শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সৈয়দ আবুল হোসেন কি তার মর্যাদা ফিরে পাবেন

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

১১:৫৪, ২৪ জুন ২০২২

২১০৪

সৈয়দ আবুল হোসেন কি তার মর্যাদা ফিরে পাবেন

১৯৯১ সাল। মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের হাল ধরে দলে আসেন তিনি। দলে যোগ দিয়েই যেন মাদারীপুর-৩ আসনের জন্য আশির্বাদ হয়ে এলেন। অবহেলিত একটি জনপদের উন্নয়নে আন্তরিক প্রচেষ্টার যাত্রা শুরু করলেন। তিনি টানা চারবার (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বরাবরই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী ও পূর্ণমন্ত্রী হয়েছেন। এক ডজনেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছেন নির্বাচনী এলাকায়। ঘরের ছেলে সকালে পান্তা খেয়ে এমএ পাস করেছে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে। বিসিএস ক্যাডার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন তারা। যার জন্য এত কিছু। যার জন্য এত উন্নয়ন। তিনিই আজ নিজ এলাকায় অবহেলিত। এতক্ষণ যে ব্যক্তির কথা বলছিলাম, তিনি আর কেউ নন; সাবেক যোগযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন।

২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। ২০১৪ সালে এলাকার মনোনয়ন থেকেও বঞ্চিত হন। এরপর দলীয় পদ থেকেও দূরে সরে যান আবুল হোসেন। এসব কিছুর পেছনে একটিই কারণ ছিল, তাহলো পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক্কালে তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগ। মিথ্যা এ অভিযোগের অজুহাতে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। কিন্তু হাল ছাড়েননি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একসময় সে অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কানাডার আদালত, বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে। ততদিনে তিনি হারিয়েছেন নিজের সম্মান। ক্ষুন্ন হয়েছে তার মর্যাদা। অথচ নির্দোষ ঘোষণার পরও তিনি হারানো কোনো কিছুই ফেরত পাননি। নীরবে অভিমানে তখন মনোযোগ দিয়েছেন নিজের ব্যবসায়।

শুরুতেই কথাগুলো বলার কারণ, আগামী ২৫ জুন বাঙালির আবেগ ও সম্মানের প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব অবাক বিস্ময়ে দেখবে আলো ঝলমলে সে অনুষ্ঠান। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজও সম্পন্ন হয়ে গেছে। ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে জ্বলে উঠেছে বাংলাদেশের আলো। প্রমত্তা পদ্মার বুকজুড়ে এখন আলোর ঝলকানি। পদ্মাপাড়ের মানুষ যা কখনো কল্পনাও করেনি। আজ তারাই বিস্মিত নয়নে দেখছেন এসব। দক্ষিণবঙ্গের আপামর মানুষ উচ্ছসিত ও উদ্বেলিত। চারিদিকে আলোচনার ঝড়। মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষা। এরই মাঝখানে ক্ষণে ক্ষণে উচ্চারিত হচ্ছে একটি নাম। তিনি সৈয়দ আবুল হোসেন। পদ্মার বুকে নির্মিত ৬.১৫ কিলোমটির সেতু দেখে তিনিও আপ্লুত। তবুও মনের কোণে কেমন খচখচ করছে কিছু ব্যথা, কিছু অভিমান। জনগণও বলছে, তিনি যদি নির্দোষ হন; তাহলে কেন তার হারানো মর্যাদা ফিরে পাবেন না? অবশ্যই তাকে মূল্যায়ন করা উচিত।

সৈয়দ আবুল হোসেন সম্প্রতি তার একটি লেখায় বলেছেন, ‘এ সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ার সূচনায় আমি সম্পৃক্ত থেকে যেভাবে কাজ করেছি সে ধারা অব্যাহত রাখতে পারলে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হতো। কিন্তু বিশ্বব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে তা নয় বছর পিছিয়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত আর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতু আমাদের গৌরবের প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। প্রকৌশলগত এক বিস্ময়ের প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের সততার প্রতীক। পদ্মা সেতু আমাদের অপমানের প্রতিশোধ। ষড়যন্ত্রের জবাব। পদ্মা সেতুর ফলে জাতির আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। পদ্মা সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততা ও সাহসের সোনালি ইতিহাস।’ (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন)

আমরা জানি, সৈয়দ আবুল হোসেন প্রায় তিন বছর যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। তিন বছর তিনি পরিশ্রম করেছেন। সরকারি প্রকল্পের জন্য প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য মবিলাইজ করেছেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ এবং বর্তমান রেল মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন এবং বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি যখন দায়িত্ব নেন; তখন সেতু বিভাগের বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায় করা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। তিনি দায়িত্বে এসে সেতু বিভাগের কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করেন। মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে পদ্মা সেতু নির্মাণ, ঢাকা-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ঢাকা ও চট্টগ্রামে টানেল নির্মাণ, গুলিস্তান লেচু শাহের মাজার থেকে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণসহ ১১টি প্রকল্প গ্রহণ ও কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন শুরু করেন। 

এ প্রসঙ্গেও সৈয়দ আবুল হোসেন বলেছেন, ‘জোর দিয়ে বলতে পারি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি তিন বছরে যে কাজ করে দিয়ে এসেছি, যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছি, সেসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে, অগ্রগতি হয়েছে, সে কাজ ১০০ বছরের ভিতরে পাঁচ বছর মেয়াদি কোনো সরকার উদ্যোগ নিতে পারেনি। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে আমি যেসব প্রকল্প গ্রহণ করেছি, বাস্তবায়ন করেছি; তা হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক এবং একটি ঐতিহাসিক দলিল।’ (সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন)

সেসব নিয়ে এখন হয়তো তেমন আলোচনা হবে না। তবে দেশবাসীর নজর ছিল পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের ব্যাপারে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। যদিও পৃথিবীর বিচিত্র নদী পদ্মার প্রকৃতি, গতিপ্রবাহ এবং কোভিড-১৯ বা করোনার কারণে নির্মাণ প্রকৌশলীদেরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। স্বাভাবিক বাস্তবতায় সময় ক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় পদক্ষেপ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অনেক ষড়যন্ত্র, বাধা, বৈরিতার মধ্যেও পদ্মা সেতুর দ্বার আজ উন্মোচিত। ফলে সমগ্র জাতি আজ গর্বিত ও আনন্দিত। আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বিশাল বিজয়। আমরা একটি ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরেছি। শেখ হাসিনা তার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছেন। 

তাই তো পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ১৫ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে একটা মিথ্যা অপবাদ আমাদের দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, আমাদের একজন স্বনামধন্য মানুষ, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলাম। সেই ড. ইউনূস বেইমানি করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে থাকতে না পেরে তিনি এ কাজ করেছেন। তিনি তার বন্ধু তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের স্বামীর ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে’ তিন লাখ ডলার ডোনেশন দিয়েছিলেন। হিলারি আমাকে ফোনও করেন। আমার কাছে ধরনা দেন। তাকে আমি আইনের কথা বলেছি। বিশ্বব্যাংকের কাছে বার বার মেইল পাঠান, দুর্নীতি হয়েছে বলা হয়। আমি বলেছিলাম, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম যে, এটা প্রমাণ করতে হবে। পরে এটা ভুয়া প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু ইউনূসের প্ররোচনায় বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। আমরা বলেছিলাম, নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করবো, করেছি। (সূত্র: জাগো নিউজ)

আমরা আমাদের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেওয়া কথা রাখতে পেরেছেন। তারপরও একটি কথা বার বার মনে হচ্ছেÑনির্দোষ সৈয়দ আবুল হোসেন কি তার মর্যাদা ফিরে পাবেন? এলাকার উন্নয়নে জনপ্রতিনিধি হিসেবে ফিরে আসতে পারবেন? আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার আবুল হোসেনের সততার পুরস্কার অবশ্যই দেবেন। তাতে হয়তো সব অভিমান ভুলে আবুল হোসেনের মুখেও আবার হাসি ফুটবে। তবে দল-মত নির্বিশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যেন সৈয়দ আবুল হোসেনকে ভুলে না যাই। শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধিতা না করে সত্যটিও জানার চেষ্টা করি। আইনের চোখে তিনি যেহেতু নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন, তাই তাকে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেওয়াও আমাদের কর্তব্য। আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টি ভেবে দেখবেন। 

লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কালকিনি প্রেসক্লাব, মাদারীপুর। 

[এই বিভাগের মতামত লেখকের নিজস্ব]

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank