শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

রাজধানীতে যোগাযোগ বিপ্লবে নতুন মাত্রা মেট্রোরেল

হীরেন পণ্ডিত

১৯:৫৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৯:৫৭, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২

১৮৯৫

রাজধানীতে যোগাযোগ বিপ্লবে নতুন মাত্রা মেট্রোরেল

একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম পূর্বশর্ত হলো যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। দেশের অভ্যন্তরে মূলত সড়ক যোগাযোগে উন্নতি এলে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে সড়ক সংযোগ সুগম করার কাজটি সহজ নয়। এ লক্ষ্যে সেতু নির্মাণের আবশ্যকতা রয়েছে। তাই যোগাযোগে যুগপৎ আধুনিকতা ও উন্নয়ন আনতে হলে সার্বিক পরিকল্পনা জরুরি। বর্তমান  সরকারের সুদূরপ্রসারী সামগ্রিক পরিকল্পনায় আজ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটেছে। কয়েকদিন আগে একদিনে একশ’ সেতু উদ্বোধনের পর একসঙ্গে একশ’টি সড়ক-মহাসড়ক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এটি একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। পদ্মার মতো প্রমত্তা ও খরস্রোতা নদীতে সংযোগ সেতু নির্মাণের উদাহরণ বিশ্বে বিরল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে এটি সম্ভব হয়েছে। এরপর শত সেতু এবং শত মহাসড়ক নির্মাণ বিগত একান্ন বছরের অন্যতম অর্জন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্নের জন্য বর্তমান সরকার দেশবাসীর কাছে প্রশংসার দাবীদার। 

সড়কগুলো চালু হওয়াতে দেশীয় ও আন্তঃদেশীয় সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার হবে। দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে। এর মাধ্যমে সারাদেশে ২ হাজার ২১ কিলোমিটার সড়ক সচল করা হয়েছে। যার ভেতর ৭০ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের। যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাত দেশ-বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মিয়ানমার নিয়ে গঠিত সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশনের (সাসেক) করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

এটি স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে যোগাযোগ খাত সব থেকে গুরুত্ব পেয়েছে। শুধু সড়ক যোগাযোগ নয়, রেলপথ, নদীপথ এবং বিমান প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই উন্নয়ন চলমান। জাতীয় সড়ক মহাসড়কের বাইরেও উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ডে পর্যন্ত রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। গ্রামে-গ্রামে পায়ে চলার পথগুলোও আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে। মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনি চলাচলের সুযোগটাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শুরু করেন দেশ পুনর্গঠনের কাজ, এর মাঝে সর্বাধিক গুরুত্ব পায় যোগাযোগ ব্যবস্থার সামগ্রিক পুনর্বাসন ও উন্নয়ন। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের যোগাযোগ খাত দ্রুতগতিতে পুনর্বাসিত হতে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেমে যায় সব উন্নয়ন। পরের দশকগুলোয় বাংলাদেশের যোগাযোগ খাত প্রত্যাশিত উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে পারেনি। বিগত এক দশকে উন্নয়নের একটি ভিন্নধর্মী চিত্র দেখা যায়। একটি স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে দেশের অন্যান্য খাতের মতো যোগাযোগ খাত পেয়েছে উন্নয়নের ইতিবাচক মাত্রা। 

এই পথরেখা ধরে বাংলাদেশে শুরু হতে যাচ্ছে মেট্রোরেলের যাত্রা। মেট্রো রেলের উদ্বোধন হচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। এই দিন ট্র্রেনে করে অফিস করতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উত্তরায় জনসমাবেশে ভাষণ শেষে মেট্রো রেলের উদ্বোধনের ঘোষণা করবেন তিনি। তারপর উত্তরা উত্তর স্টেশনে এসে ট্রেনের টিকিট কেটে প্রধানমন্ত্রী আগারগাঁওয়ের পথে রওনা হবেন। আগারগাঁও থেকে তিনি নিজ কার্যালয়ে চলে যাবেন। ওই দিন ট্রেনটি আর কোনো যাত্রী পরিবহন করবে না। পরদিন বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রীদের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত থাকবে দেশের প্রথম মেট্রো রেল। প্রথম এ ট্রেনটি চালাবেন মরিয়ম আফিজা নামের একজন নারী চালক।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এসএসএফ-এর পরামর্শক্রমে এই দিনের জন্য নিরাপত্তা নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। দেশের প্রথম মেট্রোরেল হিসাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যতটা বর্ণাঢ্য হওয়ার কথা ছিল, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তা সীমিত করা হয়েছে। প্রথমদিকে যাত্রীদের ওঠানামা ও আসনে বসা-এসব বিষয়ে অভ্যস্ত ও পরিচিত করাতে প্রতি স্টেশনে ট্রেন কিছুটা বাড়তি সময় দাঁড়াবে। কিন্তু পরে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে এবং স্টেশনে দাঁড়ানোর সময় কমে আসবে। ট্রেনটি চলবে সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে।  আগারগাঁও থেকে উত্তরার দিয়াবাড়ি পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট।  মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেনে ৬টি কোচ থাকবে। এর মধ্যে দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হয়ে থাকে ট্রেইলর কোচ যেখানে চালক ও ৪৮ জন যাত্রী থাকবেন। বাদবাকি চারটি কোচের প্রতিটিতে যাত্রী সংখ্যা হবে ৫৪ জন। সব মিলিয়ে একযাত্রায় একটি ট্রেন ৩০৬ জন যাত্রী পরিবহণ করতে পারবে। ট্রেন ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি চালু হলে প্রতিদিন সব প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহণ করতে সক্ষম হবে। মেট্রোরেলের চারটি স্টেশনে যাত্রীরা চাইলে তাদের গাড়ি একেবারে ট্রেনের সিঁড়ি বা লিফটের কাছে নিয়ে আসতে পারবেন।

এছাড়া বাস, ট্যাক্সি কিংবা অটোরিকশার যাত্রীদের স্টেশনের খুব কাছাকাছি এসে নামার সুযোগ রাখা হয়েছে। স্টেশন প্লাজা নামের এ চারটি স্টেশন হলো-উত্তরা, আগারগাঁও, ফার্মগেট ও কমলাপুর। আগামী ২৯ ডিসেম্বর থেকে যাত্রীরা আপাতত প্রথম দুটি স্টেশনে প্লাজার সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। স্টেশনগুলোতে থাকবে আধুনিক সব সুবিধা। তিনতলা স্টেশনগুলোতে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা যাবে। দ্বিতীয় তলায় টিকিট কেটে যাত্রীরা চলে যাবেন তৃতীয় তলায়  যা প্ল্যাটফরম হিসাবে ব্যবহৃত হবে; টিকিটবিহীন কোনো যাত্রী সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং ট্রেনের দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলবে এবং বন্ধ হবে।

মেট্রোরেলের ভাড়ার বিষয়টি কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুব স্বল্প দূরত্বের জন্য সুবিধাজনক না হলেও বেশি দূরত্বের যাত্রীদের জন্য বেশ সাশ্রয়ী। সরকার মেট্রোরেলের ভাড়া নির্ধারণ করেছে সর্বনিম্ন ২০ টাকা আর বর্তমানে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করা আছে সর্বনিম্ন ১০ টাকা। মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে মতিঝিল এই ২০ কিলোমিটারের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা। উত্তরা দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। এ দূরত্বের ভাড়ার হিসাব হলো, উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ পর্যন্ত একই ভাড়া-২০ টাকা। মেট্রোরেলের ভাড়াকে সাশ্রয়ীই বলতে হবে। প্রবেশপথ ও নির্গমনপথ কার্ড পাঞ্চ করে খুলতে হবে। সব মিলে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে।

ঢাকানগরী একটি অপরিকল্পিত শহর হিসাবেই গড়ে উঠেছে। এর ভেতরে চলাচলের জন্য যে যোগাযোগ অবকাঠামো, তা কোনোকালেই আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছিও ছিল না। এর পাশাপাশি আবাসিক ও বাণিজ্যিক অবকাঠামোগুলোকে অক্ষত রেখে একটি পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তোলাও প্রায় অসম্ভব। তারপরও বিদ্যমান পরিবহণ অবকাঠামোকে বহাল রেখেই চলে বিড়ম্বনা লাঘবের প্রচেষ্টা। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেয়।

জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার সহযোগিতায় মূল কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ প্রকল্পের আওতায় উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রকল্পের কাজের মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। এ অংশে ৯টি স্টেশন আছে; সেগুলো হলো-উত্তরা দিয়াবাড়ি, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁও।

এর বাইরে নির্মাণাধীন আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন হবে ৭টি; যেগুলো হলো-বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি, প্রেস ক্লাব ও মতিঝিল। এ পর্বের কাজ আগামী বছরের শেষদিকে সম্পন্ন হওয়ার কথা এবং মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজ সম্পন্ন হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। আমাদের প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করার ক্ষেত্রে ত্রæটির পরিমাণ কমই লক্ষ্য করা যায়; কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় বাস্তবায়নে এবং প্রকল্পের ব্যয়ে স্বচ্ছতা ধরে রাখতে। প্রায় সব প্রকল্পেরই একটি সাধারণ সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত না হওয়া এবং এ কারণে প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। এ রকম জমকালো প্রকল্পের একটি সমস্যা  থেকেই যাচ্ছে। সাধারণত সারা বিশ্বে এ ধরনের প্রকল্পগুলো হয় একটি পরিবহণ ব্যবস্থার সমন্বিত অংশ হিসাবে। কিন্তু আমরা প্রকল্পটি সমাধা করার চেষ্টা করেছি একটি পৃথক প্রকল্প হিসাবে। সেক্ষেত্রে স্টেশন সংযোগকারী সড়কগুলোতে যানবাহণের চাপ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

বর্তমানে মোট জিডিপির ৩৭ শতাংশ জোগান দিচ্ছে ঢাকা। যানজট না থাকলে এটা আরও বাড়তে পারত। যানজটের কারণে একদিকে শ্রমঘণ্টা ও উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ঢাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। যানজটের কারণে দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে নগরায়ণের অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। 

প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার রাজধানীতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বড় বাধা নিকৃষ্ট গণপরিবহন এবং অসহনীয় যানজট। একটি টেকসই মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে পরিচিতি পেতেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের যানজট বড় বাধা। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে যানজট সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনাগুলোর ধীর গতির বাস্তবায়নও সমস্যার তীব্রতা বাড়াচ্ছে। অসহনীয় ও তীব্র ক্ষতির যানজটের জন্য জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মাত্রাতিরিক্ত চাপ, ঢাকায় কেন্দ্রীভূত প্রশাসন, কেন্দ্রীভূত সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাপ। ডিজিটাল যুগেও রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব কাজই ঢাকাকেন্দ্রিক। তবুও সব সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার পরেও ঢাকার মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবহণ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করা যাচ্ছে যানজট এর সমস্যা লাঘবে ভ‚মিকা রাখবে।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank