কলেজশিক্ষক খায়রুন নাহারের পরিণতির দায় কার?
কলেজশিক্ষক খায়রুন নাহারের পরিণতির দায় কার?
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনমত গঠনের দায়িত্ব গণমাধ্যমের। স্বাস্থ্যকর সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব নেন সাংবাদিকরা। কিন্তু সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ যেন দিনকে দিন উল্টোপথে হাঁটছে। বাজার-কাটতি কিংবা ভিউয়ের আশায় দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের আশায় নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা কাজ করে যান, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা আখেরে সংবাদ পরিবেশনের কাজটিই হয়। কিন্তু তাতে জনগণকে সচেতন করে তোলা হয় না। যেখানে কদিন আগে একটি ঘটনার সৌন্দর্য দেশকে আনন্দিত করতে পারতো, তা এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে।
বলছিলাম, নাটোরের কলেজশিক্ষিক খায়রুন নাহার ও শিক্ষার্থী মামুনের অসম বয়সের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে। এই বিয়ের সংবাদটি চাউর হতে শুরু করে সংবাদমাধ্যমগুলোতে। একের পর এক শিরোনামে মেতে ওঠে সংবাদমাধ্যমগুলো। বিশেষত অনলাইন পোর্টালগুলো প্রতিনিয়ত জনগণকে তথ্য দিতে শুরু করে। কেউ বিকৃত হেডলাইনে তথ্য দেয়, কেউ প্রশংসামূলক মন্তব্যের। সব ধরনের অভিমতকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল পোর্টালগুলোয়। একই নিউজ পোর্টালে এক নিউজে এই ঘটনার কট্টর সমালোচনা ও অন্য নিউজে এমন কাজের প্রশংসাও প্রকাশিত হচ্ছিল। নানামুখী আলোচনার ঝড়ে সেই ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিবর্গের আদৌ ক্ষতি হচ্ছে কি না, তা যেন দেখার বিষয় নয়। অবশেষে ১৪ আগস্ট খায়রুন নাহারের মৃতদেহ উদ্ধারের পর এমন চটকদার আলোচনা লম্বা করার আরও বাড়তি সুযোগ পাওয়া গেলো। ময়নাতদন্তের আগেই ‘আত্মহত্যা’র খবর ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। আবারও সুড়সুড়িসর্বস্ব আচরণে অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো মেতে উঠেছে। যা ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুরু হলো নতুন বিতর্ক। এতে কদিন আগের সেই প্রশংসা, ‘বিয়ে পাপ নয়’ এখন ‘অসম বিয়ে কি অপরাধ?’এমন ভাবান্তরে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের কাজ ও উদ্দেশ্য আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
গণমাধ্যমে খায়রুন নাহারের মর্মান্তিক পরিণতির ঘটনা শুধু গণমাধ্যমের ভূমিকাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, আমাদের সমাজ ও তার দৃষ্টিভঙ্গিকেও কদর্যরূপে উপস্থাপন করেছে। অসম বিয়ের ঘটনা দেশে নতুন কিছু নয়। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে বা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়েও তা ঘটেছে। তবে এবার একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। এবার অসম বিয়েতে স্ত্রীর বয়স বেশি। একজন নারী বয়সে তারচেয়ে ছোট কাউকে বিয়ে করা আইনের চোখে অপরাধ নয়। তবু নানামুখী চাপ ও নেতিবাচক মন্তব্য বিভিন্নভাবে যন্ত্রণায় ফেলে তাদের। এরই পরিণতির শিকার হলেন খায়রুন নাহার। কিন্তু এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকাকেও কি ছোট করে দেখার অবকাশ আছে?
বর্তমানে গণমাধ্যমকে নির্ভর করতে হয় পাঠক-দর্শকের ওপর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম বাজারে কাটতির দিকেও মনোযোগ দিয়ে থাকে। তাই তার উদ্দেশ্য থাকে বাজারে কিভাবে বিক্রি হবে বা নিউজ বেশি ভাইরাল হবে, সেদিকে। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে করেছে সহজ। তাই পাঠক-দর্শকরাও যেন এক নজরে সব তথ্য পেয়ে যেতে চায়। নিউজ পোর্টালগুলোও সেভাবেই ছাপানো হয়। মানুষ হেডিং, ছবি দেখেই ঝাঁপ দেয় মন্তব্যের ঘরে। সেখানে অন্যান্য অভিমতের মিশ্র-প্রতিক্রিয়ায় তাকে ডুবে যেতে হয়। সেজন্যেই তো নানা মতের জঞ্জাল হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। অথচ বস্তুনিষ্ঠভাবে অনলাইন পোর্টালের সংবাদ পরিবেশিত হলে এমনটা হতো না।
জানা গেছে কলেজশিক্ষক খায়রুন নাহার নিজ কর্মক্ষেত্রে মানুষদের কাছে নানা অপমানের স্বীকার হয়েছেন। পরিবারের মানুষজনও নানাভাবে অপদস্থ করে গেছে দিনের পর দিন। কিন্তু কতটা সামাজিক চাপ থাকলে আত্মহত্যার (যদি হয়েও থাকে) সিদ্ধান্ত নিতে হয়? বিশেষত একজন নারীর জন্যে এই যন্ত্রণা বয়ে চলাও কঠিন। যেন সমাজে থেকেও তাকে ভাবতে হচ্ছে এই সমাজে তার অবস্থান নেই। এই কাজটি ভুল ছিল। এটি হয়তো অপরাধ। অথচ এমন পদক্ষেপ দুটি মানুষের উন্নত মানসিকতার পরিচয় হিসেবেই চিহ্নিত হতে পারতো। সমাজের ট্যাবু কিংবা গোঁড়া অবস্থানে থেকেও সাহসিকতার সঙ্গে সম্পর্ককে বৈধতা দেওয়ার সাহস আছে কজনের? সমাজে খুন-অপহরণ, ধর্ষণের মতো অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এমন সুড়সুড়িমূলক মন্তব্য খুব বেশি পাওয়া যায় না। যে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে নেই বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেগুলোকে শুধু সংবাদ বা তথ্য পরিবেশনের রসদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
এতে সামাজিকভাবে কি সৎসাহস প্রকাশের ব্যাপারেও নিরুৎসাহিত হন না অনেকেই? জনগণের মন্তব্যকে নাহয় এতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার জটিলতা আছে। কিন্তু জাতীয় সংবাদমাধ্যম কিংবা সংবাদ পরিবেশনা সংস্থা থেকে যখন নানামুখী মন্তব্য আসে, তখন তার প্রভাব শুধু জাতীয় পরিসরেই পড়ে এমন না। দেশের সীমানা ছাপিয়ে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পৌঁছে যেতে পারে।
এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নজরদারির অভাব আছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোনো মন্তব্য প্রকাশ করা চলে। বাকস্বাধীনতা হরণের কথাও সেখানে বলা যায় গোপনে। প্রযুক্তি বাকস্বাধীনতা দিলেও সৎসাহস যেন গোপন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেই কাঠামোকে ধারণ করেই গণমাধ্যম নিজেকে যেন করে তুলছে জনগণ। তাতে জনমত গঠনের দায় কে নেবে? খায়রুন নাহারের মৃত্যুটি সমাজের চাপের ফল, একথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কিন্তু এও সত্য, গণমাধ্যম একে যতটা বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে এসেছে, তা দুঃখজনক। তথ্যের ঘনঘটা ও অসঙ্গতি সাধারণ মানুষের জীবনে আহামরি প্রভাব ফেলে না। কিন্তু সেই কলেজশিক্ষককে যেন দায় নিতে হচ্ছিল ভুলগুলো সংশোধনের। যে ভুল তার নয়, সেই ভুলের দায় কেন তাকে নিতে হবে? এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, খায়রুন নাহারের মৃত্যুর দায় কার? সে দায় না নেবে সমাজ অথবা সংবাদমাধ্যমে উস্কানিমূলক কিংবা চটিসিদ্ধ লেখা প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো একজন সাংবাদিক সৎ সংবাদ প্রকাশের জন্যে জীবনবাজি রেখে কাজ করে যান, সংগ্রহ করেন তথ্য। সেখানে দেশে যেন ভিউ আর মানুষের অভিমতের ভিত্তিতেই বানানো হয় সংবাদ। এর মূলে রয়েছে গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা সম্পর্কে খুঁটিনাটি না জেনেই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা থেকে। সংবাদমাধ্যমগুলোকে এখন থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা সংশ্লিষ্ট যে কর্মীদের সংবাদ সংগ্রহে কিংবা অভিমত লেখার দায়িত্ব দিচ্ছে, তার জন্যে কী রকম জবাবদিহিতা কার্যকর করা যায়। বিশেষত একই পত্রিকায় সাংঘর্ষিক মন্তব্যের প্রকাশও সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতা বিঘ্নিত করে। সাংবাদিকতায় প্রতিষ্ঠার জন্যে শিক্ষা ও সুরুচি জরুরি।
যেহেতু সাংবাদিকতায় অন্যান্য অনেক পেশার মতো যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা নেই, তাই অর্ধশিক্ষিত লোকেরাও এখানে প্রবেশ করছেন। তাতে গণমাধ্যম তার স্বর হারাতে বসেছে। এমনটা চলতে থাকলে একসময় জনগণ সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থা হারিয়ে ছুড়ে ফেলবে। তাতে বরং সাংবাদিকতা পেশাই হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষত সামাজিক বিভিন্ন খবরাখবর পরিবেশনে রুচিশীলতার বিষয়টি নিশ্চিত হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে সচেতন মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। সংবাদপত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ তার স্বাধীনতা বিঘ্নিত করে। কিন্তু জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেই অভিযোগের অভিতের মাধ্যমেই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের পরিসর বাড়ানোর উৎসাহ সৃষ্টি হবে। তবেই অসম বিয়ে অপরাধ নয় এই অভিমত জনগণের কাছে তুলে ধরা যাবে। সমাজের সাহসিকতার গল্পকে গলাচাপা দিয়ে মেরে ফেলার এই নজির যেন আর না হয়। সে বিষয়ে অন্তত সংবাদমাধ্যমকে কিছুক্ষণ ভাবতে হবে।
লেখক: সংবাদকর্মী।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ