ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় ভিয়েনা কনভেনশন কেননা সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কর্মকান্ড এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের নানাবিদ মন্তব্য দেশের রাজনীতি ও কূটনীতিক মহলে আলোচনার ঝড় বয়ে চলছে। কী আছে ভিয়েনা কনভেশনে, সে বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সম্পন্ন হওয়া যেকোন চুক্তিই ভিয়েনা কনভেনশন হিসেবে পরিচিত লাভ করলেও কূটনীতিকদের আচরণগত বিষয় নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণে ১৯৬১ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সই করা হয়েছিল একটি চুক্তি যেটি ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপলোমেটিক রিলেশনস -১৯৬১ ’ হিসেবে পরিচিত। ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস -১৯৬১’ চুক্তিটিতে মোট ৫৩টি আর্টিকেল রয়েছে। ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস -১৯৬১’ এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কিছু নিয়ম-নীতি প্রণয়ন করা এবং সেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস- ১৯৬১ সালে স্বাক্ষর হলেও কনভেনশনটি কার্যকর হয় ১৯৬৪ সালের ২৪ এপ্রিল। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ১৯৬৪ সালে ওই চুক্তিতে সই করেছিল এবং পরে ধাপে ধাপে যে সকল দেশ স্বাধীন হতে থাকে তারাও চুক্তিতে সই করে ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস -১৯৬১ এ অন্তর্ভূক্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৭৮ সালে ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস -১৯৬১ সই করে এবং ভিয়েনা কনভেনশনের আওতাভূক্ত হয়।
ভিয়েনা কনভেনশনে উল্লেখিত নিয়ম-নীতি অনুযায়ী জাতিসংঘের সদস্য যে কোন দেশে অন্য কোন দেশের কুটনীতিক মিশন বা প্রতিনিধিরা অবস্থান করে থাকে এবং ভিয়েনা কনভেনশনের চুক্তির মাধ্যমে অন্য দেশের কূটনীতিকদের বিভিন্ন ধরণের সুবিধা, নিরাপত্তা, বাসস্থান, আইন প্রয়োগসহ নানা বিষয় নিশ্চিত করে থাকে স্বাগতিক দেশ (Host Country)। অর্থ্যাৎ ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনীতিক এবং স্বাগতিক দেশ (Host Country) আচরণ করে থাকে। ভিয়েনা কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী কূটনীতিকরা যে দেশে কাজ করবেন সে দেশের সংবিধান এবং আইনের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রেখে কাজ করবেন। সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ভিয়েনা কনভেনশনে আরও বিধান আছে যে, কূটনীতিকদের সকল কর্মকাণ্ড সেই দেশের অর্থ্যাৎ স্বাগতিক দেশ (Host Country) বা গ্রহণকারী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা ওই দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই প্রক্রিয়ার বাইরে কূটনীতিকদের অন্য কোনো ভাবে সে দেশের রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই।
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ এর উল্লেখযোগ্য নীতির মধ্যে রয়েছে কূটনীতিক সম্পর্ক হবে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে। অর্থ্যাৎ এই চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল ৯ এ বলা হয়েছে যে, যেকোন দেশ ওই দেশে নিযুক্ত অন্য দেশের কূটনীতিককে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই ‘পারসোনা নন গ্রাটা (Persona non grata)’ বা অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করতে পারে। ওই কূটনীতিক সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর আগেই তাকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যায়। একটি দেশের কূটনীতিক মিশনের প্রধানসহ ওই মিশনে কর্মরত যেকোন ব্যক্তিকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিযুক্ত ওই কূটনীতিককে প্রেরক দেশ হয় বরখাস্ত করবে অথবা ফিরিয়ে নেবে। যদি যথাযথ সময়ে ওই দেশ তাদের কূটনীতিককে ফিরিয়ে নিতে না পারে তাহলে স্বাগতিক দেশ (Host Country) ওই কূটনীতিককে তার বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা নাকোচ করতে পারে। কূটনীতিক বিশ্লেষকের মতে , ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ ধরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটতে দেখেছি আমরা যেমন- ২০১৯ সালে কাশ্মির ইস্যুতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পাকিস্তান বরখাস্ত করেছিল। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ভিয়েনা কনভেনশন চুক্তিতে সই করার পর বাংলাদেশ কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দেশের কূটনীতিককে বরখাস্ত করা হয়নি। তবে কোন দেশের কূটনীতিককে নিয়ে যদি বাংলাদেশের আপত্তি থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিকভাবে তা সংশ্লিষ্ট দেশকে জানানো হয় এবং আর এভাবেই ওই কূটনীতিককে প্রত্যাহার করা হয়।
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ১১ বলা হয়েছে যে, আলাদা কোন চুক্তি না থাকলে কূটনীতিক মিশনের কাজ বিবেচনায় মিশনের আকার বা সাইজ যৌক্তিক হতে হবে। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ১২ বলা হয়েছে যে, কূটনীতিক মিশন প্রেরণকারী দেশ মিশনের জন্য বরাদ্দকৃত অফিস সীমার বাইরে অন্য কোন জায়গায় কোন অফিস স্থাপন করতে পারবে না। মিশনের অফিস এলাকায় বিদেশি কূটনীতিক মিশন প্রধানের অনুমতি ছাড়া গ্রাহক দেশের সরকারও প্রবেশ করতে পারবে না। তবে কূটনীতিক মিশনের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে স্বাগতিক দেশ (Host Country) বা গ্রাহক দেশকেই। কূটনীতিক মিশনের প্রাঙ্গন এবং তাদের যানবাহনে তল্লাসি, সেটি ব্যবহার, বাজেয়াপ্ত বা সংযুক্তি কোন কিছুই করা যাবে না। মিশনের প্রধানকে ওই মিশন এলাকা সম্পর্কিত বিষয়ে সব ধরণের জাতীয়, আঞ্চলিক বা মিউনিসিপালের বকেয়া ও করের বাইরে রাখতে হবে অর্থাৎ তাদের এ সম্পর্কিত কোন কর দিতে হয় না। কূটনীতি মিশনের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার এবং কূটনীতিক ও তার পরিবারের সদস্যদের গৃহকর্মে ব্যবহৃত যেকোন পণ্য আনা হলে তা সব ধরণের শুল্ক ও করের বাইরে থাকবে। মারাত্মক কোন অভিযোগ না থাকলে কূটনীতিক এজেন্টদের ব্যাগও তল্লাসি করা যাবে না।
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ২৬ বলা হয়েছে যে, কূটনীতিক মিশনের সব সদস্য ওই দেশের সবখানে স্বাধীন ও অবাধে চলাচল করতে পারবে। তবে শুধু জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সংরক্ষিত এলাকায় তাদের প্রবেশ সীমাবদ্ধ হবে। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ২৭ বলা হয়েছে যে, দাপ্তরিক কাজের জন্য মিশনের স্বাধীন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কুটনৈতিক কুরিয়ার, কোডেড বার্তা পাঠানোসহ যেকোন ধরণের যোগাযোগ করতে পারবে তারা। তবে ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার বসাতে হলে অবশ্যই স্বাগতিক দেশ (Host Country) বা গ্রাহক দেশের সরকারের অনুমতি লাগবে। কূটনৈতিক কোন ব্যাগ খোলা বা আটক করা যাবে না। কূটনৈতিক কোন কুরিয়ারও গ্রেফতার বা আটকের আওতায় পড়বে না। ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস- ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ২৯ বলা হয়েছে যে, বিদেশি কূটনীতিকদের আটক বা গ্রেফতার করা যাবে না। বিদেশি কূটনীতিকদের স্বাগতিক দেশ (Host Country) বা গ্রাহক দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার বাইরে থাকবে। এমনকি তারা কোন ঘটনায় সাক্ষ্য দিতে বাধ্য থাকবেন না।
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস- ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ৩১ উল্লেখ রয়েছে যে, যেকোনও ধরনের অপরাধমূলক বিচারের আওতা থেকে কূটনীতিকরা মুক্ত থাকবেন অর্থ্যাৎ এ কনভেনশন অনুযায়ী কূটনীতিকদের বিচার করা সম্ভব নয় । উল্লেখ্য যে, ‘কোনও কূটনীতিক যদি অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন এবং তিনি যে দেশের নাগরিক তারা যদি তার কূটনৈতিক অব্যাহতি (ইমিউনিটি) প্রত্যাহার করে, তবেই তিনি যে দেশে অপরাধ করেছেন, সে দেশে বিচার করা সম্ভব’।
ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ চুক্তির আর্টিকেল ৪১ উল্লেখ রয়েছে যে, যেসব ব্যক্তি অন্য কোন দেশে কূটনীতিকের মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করেন তারা ওই দেশের আইন ও নীতি মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। এছাড়া তারা ওই দেশের অভ্যন্তরীণ কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ভিয়ানা কনভেনশনের আর্টিকেল ৪১ আরও বিধান আছে যে, কূটনীতিকদের সকল কর্মকাণ্ড সেই দেশের (গ্রহণকারী রাষ্ট্র) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা ওই দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এই প্রক্রিয়ার বাইরে কূটনীতিকদের অন্য কোনো ভাবে সে দেশের রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই।
তবে সাম্প্রতিককালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকার শাহীনবাগে নিখোঁজ বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাড়ি পরিদর্শনের ঘটনা্ এবং ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকির বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট দেয়া নিয়ে বিরুপ মন্তব্যর বিষয়টি আমলে নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কূটনীতিকদের ভিয়েনা কনভেনশন মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সুতারং আমরা আশাকরি, ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস ১৯৬১ চুক্তির সকল প্রযোজ্য আর্টিকেল সকল কূটনীতিক দেশগুলো মেনে চলবে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে।
জিয়াউর রহমান, পিএমপি: উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই প্রোগ্রাম।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- কেন পড়া উচিত ‘সাতকাহন’