শিক্ষক নিগ্রহ: শ্রেণিকক্ষে দূরত্ব ও সন্দেহের পরিবেশ
শিক্ষক নিগ্রহ: শ্রেণিকক্ষে দূরত্ব ও সন্দেহের পরিবেশ
একুশ বছরের শিক্ষকতা জীবন তার। দীর্ঘ এই শিক্ষকতা জীবনে তার কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করে অনেক শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই নানা ক্ষেত্রে উচ্চতর অবস্থানে আসীন। শিক্ষার্থীদের তরে জীবন সঁপে দেওয়া কোন শিক্ষকের জীবন যদি এমন দুর্বিষহ হয় তবে নিশ্চয়ই ভালো লাগার কথা না তার। কষ্টকঠিন জীবনের মুখোমুখি এখন হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ের শিক্ষক তিনি। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতি তৈরি করে তার এবং পরিবারের জীবনকে বিষিয়ে দিয়েছে তার শিক্ষার্থীরাই। এমনটা প্রাপ্য ছিল তার, এমনটা প্রাপ্য থাকে না কারও।
যারা তার জীবনে এমন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে তারা তারই শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী বলতে সকল শিক্ষার্থী নয়, কিছু শিক্ষার্থী। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে হাজার-হাজার শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখানো শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের জীবনে ঘোর অমাবস্যা নামিয়ে এনেছে কতিপয় কিশোর। তারা নিশ্চয় একা নয়, এদের সঙ্গে আছেন হয়তো আরও কেউ, অথবা একাধিক। এক হৃদয় মণ্ডলের জীবনকে দুর্বিষহ করে তারা আদতে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে সারাদেশের লক্ষাধিক শিক্ষকের জীবন, শ্রেণিকক্ষে তৈরি করে দিয়েছে সন্দেহের পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে এঁকে দিয়েছে শক্ত এক দেয়াল। এই সন্দেহ, এই দেয়াল ভেদের সাধ্য আমাদের হবে কি-না প্রশ্ন। এমন অবস্থায় হুমকির মুখে কি পড়ছে না দেশের ভবিষ্যৎ, শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক?
আমরা আলোচনা করছি ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ পরিচিত নিগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে। কিন্তু এই পথ ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার যে দূরত্ব সৃষ্টি করে সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করব? কিশোর বয়েসি শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষকের প্রতি এভাবে আগ্রাসী হবে? অসম্মান করতে, ফাঁসিয়ে দিতে কেন বক্তব্য রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে, কেন মিছিল করবে, একজন শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে স্কুল প্রাঙ্গণসহ কেন এলাকায় মিছিল হবে, কেন বহিরাগতরা মিছিলে অংশ নেবে? এই অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয় কি একদিনে ঘটল? কেন আমরা সচেতন হইনি এতদিন কিশোর বয়েসিদের মানসিক বিকাশে, মানবিক ও নৈতিক শিক্ষায়? এজন্যে দায়ী কে? কেবল ওই কিশোরেরা?
একপাক্ষিকভাবে ‘ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতকে’ আলোচনা করা ঠিক হবে না। এমন আলোচনা সবসময়ই করে থাকি আমরা। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে আমরা আলোচনা করে থাকি, সহিষ্ণু পরিবেশ সৃষ্টির তাগাদা দিই, কিন্তু ফল কি মিলছে? মিলছে না, কারণ আমাদের উদ্বেগ, আলোচনা বিষয়ভিত্তিক। ফলে সমস্যার অতলে পৌঁছার চাইতে সাময়িক সমাধানে সন্তুষ্ট হই। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেখানেই থাকে, বরং সাময়িক বিরতি দিয়ে ফের একইধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। পুনরাবৃত্তির এ চক্রে হতাশ হই, ঘরে ফিরি। এটা কি সমাধান? নিশ্চয়ই নয়!
ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের বিষয়টি এতখানি সংক্রামক ও গুঁজবনির্ভর যে সত্যাসত্য যাচাইয়ে কেউ আগ্রহ দেখায় না। এটা কথিত সংক্ষুব্ধ পক্ষের যেমন, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রেও। হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের নিগ্রহের ঘটনায় একই পদ্ধতি অনুসরণ হয়েছে। কথিত ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের অভিযোগ ও মিছিল দেখে প্রভাবিত হয়েছে পুলিশ প্রশাসনও। তাই কিছু লোকের মিছিল ও মৌখিক অভিযোগের সূত্রে আটক করে নিয়ে গেছে থানায়। এরপর মামলার জন্যে অপেক্ষা করেছে। মামলা দায়েরের পর ওই স্কুলশিক্ষককে সেই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।
পুলিশ এখানে ভিক্টিমকে সহায়তা করেনি, বরং তারা ওই অপরাধের অদৃশ্য সহযোগী হয়েছে। তদন্তের আগেই আটক করেছে, হেফাজতে নিয়েছে এবং মামলার পর গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাদের, অথচ তারা আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কিছুতে আগ্রহ দেখায়নি। হঠাৎই অসহায় হয়ে পড়া একজন স্কুলশিক্ষকের প্রতি আরও বেশি কঠোর হয়েছে। অথচ এখানে তারা তাকে রক্ষা করতে পারত। থানা পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসনের শক্তি-সামর্থ্য কম থাকাটা স্বাভাবিক, তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন উচ্চপর্যায়ের সহযোগিতা নিতে পারত। তারা কিছুই করেনি। ফলে কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়েছে, মাথায় তোলা হয়েছে। পুলিশ দায়িত্ব সেরেছে স্কুলশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে আটক করে নিয়ে গিয়ে। এটা চূড়ান্ত রকমের অপেশাদারিত্ব, দায়িত্বে অবহেলা। পুলিশের পরিচিত এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে একজন স্কুলশিক্ষককে, শিক্ষকসমাজকে; শিক্ষাব্যবস্থাকেও।
ধর্ম অবমাননার অপরাপর ঘটনা আর মুন্সিগঞ্জের ঘটনাকে এক করে দেখার অবকাশ নাই। এই ঘটনার প্রভাব ব্যাপক। এটা কেবল ধর্মীয় অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এর মাধ্যমে দেশের শিক্ষাঙ্গন, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যেও প্রভাব পড়বে। শ্রেণিকক্ষে সন্দেহের একটা পরিবেশ তৈরি হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা মন খোলে শিক্ষাদান করতে পারবেন? কারণ এ ঘটনা শিক্ষকের মধ্যে এই বার্তা দিচ্ছে যে অভিযোগ উঠলে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে, মামলা হবে, আদালতেও সহজে মিলবে না জামিন! এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন এক অবস্থা তৈরি হয়ে গেছে।
মুন্সিগঞ্জের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া দরকার। এইধরনের ঘটনার পর পরই পুলিশ প্রশাসন যাতে ‘পরিস্থিতি সামাল দিতে’ এমন কিছু না করে যা স্কুলশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ভাগ্যে ঘটেছে। কারণ একবার পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার পর আদতে কথিত ধর্মীয় অনুভূতির দাবিদাররাই জয়ী হয়। মুন্সিগঞ্জে তারা জয়ী হয়েছে। সারাজীবনের জন্যে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে গেছেন স্কুলটির বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। স্কুলশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের এমন পরিণতিতে হারতে বসেছে পুরো দেশের শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ, ভূলুণ্ঠিত হয়েছে শিক্ষক নামের পেশার সম্মান, সন্দেহের মুখে পড়ে গেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ