ মিডিয়া’ শাখা-প্রশাখায়। টেলিভিশনের লিনিয়ার সম্প্রচার পদ্ধতিতে কারণে অনুষ্ঠান দেখার জন্য দিনক্ষণের যে অপেক্ষা করতে হয়। অনলাইন বিনোদন মাধ্যমে সেই বাধ্যবাধকতা এখন আর নেই, এই প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচারের সময় বলতে কিছু নেই। ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্ম’ ও  ‘নিউ মিডিয়া’  অধুনা এই শব্দগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। সংবাদ, বিনোদন, কেনাকাটা, হোটেল বুকিং, টিকেট ক্রয়, গেইমস্ খেলা, সভা, সেমিনার, ক্লাস, পরীক্ষা, যোগাযোগ, আড্ডা, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, অফিস আদালত প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই হচ্ছে অনলাইনে। কোভিট-১৯ মহামারিকালে ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ, ই-কমার্সে কেনাকাটা বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পরিবর্তিত এই অনলাইন ভিত্তিক জীবনব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভবিষ্যতে যেখান থেকে পেছিয়ে আসার আর সুযোগ থাকছে না। অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে মুক্তি পাচ্ছে চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক নাটক, মিউজিক ভিডিও, ই-বুক প্রভৃতি। প্রতিদিন হাজার হাজার ইউটিউবার আপলোড করছে নতুন নতুন কনটেন্ট। ওভার দ্য টপ বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অডিও-ভিডিওসহ নানা কনটেন্ট প্রচার বাড়ছে পৃথিবীব্যাপি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। ‘নিউ মিডিয়া’র দ্বিমুখী যোগাযোগের প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রতিদিন হচ্ছে হাজার হাজার লাইভ স্ট্রিমিং। ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন, ইউটিউব প্রভৃতি নয়া মাধ্যমের নয়া দাপটে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে আমাদের টিভি চ্যানেল।

টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন। সবকিছুই যেন বিজ্ঞাপনের দখলে। অনুষ্ঠানের টাইটেলে বিজ্ঞাপন, সেটে বিজ্ঞাপন, খবরের শিরোনামে বিজ্ঞাপন, স্ক্রলে চলছে বিজ্ঞাপন, পর্দার ডানে বামে ডঙ্গলে ঝুলে থাকে বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন বিরতিতেও বিজ্ঞাপন। অনুষ্ঠানের স্পন্সর বা মিডিয়া পার্টনার  হয়ে সেখানে বিজ্ঞাপন। খানিক বাদে বাদে আচমকা টিভি স্ক্রিণ ছোট হয়ে ইংরেজি এল বর্ণের আকৃতিতে সুপার ইম্পোজ হয়ে দেখা দেয় বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের চাপে কোথাও আর অনুষ্ঠান নেই। দর্শকেরা বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান বা সংবাদ দেখতে পান। অনুষ্ঠান যেন ইদের চাঁদ, উঁকি দিয়েই মিলিয়ে যায়। টেলিভিশন আর বিজ্ঞাপন যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অনেকে বলে থাকেন বিজ্ঞাপন টেলিভিশনের হৃৎপিণ্ড । কারণ হলো বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর আয়ের প্রধান উৎস হলো বিজ্ঞাপন। যত বেশি বিজ্ঞাপন সময় বিক্রি হবে, আয় হবে ততে বেশি। টেলিভিশনের সারাদিনের প্রচার সময় থেকে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত থাকে। প্রতিদিনের প্রচারসময় থেকে অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচারের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণের পাশাপাশি বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপন সময় নির্ধারণ করা থাকে। এই বিজ্ঞাপনী সময় বিজ্ঞাপনদাতার কাছে বিক্রয় করা হয়। নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের প্রচারণার জন্য সময় ক্রয় করেন। নোম চমস্কির ভাষায়, ‘গণমাধ্যম বিজ্ঞাপনদাতার কাছে অডিয়েন্সেকে বিক্রি করে’। বিশ্বব্যাপী এখন অনলাইন নির্ভর তথ্য ও বিনোদনের জয়জয়কার। আমাদের দেশেও বিস্ময়করভাবে বেড়েছে ‘নিউ মিডিয়া’ ব্যবহারকারী। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশন (বিটিআরসি) ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ কোটি ০৯ লক্ষে। ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ০৮ কোটি ৭৭ লক্ষ। বিশ্বের মোবাইল অপরেটরদের সংগঠন গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের (জিএসএম) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে থেকে জানা গেছে- বিশ্বে বর্তমানে একক মোবাইল সংযোগ সংখ্যা ৪৯২ কোটি। এরমধ্যে ৫০ শতাংশ সংযোগ স্মার্টফোনে। ২০২০ সালের শেষে এটি বেড়ে দাঁড়াবে ৬৬ শতাংশে। এসময়ের মধ্যে বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারী হবে ৬০ শতাংশ। ফলে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ স্মার্টফোন ব্যবহারে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ৭ নম্বরে উঠে আসবে। অতি দ্রুত প্রযুক্তি বদলের ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের পণ্যের প্রচার ও প্রচারণায় কৌশল বদলে ফেলেছেন। প্রচারণায় চালাচ্ছেন অনলাইন প্লাটফর্মে। প্রচলিত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া থেকে বিজ্ঞাপন বুকিং কমিয়ে দিয়ে অনলাইন প্লাটফর্মে বাজেট বৃদ্ধি করছেন। টিভি চ্যানেলগুলোতে বিজ্ঞাপন বুকিং কমিয়ে দেয়ার ফলে টিভি স্টেশনগুলো পড়েছে আর্থিক সঙ্কটে। একসময় টিভিতে বিজ্ঞাপনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বর্তমানে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন বিভাজিত হওয়ায় সেই একচ্ছত্র আধিপত্য দাপট আর নেই বললেই চলে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অল্পটাকায় বিজ্ঞাপন সময় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। তাতে করেও কাঙ্খিত আয় হচ্ছে না। আয় কমে যাওয়ায় টিভি কর্তৃপক্ষ ভালো মানের অনুষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করছেন না। আর্কাইভ থেকে পুনঃপ্রচার ও পুরনো বাংলা ছবি দিয়ে প্রতিদিন কোন রকম হযবরল অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করছেন। এসব অনুষ্ঠান দর্শক এখন আর দেখছেন না। তথাকথিত টিআরপি রেটিং তালিকার তলানীতে থাকা নাম আর শীর্ষে থাকা নামের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় তেমন কোনো হেরফের নেই। চ্যানেলের লোগো উঠিয়ে দিলে একটার সাথে অন্যটার পার্থক্য করা কঠিন। বিজ্ঞাপনদাতারা তাই এখন আর তথাকথিত টিআরপি মানছেন না। কৌশলে টিভি থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন বিজ্ঞাপন বাজেট। 

একটা প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি! ভিন্ন দেশের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে সীমিত সময়ের বিজ্ঞাপন প্রচার করে, আর আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলে মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়, এই পার্থক্যটি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একটু পেছনে তাকাতে হবে। বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার শুরু হয়েছিল ফ্রি টু এয়ার। অর্থাৎ এই চ্যানেলগুলো পে-চ্যানেল নয়। সম্প্রচার থেকে ক্যাবল অপারেটরদেও কাছ থেকে কোন অর্থ পায়না টিভি চ্যানেলগুলো। বরং চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সম্প্রচারের পরিধি বাড়ানোর জন্য নিজ খরচে ‘সিগন্যাল রিসিভিার বক্স’ ক্যাবল অপারেটরদেরকে সরবরাহ করে থাকেন, এমনকী এখন অবধি করছেন। ক্যাবল অপারেটর বেশ কিছু পে-চ্যানেলের সাথে আমাদের ফ্রি-চ্যানেল মিলিয়ে দর্শকের দোরগোড়ায় সংযোগ পৌঁছে দেন। প্রতিটি সংযোগের জন্য অপারেটরদের প্রতি মাসে সরকার নির্ধারিত ৩০০ টাকা করে ফি দেন ব্যবহারকারীরা। ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রতি মাসে এগার হাজার পঞ্চাশ কোটি টাকা আয় হয় এই খাত থেকে। সে হিসেবে বাংলাদেশে ক্যাবল অপারেটররা প্রতি বছরে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করেন। বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো পে-চ্যানেল না হবার ফলে দর্শকদের  থেকে যে টাকা ক্যাবল অপারেটরেরা আয় করেন তার থেকে একটি টাকাও পান না চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন নির্ভর আয় থেকেই টিভির সকল ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। দেশে সম্প্রতি ডাইরেক্ট টু হোম (ডিটিএইচ) সেবা চালু হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে গ্রাহকগণ সেটটপ বক্স ব্যবহার করে সরাসরি স্যাটেলাইট হতে সিগন্যাল রিসিভ করতে পারেন। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং যে সকল অঞ্চলে কেবল টেলিভশন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা সম্ভব নয় সে সকল অঞ্চলের জনসাধারণ টেলিভিশন সম্প্রচার উপভোগ করতে পারবেন। ডিটিএইচ এর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কারণে গ্রাহকগণ টেলিভিশনে উন্নত মানের ছবি ও শব্দ উপভোগ করে থাকেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে দেশে কতগুলো টিভি সেট ব্যবহৃত হচ্ছে তার সংখ্যা নিরুপণ করা যাবে। পরিকল্পনা ও আলোচনা চলছে খুব শিগগির সারাদেশে এনালগ ক্যাবল সেবা বাতিল করে ডিটিএইচ প্রযুক্তি চালু করা হবে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেলস ওনার্স (অ্যাটকো) দাবী তুলেছে এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সময় বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেলগুলো যা বর্তমানে ফ্রি-টু-এয়ার রয়েছে সেগুলোকে মানের ভিত্তিতে পে-চ্যানেলে রূপান্তরিত করার। ডিটিএইচ প্রযুক্তিতে দেশি চ্যানেলগুলোকে পে-চ্যানেলে রূপান্তরের দাবী কার্যকর হলে টিভি চ্যানেলগুলোতে বিরাজমান আর্থিক সঙ্কট অনেকটা কেটে যাবে। তখন টিভি চ্যানেলগুলো পর্দা অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপন নির্ভরতা থেকে রেহাই পাবে। 

বর্তমানে প্রায় ৩৪টি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে রয়েছে। একসময় আমাদের বিজ্ঞাপন বাজারও টিভি চ্যানেলের অনুকূলে ছিল। অনলাইন প্লাটফর্মের দাপটে বিজ্ঞাপনের বাজার অনেকটাই টিভি চ্যানেলের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপি কোভিট-১৯ এর মহামারীকালে বর্তমান বিশ্ব নতুন করে অনলাইনের উপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞাপনের টার্গেট এখন নতুন প্রজন্ম। বাজার বিশ্লেষণ করে জানা যায়- টিভি বিজ্ঞাপন থেকে প্রায় অর্ধেক বাজেট কমিয়ে দিয়েছেন বিজ্ঞাপনদাতারা। আর এসব বিজ্ঞাপন শিফট্ করেছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। তারা প্রযুক্তিগত যুক্তি দিয়েছেন। টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় সে তুলনায় ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের কাছ থেকে অনেক বেশি সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতের বিজ্ঞাপন বাজার  হবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। প্রথাগত টিভির প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিবর্তনের মূলে রয়েছে ইন্টারনেট বিপ্লব।

 চার.
টেলিভিশন দর্শকের সংবেদনশীলতা, সুকুমার বৃত্তি ও মানবিক মূল্যবোধ অর্জন করতে শেখায়। টেলিভিশনকে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আলোকিত সমাজ গঠন সম্ভব। মানুষের মত প্রকাশের একটি বড় প্লাটফর্ম হলো স্বাধীন গণমাধ্যম। টেলিভিশনের বড় কাজ হলো পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করা। মিডিয়া যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতি এসে হানা দেয়। স্যাটেলাইট সংস্কৃতির অপছায়ার পাশাপাশি অনলাইন প্লাটফর্মের অপসংস্কৃতি  গ্রাস করেছে আমাদের সাধারণ দর্শকদের। চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি, রীতিনীতি কোনঠাসা হয়ে পড়ছে ডিজিটাল সংস্কৃতির আগ্রাসনে। অনলাইন সংস্কৃতির আগ্রাসনে ভাষা আর সাংষ্কৃতিক আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে আমদানি হচ্ছে গুজব। গুজব সামসময়িক কালের এক ভয়ঙ্কর তথ্যসন্ত্রাস। অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার ও ভয়ঙ্কর তথ্যসন্ত্রাস প্রতিরোধে গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে একথা অনস্বীকার্য। টিভি চ্যানেল সহজলভ্য ও টেকসই গণযোগাযোগ মাধ্যম। অনুমোদিত এসব টিভি চ্যানেল সাধারণ জনগণ ও রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ। অনলাইন সংস্কৃতির আগ্রাসন ও ভয়ঙ্কর তথ্যসন্ত্রাসের বিপরীতে খুব সহজেই দেশের প্রান্তিক জনসাধারণের কাছে সঠিক তথ্য, সংবাদ ও সুস্থ বিনোদন পৌঁছে দিতে কার্যকর টুলস্ হিসেবে কাজ করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস, চেতনা ও মূল্যবোধ প্রচারে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণা, মাদকমুক্ত সমাজ, গণশিক্ষার প্রসার ঘটানো, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, শিল্পসংস্কৃতি, সাহিত্য, লোকজ ঐতিহ্য, কৃষিবিজ্ঞান, সংগীত, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সঠিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে প্রথাগত এই টিভি চ্যানেলগুলো। বাংলা ও বাঙালি চিরায়ত ঐতিহ্যকে ধারণ করে অসাম্প্রাদায়িক চেতনায় সত্য, সুন্দর ও শুদ্ধ জনরুচি বিনির্মাণে টিভি চ্যানেলকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। টেলিভিশনের হাজারো সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সমাজের নীতি নৈতিকতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে কথা বলে চলেছে প্রতিনিয়ত। আশার কথা আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এখন অনলাইনে দেখা যাচ্ছে। প্রচারিত সব অনুষ্ঠান আপলোড করা হচ্ছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে। অনলাইনে লাইভ স্ট্রিমিং করছে প্রায় সব টিভি। বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল অনলাইনে দেখার জন্য ইতোমধ্যে নিজস্ব অ্যাপ তৈরি করছেন। নয়া মাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ করে নির্মাণ করবে মানসম্মত সামসময়িক কনটেন্ট। প্রত্যাশা করা যায়- টেলিভিশন প্রচলিত ধারার বৃত্ত থেকে বাইরে এসে নয়া-দাপটে প্রতিযোগিতা করবে মুক্তবাজার। ব্র্যান্ডিং, বিজ্ঞাপন প্রচার, বিক্রয় ও বিপণনে আসবে নতুনত্ব ও সৃজনশীলতা। এসব বিষয় নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা ও ভাবনা-চিন্তা । টেলিভিশনের নিজস্ব কমিটমেন্ট, হালআমলের প্রযুক্তি ও যোগাযোগের অমিত শক্তিকে যথাযথ কাজে লাগিয়ে টেলিভিশন চ্যানেল নিজস্ব শক্তিতে ঘুরে দাঁড়াবে নতুন আঙ্গিকে, নিজস্ব ফরম্যাটে। বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচার ইতিহাসের হীরক জয়ন্তীতে টেলিভিশনের সকল দর্শক, শিল্পী, কলাকুশলী, বিজ্ঞাপনদাতা সকলকে শুভেচ্ছা ও সাধুবাদ জানাই। টেলিভিশন মাধ্যম টিকে থাকুক,আর টেলিভিশন মাধ্যমে টিকে থাকুক শিল্প, নন্দন ও সত্য।
    
ড. ইসলাম শফিক: গণমাধ্যমকর্মী ও গবেষক
[email protected]

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank