সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সৌমিত্রর মৃত্যু সংবাদ উপস্থাপনার ‘সুলুক সন্ধান’

রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক

১৫:০৬, ১৬ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৯:১৩, ১৬ নভেম্বর ২০২০

১৫৬৩

সৌমিত্রর মৃত্যু সংবাদ উপস্থাপনার ‘সুলুক সন্ধান’

আলোচনাটি শুরু করা যেতে পারে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত গোয়েন্দ গল্প ‘সোনার কেল্লা’র একটি কালজয়ী সংলাপ দিয়ে। ভুয়া প্যারাসাইকোলজিস্ট মন্দার বোস যখন ড. হেমাঙ্গ হাজরাকে জয়সলমিরের কেল্লা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো ঠিক সেখান থেকে। যখন মুকুল জানতে চায়, ‘দুষ্টু লোকটি কোথায়’? উত্তরে মন্দার বোস বলে ‘ভ্যানিশ’! এই ‘ভ্যানিশ’ শব্দটি একটি কালজয়ী সংলাপ হয়ে উঠে কলকাতায়। ভালো-মন্দ দ্বন্দ্বের পার্থক্যকে শ্লেষাত্মকভাবে উপস্থাপন করতে ‘ভ্যানিশ’ শব্দটি সত্যজিৎ অনুরাগীদের কাছে একটি চুটকি।

১৬ই নভেম্বর ভারতের মূলধারার মিডিয়া এবং বলিউডের দিকে তাকিয়ে আমারও মনে পড়লো ‘ভ্যানিশ’ শব্দটি। কারণ, ১৫ই নভেম্বর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহাপ্রস্থানের পর বাংলা তারকালোকের ইন্দ্রপতন ঘটেছে। এই মৃত্যুতে তারকাখ্যাতির যে শোক, স্মৃতিমেদুরতা এবং সংশ্লেষ তা পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলার সংবাদপত্র ও টলিউড দেখিয়েছে, তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলিউড এবং ভারতীয় মূলধারার সংবাপত্র নীরব থেকেছে। যেন অবাধ্য কূলহারা, বংশচ্ছিন্ন সন্তানের মতো সৌমিত্রের সংবাদ উপস্থাপনার ‘প্রেতকৃত্যে’ও অংশ নিলো না তারা। বলিউডের তারকারা কেউ কেউ অবশ্য ভাসুরের নামটি মুখেও আনেননি মৃত্যুর তিন চার ঘণ্টা পরও নিজেদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বলিউডের এই হীরন্ময় নীরবতা আবারো প্রমাণ করলো, বাংলা বরাবরাই উপেক্ষিত মূলধারার ভারতীয় গণমাধ্যমে এবং বলিউডের বুকে। বাংলার এক তারকাকে যেন ‘ভ্যানিশ’-ই করে দিলো বলিউড। অথচ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পুরো ভারতের গর্ব, একজন সফল বাঙালি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে। বাণিজ্য সফল, রুচিতেও স্নিদ্ধ এবং বরাবরই মেইনস্ট্রিম ছবির নায়কও ছিলেন তিনি। আসুন এবার সৌমিত্রের মৃত্যু সংবাদ উপস্থাপনার সুলুক সন্ধান করা যাক।

পশ্চিমবাংলার সর্বাধিক বিক্রিত ‘দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা’ প্রথমপৃষ্ঠাজুড়ে সৌমিত্র বন্দনা করেছে। মাত্র একটি শব্দে ব্যানার লিড করেছে তারা- ‘অপরাজিত’। আমরা জানি, অপু ট্রিলজির শেষ সিনেমা ‘অপরাজিত’। সেই নামটি দিয়ে রচিত প্রধান শিরোনাম থেকে আন্দাজ করা যায়, লিজেন্ডারি সৌমিত্রের শারিরীক মৃত্যুর পরও তিনি যেন অপরাজিতই থাকলেন। ছয়কলাম জুড়ে লিড ছবি দেয়া হয়েছে শবযাত্রার। চারটি খবর আছে প্রথম পৃষ্ঠায়, ইয়ারপ্যালেনসহ প্রথম পৃষ্ঠার ছয়টি ছবির ছয়টিই সৌমিত্রের। মূল ছবিটি অপুর সংসারের স্ত্রী বিয়োগের পর বিষাদক্রান্ত অপুর। অপু যেন তাকিয়ে আছে মহাপ্রস্থানের অন্তিম গন্তব্যের দিকে। তাছাড়া ‘সম্পাদকীয় বিশেষ আয়োজন’ ছাড়াও আনন্দবাজারের প্রায় প্রত্যেকটি পাতাই ছিলো সৌমিত্রের স্মরণে উৎসর্গীকৃত।

‘সংবাদ প্রতিদিন’ ব্যানার লিড করেছে ‘অমরত্বের অভিযানে অপু’। সাব-হেডে লেখা হয়েছে ‘বাঙালিকে কাঁদিয়ে চিরঘুমে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দেশজুড়ে শোকের ছায়া’। পাঁচটি ছবির মধ্যে লিড ছবিটি সৌমিত্রের শবদেহের ওপর মেয়ে পৌলমীর, বাবাকে নুইয়ে শেষ চুম্বন দেয়ার। ‘কাপুরুষ’ চলচ্চিত্রের সৌমিত্র চরিত্রের পেইটিং ছাপা হয়েছে বেশ বড় করে প্রথম পাতার বুকের মাঝে। এঙ্করে গ্রাফিক্স করে সিনেমাটিক রিল ব্যবহার করা হয়েছে যা একজন তারকার মৃত্যুর সংবাদকে প্রথম পৃষ্ঠার নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্রতা দেয়। যেখানে নরেন্দ্র মোদি, অমিতাভ বচ্চনের মতো বিখ্যাতজনদের তাৎক্ষণিক শোকবার্তা রয়েছে। সংবাদ প্রতিদিন ভেতরেও একাধিক পাতা ও ম্যাটার ব্যবহার করেছে সৌমিত্র স্মরণে।

** পড়ে আছে চন্দনের চিতা: সৌমিত্র ও সত্যজিৎ

‘এই সময়’ পত্রিকার অর্ধেক পৃষ্ঠাজুড়ে বিজ্ঞাপন থাকলেও ব্যানারলিডে যথারীতি মুখ উদাসীন, স্ত্রী বিয়োগের পর ছন্নাছাড়া স্বামী ‘অপু’র ছবি। ব্যানার লিড: ‘অপু সেই নিশ্চিন্দিপুরে’। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, নিশ্চিন্দিপুর বলতে এখানে পথের পাঁচালির অপুর আদিবাড়ি তথা ভিটাকে বোঝানো হয়েছে। মানে শেষ ঠিকানা! যে নিশ্চিন্দিপুরের জন্য কলকাতার বুকে অপু খুব মন খারাপ করে থাকতো। বারবার ফিরে যেতে চাইতো যে গ্রামে।

‘আজকাল’ ব্যানার লিড করেছে ‘সৌমিত্র যুগ সমাপ্ত’। ফ্ল্যাট পেইজ মেক-আপে মাত্র দুটি সংবাদ ও তিনটি ছবি রয়েছে এখানে। এঙ্করে রয়েছে মেয়ে পৌলমীর বিশেষ অভিব্যক্তি, মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। ইয়ারপ্যানেলেও রয়েছে বয়োবৃদ্ধ সৌমিত্রের দুটি ছবি।

‘দি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকা ব্যানার লিড করেছে ‘ELEGANCE’ শব্দটি দিয়ে, উপশিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ‘EXTRAORDINAIRE’ শব্দটি। যথারীতি প্রথমপৃষ্ঠাজুড়ে সৌমিত্রবন্দনা এবং আনন্দবাজার পত্রিকার সিস্টার কনসার্ন এই পত্রিকাও আনন্দবাজারের মতো একই ছবি ব্যবহার করেছে সেই অপুর সংসারের উদাসীন অপুকে। টেলিগ্রাফের ভেতরের চার থেকে আট পাতা পর্যন্ত ‘অপুস ওয়ার্ল্ড’ ফ্ল্যাগ দিয়ে পুরোপৃষ্ঠাজুড়ে সৌমিত্রের চলচ্চিত্র জীবনের স্থিরচিত্র, সংবাদ, স্মৃতিচারণ ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। একই পত্রিকার নগর পাতা ‘মেট্রো’তেও রয়েছে ব্যানার লিডে সৌমিত্রের মর্ষিয়াক্রন্দন, যেখানে রাজনীতি এসে থেমে গেছে মৃত্যুর দুয়ারে। আজীবন বাম মতাদর্শের সৌমিত্রের শেষ যাত্রায় বামের বিরোধী তৃণমূলের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানর্জির পাশে থাকাকে ব্যানার লিড করেছে ‘Politics pauses for last ride’, যেখানে বলা হয়েছে বাম ও তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব সৌমিত্রের শেষযাত্রায় একসমান্তরালে। সৌমিত্রের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বই পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাত্রায় যুক্ত করলো এই দৃশ্যটি, যা আদতে বিরল।

বাংলার পত্রিকা জুড়ে সৌমিত্র উজ্জ্বল বিরাজমান হলেও বলিউড এবং মূলধারার ভারতীয় পত্রিকায় উপেক্ষিত সৌমিত্র। ভারতসেরা অভিনেতার পুরস্কার যিনি পেলেন, ভারতের সিনেমাকে যিনি বিশ্বদরবারে নিয়ে গেলেন ‘অপু ট্রিলজি’ দিয়ে, তিনিই হয়ে রইলের চরম উপেক্ষিত। ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার এঙ্করে (সবার নিচে) সৌমিত্রের খবর ছাপা হয়েছে। ‘হিন্দুস্থান’ পত্রিকার হিন্দি ভার্সনে নেই সৌমিত্র, হিন্দি ‘জনসংখ্যা’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়ও নেই সৌমিত্র, ‘ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় খুব ছোট্ট করে এক কলামে সৌমিত্রের মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছে, যা আদতে চরম উপেক্ষিত সংবাদ। ‘দি ইনডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার প্রথম পাতায় সৌমিত্রের শবযাত্রার ছবি ছাপা হয়েছে, চার কলামের শিরোনামে লোয়ার ফোল্ডে লেখা হয়েছে From the older Apu to sunny Feluda, Ray’s go-to actor to our everyman’। ‘দি হিন্দুস্থান টাইমস’র এঙ্করে রয়েছে সৌমিত্রের সংকীর্ণ উপস্থাপন। যেন ভাসুরের নাম মুখে আনার মতো কিংবা নম নম করে বাম হাতে চাঁদ সওদাগর যেন মনসা পূজা দিচ্ছে একান্ত বাধ্য হয়ে- Bengali cinema losses one of its all time greats’! এই শিরোনামে রয়েছে বাংলাকে মূলধারা থেকে উপেক্ষা করার প্রবণতা। সৌমিত্রকে ‘অল ইন্ডিয়া’র কাছে আপন না করে ‘বাঙালির লস’ বলে ছোটই করা হয়েছে কার্যত! ‘মিন্ট’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার এঙ্করে সাদামাটা ভাবে সৌমিত্রের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে। অথচ তার উপরে রয়েছে রয়েল এনফিল্ড মোটর বাইকের নতুন মডেলের বাজারমাত করার খবর! ভারতীয় সিনেমাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে যিনি তীব্র গতিতে ধাবমান অভিনেতা ছিলেন, সেই সৌমিত্র আজ নতুন মডেলের বাইকের গতির কাছেও উপেক্ষিত সংবাদ উপস্থাপনায়।

সবশেষে একটি ব্যতিক্রম ও নিন্দনীয় উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই। সারাজীবন যে বাম আদর্শের চর্চা করেছিলেন সৌমিত্র, সেই বামেদের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পুরো প্রথম পৃষ্ঠায় সত্যজিৎ বন্দনা করেছে, অসম্ভব সৃজনশীল অনবদ্য দুটি শব্দে ব্যানার লিড করেছে ‘সৌমিত্র সমাপ্তি’। ‘সমাপ্তি’ সৌমিত্রের ঐতিহাসিক সিনেমা, তাই সৌমিত্রের শারিরীক সমাপতনকে ‘সমাপ্তি’ রূপকে তুলে ধরা হয়েছে। কায়দা করে সমাপ্তি শব্দকে ‘ধুসর’ করে রাখা হয়েছে, পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে শোক ও নান্দনিকতা আছে। সব আছে কিন্তু ছিলো না আক্কেল! সুন্দরীরা বেয়াক্কল হলে যা হয়, গণশক্তি তাই হলো। সৌমিত্রের পৃষ্ঠাসজ্জায় পাঁচটি স্যান্ডেল শোভা (ডিসপ্লে এড) পাচ্ছে বিজ্ঞাপন হিসেবে। আমরা জানি, বিজ্ঞাপন ছাড়া পত্রিকা অচল, কিন্তু কালজয়ী শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তির মৃত্যুর পরদিন লিড বিজ্ঞাপনে পাঁচটি ‘ফুল না হয়ে’ পাঁচটি স্যান্ডেল ‘কাঁটা হয়ে বেশ’ রয়েছে। যে সৌমিত্রের একটি ঐতিহাসিক সংলাপ ছিলো ‘পাঁচ ভাই এক সাথ, মারছে ঘুসি খাচ্ছে ভাত, আরও পাঁচ সাথে তার, কেমন আছেন নমস্কার’ সেই সৌমিত্রের মহাপ্রস্থানে পাঁচটি স্যাণ্ডেল! হরি হরি!

ভারতের খবর শেষে এবার নিজেদের খবর বলি। ওপার বাংলার সাথে মিল রেখে এপার বাংলার মূলধারার সবকটি পত্রিকাই দিনের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ খবর করেছে সৌমিত্রের মহাপ্রয়ানকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত পত্রিকা দৈনিক ‘প্রথম আলো’ তার প্রথম পাতায় বক্স স্টোরি করেছে নায়িকা ববিতার স্মৃতিচারণায় ‘প্রকৃত নক্ষত্রের মৃত্যু নেই’ শিরোনামে, সাথে রয়েছে সৌমিত্রের হাসিমাখা প্রাণবন্ত একটি ছবি। এছাড়াও রয়েছে আরো একাধিক লেখার আয়োজন। ‘কালের কণ্ঠ’ প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকের বিশেষ কলাম ছাপা হয়েছে তিন কলামজুড়ে ‘অপুর পাঁচালী’ শিরোনামে। এখানে একটি নিজস্ব প্রতিবেদন ছাড়াও বাংলাদেশের চিত্রনায়িকা ববিতার স্মৃতিচারণ রয়েছে প্রথম পাতায়। ‘সমকাল’র প্রথম পাতার বক্স স্টোরি ছাপা হয়েছে তিন কলামের ‘কিংবদন্তীর অনন্তযাত্রা’ শিরোনাম দিয়ে। ববিতা এই পত্রিকায়ও শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছেন ‘অভিনয়ের বটবৃক্ষ’ শিরোনামে। ‘ইত্তেফাক’র প্রথম পাতায় বিশেষ মর্যাদা দিয়ে দুই কলামের শিরোনাম করা হয়েছে ‘বিদায় সৌমিত্র’। ‘আমাদের সময়’ প্রথম পাতায় বক্স স্টোরি করেছে চার কলামজুড়ে, এর মধ্যে তিন কলামের শিরোনাম ‘সৌমিত্র অধ্যায়ের অবসান’। ববিতা যথারীতি এখানেও সৌমিত্র স্মরণে লিখেছেন। ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার’ ডাবল কলাম বক্স স্টোরি করেছে ‘The last of the legends bows out’, এই সংবাদের সাথে ‘বেলাশেষে’ সিনেমায় সৌমিত্রের একটি প্রাণবন্ত ছবি ছাপা হয়েছে।

সংক্ষেপে এটাই ছিলো এপার বাংলা, ওপার বাংলা এবং অল ইন্ডিয়া সংবাদপত্রের প্রথম পাতার চেহারা। লেখাটি লিখতে লিখতে হোয়াটসএপে কথা হচ্ছিলো কলকাতার বন্ধু সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে। সাদ্দাম হোসেন পশ্চিমবাংলার বিখ্যাত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাজী নগর কলেজের গণজ্ঞাপন ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। ভারতীয় বাঙালি তরুণ তুর্কি সাদ্দাম বিশ্বভারতীর গ্রাজুয়েট। দুই বাংলার তরুণ সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক পরিসরেও বেশ জনপ্রিয় মুখ তিনি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দাদা, আজকের একসেট পত্রিকা আমার জন্য রেখে দিতে পারবেন? করোনা শেষে কলকাতা এলে আমি এগুলো হাতে নিয়ে দেখতে চাই’। তিনি স্বভাবসুলভ আন্তরিকতা নিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই, কেন নয়?’ আমি বললাম, ‘কেন আজ সৌমিত্র মূলধারায় সংবাদপত্রে উপেক্ষিত’? তিনি বললেন, ‘একটা ইগো তো কাজ করেই, বুঝেন সব’। হ্যাঁ, সত্যিই বাংলার প্রতি, বাঙালির প্রতি একটি ইগো রয়েছে মারোয়ারি-বারোয়ারি-বলিউডের। 

সাংবাদিক ও ব্লগার ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ গতকাল লিখেছেন ফেসবুকে, ‘বাঙালি এবার বলিউড নিয়ে আদিখ্যেতাটা বন্ধ করুক৷ এবার একটু কম 'আঞ্চলিক' হয়ে বেশী 'মেনস্ট্রিম' যা কিছু আছে তার দাবিদার হোক। নাকউঁচু হোক, নিজের ঐতিহ্য নিয়ে অহংকারী হোক। নিকারাগুয়ায় মুদ্রাস্ফীতি হলেও যে বাঙালি হেদিয়ে হ্যারিকেন হাতে মিছিল করে, সে এবার নিজেরটা বুঝতে শিখুক। নিজের সম্পদগুলো জাহির করতে শিখুক। হ্যাঁ, নিজের ঢাক নিজের পেটানো পুজো বাদেও প্র‍্যাক্টিস করুন। এতে আখেরে বাংলারই লাভ। বলিউডের এই বাঁহাতে নমঃ নমঃ করে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ঢংটা মোটেও ভালো না। যে ভদ্রলোক আজ মারা গেলেন তিনি 'হাউসফুল','ওম শান্তি ওম' বা 'দাবাং' এ অভিনয় করেননি বলে তিনি পাতে দেওয়ারও যোগ্য না, এই আবোদা বিদ্বেষবাদ উচ্চস্বরে নস্যাৎ করার সময় এসেছে। ওই যে বললাম নিজের ঢাক নিজের পেটানোর সময় এসেছে। কোন মহারথি, আমির ও ওমরাহর টুইট পেলাম না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহা-প্রয়াণে।’

সত্যিই, বলিউড কী জিনিস, বুঝো বাঙালি বুঝো! ভারতীয় মূলধারার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার তলানিতে সৌমিত্রের খাবি খাওয়া দশা যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে সৌমিত্র কেবল দশতলা ভবনের ‘নিচুতলার ভাড়াটিয়া’! সৌমিত্রের মহাপ্রস্থানের চারঘণ্টা পর বলিউডের নামিদামি তারকাদের টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং ফেসবুকে হীরন্ময় নীরবতা দেখেও কিছুটা অবাক হয়েছি। এসব দেখেও কি বাঙালি বলিউডের কাঙাল থাকবো আমরা? সাধে কি আর নিরোদ সি চৌধুরী লিখেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’! হ্যাঁ, ভারত রাষ্ট্রের মূলধারার বলিউড ভারতীয় কেন্দ্রীয় লগ্নি পুঁজির পাহারাদার। সেক্স, ভায়োলেন্স আর মিথলজি ছাড়া তার আর কিছু দেয়ার নেই। বলিউড চরিত্রের বিপরীতে পশ্চিমবাংলার এক বাঙালিবাবু বুদ্ধিদীপ্ত-মেধাবী চরিত্র নিয়ে বিকশিত হয়েছেন সৌমিত্র! তাই বুঝি ভাসুরের নাম মুখে আসছে না তাঁদের।

আলোচনাটি শুরু করেছিলাম ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার একটি সংলাপ দিয়ে। শেষ করবো সোনার কেল্লার সংলাপ দিয়ে। সোনার কেল্লায় শেষ দৃশ্যে মুকুল বলে, ‘এটা ময়ূর, আমি ময়ূর দেখেছি। এটা উট, আমাদের বাড়িতে উট ছিল। এটা আমার বাড়ি, আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার বাড়ির সামনে। এটা যুদ্ধ হচ্ছে, আমি যুদ্ধ দেখেছি। আর এটা কেল্লা, সোনার কেল্লা।’ এসব সত্য নয়, কারণ শিশু মুকুল এসব মোহে বা কল্পনায় বলতো। তখন ফেলুদা তার মোহভঙ্গ ঘটায়। সিনেমার শেষে মুকুল নিজের ভুল বুঝতে পারে। মোহভঙ্গের পর মুকুলকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জানায় সোনার কেল্লা নয়, সে বাড়ী যেতে চায়। ফেলুদা জানান, সোনার কেল্লা বলে কিছু নেই। থাকলেও সেখানে রত্ন নেই। ছিলোনা কোনোদিন। ফেলুদা মুকুলকে উদ্দেশ্য করে আসলে দর্শকদেরই বলেন ‘গুপ্তধন নেই। পূর্বজন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই।’ আজ সেই ফেলুদা মরে গিয়ে প্রমাণ করলেন, বলিউডের কাছে, ভারতীয় মূলধারার কাছে ‘বাঙালি মহাতারকারা নেই’। থাকলেও তাকে সেভাবে উপস্থাপন করা হবে না। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যেন ‘মগনলাল মেঘরাজ’। আরামের বিছানায় শুয়ে ফেলুদাকে তাচ্ছিল্য করে বলছে- 'ইয়ে সোমিত্র? ইয়া কউন হ্যায়? বাংগাল! আপনি বড় স্টার কিভাবে হোলেন মিসটার মিটার? হামার লোকেরা আছে বলিউডে, ‍ওরা সব কাজ কোরে দিবে।’ পশ্চিমবাংলার মিডিয়া যেন উচিত জবাব দিয়ে বলছে, ‘আমি ঘুষ নিই না মগনলালজী’। হ্যাঁ, বলিউডের ‘কানার হাটবাজা’র দেখে বাঙালির সাংবাদিকদের বোধহয় সময় এসেছে ফেলুদার মতো চোয়াল শক্ত করে মুম্বাই-দিল্লীর আধিপত্যকে বলার- ‘হয় আমি এর বদলা নেব, না হলে গোয়েন্দাগিরি (পড়ুন: সাংবাদিকতা!) ছেড়ে দেব।’
 
লেখক: রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভারতের গণমাধ্যম গবেষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক’ এবং দুই বাংলার গণমাধ্যম, গণপিটুনি এবং জনসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ইমেইল: [email protected]

কৃতজ্ঞতা: এই লেখায় লেখককে তথ্য বিশ্লেষণ ও সংবাদপত্রের প্রথম পাতা গ্রাফিক্স ডিজাইনে সহযোগিতা করেছেন তার গবেষণা সহকারী, চবি যোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সম্মান চূড়ান্ত পর্বের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ নঈম উদ্দীন। নঈম উদ্দীন ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্কেরও সহ-সমন্বয়ক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank