বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ‘থালা বাটি কম্বল-জেলখানার সম্বল’ লেখা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ রচনাসমূহ যে কত গভীর ও বিশাল কবিতার প্রতীক, উপমা ও কালের ক্যানভাস সমৃদ্ধ তা সহজেই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘ জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই- তারা জানে না জেল কি জিনিস। আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি।’ এমন চমৎকার ভাষায় কাব্যিক উচ্চারণে বন্দী জীবনকে চিত্রিত করার এত সহজ-সরল ভঙ্গিমা ক’জন মহান কবি ইতিহাসে উপস্থাপন করতে পেরেছেন তা সকলের অজানা।
কবি কল্পনা করেন, ভাবেন, স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের প্রতিরূপ ‘কবিতা’। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি নিয়ে, সেই স্বপ্ন ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার। কবিদের মতোই বঙ্গবন্ধু রূপ দিয়েছেন তাঁর স্বপ্নের। লিখলেন পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে এই জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার স্বপ্নের সে প্রতিরূপ, সে কবিতা। বঙ্গবন্ধুর সে কবিতাই হয়ে উঠলো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। রাজনীতির এই কবিকে নিয়ে নানা দেশ এবং বিদেশের নানা লেখক, কবি লিখলেন গল্প, গান, কবিতা, নাটক। নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রনায়ক ও রূপকারকে নিয়ে এত অধিক সংখ্যক কবিতা লেখা হয়েছে। অগ্রজ কবিদের লেখনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমকালীন কবিরা যেমন লিখছেন, আগামী দিনের কবিরাও তেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের কবিতায় চিত্রিত করবেন নানাভাবে নানারঙে। যতকাল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থাকবে, ততকাল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হবে কোনো না কোনো কবিতা, গল্প, উপন্যাস।
বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে একাত্তরের মার্চ মাসের শুরুতেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আমাদের অনিবার্য। তাই তিনি একাত্তরের ৭ মার্চ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এ ভাষণে বাঙালির প্রতি পাকিস্তানিদের হত্যা-নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র মূর্ত হয়ে উঠে। শত্রæর মোকাবিলায় তিনি বাঙালি জাতিকে নির্দেশ দেন, 'তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।' জাতির পিতার এই সম্মোহনী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
৭ মার্চের মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন, যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। দীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করলেন, 'রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।' এ ঐতিহাসিক ভাষণই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যৎ ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত প্রতীকী স্টাইলে ভাষণটি দিয়েছিলেন। একদিকে মুক্তিকামী মানুষকে দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন, অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের কূটনীতিবিদ। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সবকিছুকে প্রকাশ করেছেন একজন কূটনীতিবিদের মতো। তিনি বলেছেন, বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি ভাষা আন্দোলন, '৫৪-এর নির্বাচন, '৫৮-এর সামরিক শাসন, '৬৬-এর ছয় দফা, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন, অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন এবং একটি সাজানো গোছানো অলিখিত ভাষণ দিয়েছেন।
অনেকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন। কখনও তাঁরা বিচার করেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন দেশের অভ্যন্তর থেকে বিদেশি হানাদার-শত্রæ বিতাড়নের একটি যুদ্ধ। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের ৯ মাস সময় লেগেছিল ওই শত্রæদের বিতাড়ন করতে। আমরা ওদের বিতাড়ন করতে সক্ষম হই বলেই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস।
২৬ মার্চ বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, ওই ঘোষণাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তি ভূমি, অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ঘোষণাপত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানের মাতৃকোষ ঘোষিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এই ঘোষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচিত হয়। তাই ১৯৭১ সালে ৯ মাস বাংলাদেশে যে যুদ্ধ হয় তা ছিল নিজ স্বাধীন দেশকে হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত করার যুদ্ধ। ১৯৭০ এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আসা একটি স্বাধীন দেশের জন্য সব মানুষ এই যুদ্ধ করে। স্বাধীন বাংলাদেশ নামক যে দেশটি ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে জন্ম নিল, এই দেশ বা রাষ্ট্রটি যে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বা বাংলাদেশের সংবিধানের মাতৃজনন কোষে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত।
বাংলাদেশের ওপর গণহত্যা শুরু ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার পরেই বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা হিসেবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। হানাদারদের বিরুদ্ধে সবাইকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন। সেটাকেই স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সব জনপ্রতিনিধি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বৈধ ঘোষণা হিসেবে মেনে নেন। আর বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীন দেশের জন্য সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুকে ওই সরকারের প্রধান অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। বৈধ সরকার তখন দেশের ওপর ওই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সব আইন প্রণয়ন ও রাজস্ব-সংক্রান্ত সব অধিকার পায়। অর্থাৎ ২৬ মার্চ যে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষিত হয় ওই রাষ্ট্রটি ১০ এপ্রিল থেকে তাদের সংবিধান ও বৈধ সরকার নিয়ে যাত্রা শুরু করে। রাষ্ট্রটির জন্য তখন পথ চলতে দু’টি মাত্র বাধা থাকে। প্রথম হলো রাষ্ট্রটির অভ্যন্তরে বেশ কিছু স্থান তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল করে রেখেছিলো এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রটির জন্য অন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য দু’টি বিষয় জরুরি ছিল। প্রথমত যারা এই রাষ্ট্র গঠন করেছে তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নয় এবং দ্বিতীয়ত রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে কি না? কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অন্য একটি গণতান্ত্রিক নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে গেলে প্রথমেই দেখতে হয় যারা নতুন রাষ্ট্র গঠন করেছেন বলে দাবি করছেন, তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কি না? যদি তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রমাণিত না হয় তাহলে স্বীকৃতি পাওয়ার বেশির ভাগ শর্ত তারা পূরণ করেন।
বাংলাদেশের এই পাকিস্তানি হানাদার বিতাড়নের যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু যদি পালিয়ে যেতেন বা আন্ডার গ্রাউন্ডে গিয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মতো যুদ্ধ পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ পেত। কিন্তু তাঁর দেশ আক্রান্ত হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে বসেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর জনগণকে আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানান এবং বিশ্ববাসীর কাছে ওই নতুন রাষ্ট্রের জন্য স্বীকৃতি চান।
এই ঘোষণা ও স্বীকৃতি চাওয়ার কাজটি ছিল প্রকাশ্যে এবং নির্বাচিত নেতা হিসেবে। তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে তখন তারা একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকার প্রধানকে গ্রেপ্তার করে। বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেন, তিনি বা তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে এভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার ভেতর দিয়ে, স্বাধীনতা ঘোষণার পরে এই দেশটির আর বাকি যে বিজয় অর্জন করার ছিল তার বেশির ভাগ তিনি একাই করেন। অর্থাৎ তিনি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করলেন, তিনি ও তাঁর দল বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, তাঁরা মূলত নিজস্ব ভূমি থেকে হানাদার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছেন।
১৯৭১-এর ৯ মাসে পাকিস্তানের জেলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে তিনি যেমন বেশির ভাগ যুদ্ধে জিতিয়ে দেন বাঙালিকে, তেমনি জেলে বসেও তিনি আগরতলা মামলার মতো নিজেকে রূপান্তরিত করেন; তাঁর আকৃতি আরও বিশাল হয়। গণতান্ত্রিক বিশ্ব বলে, নির্বাচিত নেতাকে গ্রেপ্তার করার অধিকার পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের নেই। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও তাঁর সিনেটে তিনি বার বার বাধাগ্রস্ত হন পাকিস্তানের পক্ষে। এ কথাও সবাই বলেন, একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই তাঁর দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ নয়। তাই মুক্তিযুদ্ধে যেমন বজ্রকণ্ঠের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলে, মাইনে, গ্রেনেডে সবখানে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, তেমনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রায় এককভাবে লড়াই করেন গ্রেপ্তার হওয়া নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যে কোনো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন দেশের মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে হয়, তেমনি তার সঙ্গে সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে দাঁড়ায় সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ। সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর নায্যতা দিয়েছিলেন বন্দী স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনগণের কূটনীতিতে সেদিন ইয়াহিয়াকে পরাজিত করেছিলেন বন্দী বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে, সশস্ত্র পথে হানাদার তাড়ানোর যুদ্ধে সেদিন বঙ্গবন্ধুর কূটনীতির কাছে হেরে যায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। বিজয়ী হন বঙ্গবন্ধু, রূপান্তরিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে। অনেকেই ভুল করে বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন।
তবে ভারত, রাশিয়াসহ বিশ্ববিবেকের সমর্থন না পেলে ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নাও হতে পারতো। তাছাড়া কেউ ইচ্ছে করলেই একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন না। স্বাধীনতা ঘোষণা করার এখতিয়ার বা অধিকার থাকতে হয়। যিনি ঘোষণা করবেন, তাঁর প্রতি তাঁর দেশের এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন থাকতে হবে। স্বাধীনতার ডাক দিলেই জনগণ এতে সমর্থন দেবে না। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার অধিকার ছিল।
বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি শুধু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না, অনন্য সাধারণ এক ঐক্যের বন্ধনে বাঙালি জাতিকে একতাবদ্ধ করে হাজার বছরের বাঙালি জাতির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগে ও পরে বহু খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এই বাংলাতে জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু দুর্বার এক উন্মাদনায় কেউ বাঙালিকে জাগাতে পারেননি। তাই বঙ্গবন্ধুকে সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি উপাধি দয়েছে, তেমনি তাঁকে ইতিহাস থেকে নির্বাসিত করা কোনদিন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বের এক সম্মোহনী শক্তি ও যাদুস্পর্শে বাঙালিদের জাগিয়ে তুলে উদ্দীপ্ত ও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে।
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। এই প্রতিবেদনে তাকে অভিহিত করা হয় 'রাজনীতির কবি' হিসেবে। তবে সেদিন যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মতে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণ কোনো ভাষণ নয়, বরং একজন দক্ষ, সুনিপুণ কবির ছন্দময় কবিতা। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য বিতরণ করা হয়েছিল। তবে সেদিন বাংলায় কবির মতো বক্তব্য রাখলেও বঙ্গবন্ধুকে প্রথম ‘রাজনীতির কবি’ এর মতো একটি সুন্দর উপাধিতে ভূষিত করে নিউজউইক ম্যাগাজিন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ম্যাগাজিনটি তাদের প্রচ্ছদজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দিয়ে লিড নিউজে তাঁকে অভিহিত করে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্যই তাকে এ উপাধি দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলে তাঁর বেশ ক'জন সমালোচক মন্তব্য করেন, শেখ মুজিব তার চরমপন্থি সমর্থকদের কাছে প্রায় নতিস্বীকার করেছেন এবং যে গণজোয়ারে তিনি পরিবেষ্টিত সেই জোয়ারের চূড়ায় তিনি চড়তে চাইছেন। তবে এই নতুন বাঙালি জাতির লড়াইরত নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের আবির্ভাব সারাজীবন ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য তার সংগ্রামেরই যৌক্তিক ফলাফল। শেখ মুজিব যদি জোয়ারের চূড়ায়ও চড়তে চেয়ে থাকেন, তবুও সেখানে তার অবস্থানটা মোটেও আকস্মিক ছিলনা।
বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বাংলাদেশের জনগণকে তিনি পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্ত করে। আজ আমরা বিশ্বের বুকে বিজয়ী জাতি। বাংলাদেশ একটি পতাকা পেয়েছে স্বাধীন মানচিত্র অর্জন করেছে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি আধুনিক গতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন জাতি। স্বাধীনভাবে পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণ করতে পারছে। আমরা গর্বিত জাতি। আমরা স্বাধীন জাতি। আমরা অর্জন করেছি মানচিত্র এবং স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতাকে পরিচ্ছন্নভাবে টিকিয়ে রাখতে হবে, ধরে রাখতে হবে। স্বাধীনতার মর্যাদা বিশ্বের বুকে রক্ষা করতে হবে। আমার স্বাধীনতা আমার দেশের মানচিত্র পতাকা যেন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিজয়ের আনন্দকে সমানভাবে পালনের সুযোগ করে দিতে হবে। মহান বিজয় থেকে কোনো মানুষ কোনো গোত্র কোনো সম্প্রদায় যেন বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশ ও জনগণ বিজয় অর্জন করেছে সেটা জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রের সেবা সংস্থাগুলোকে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত হতে হবে। সবাইকেই সমানভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা থাকবে তারা রাষ্ট্রের মালিক নয়। রাষ্ট্রের মালিক ভাবলে সেটা ভুল হবে। তারা সেবক জনগণের সেবক। জনগণকে তারা সেবার চোখে দেখবে। মৌলিক অধিকার পূরণ করতে রাষ্ট্রের কর্তাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। স্বাধীন দেশে কেউ ফুটপাতে অনাহার-অর্ধাহার দিন যাপন কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। সব মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নিতে হবে। শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীকে জরুরিভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো অবস্থায় জনগণকে বেকার ও অলস রাখা যাবে না।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ