শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মাস্ক এখন মাস্ট

শেখ আনোয়ার

১৭:৫২, ৯ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৮:২১, ৯ নভেম্বর ২০২০

১১৫৬

মাস্ক এখন মাস্ট

রাস্তায় বেরুলে মনে হয় দেশে করোনা বলতে কিছুই নেই। বহু লোকেই মাস্ক ছাড়া দিব্যি কেনাবেচা করছে। সংক্রমিত হবার ঝুঁকি থাকলেও লোকে মাস্ক পরতে চায় না। বাংলাদেশের মানুষ অজুহাত মাস্টার। বলে, মাস্ক পড়লে চশমা ঘোলা হয়, কথা বুঝতে অসুবিধা। আর গরম লাগার অজুহাত তো রয়েছেই। মাস্ক অনেকেরই ঝুলছে থুতনিতে। কখনও কানের পাশে। কখনও আবার নাকের নীচে। কারও পকেটে। কারো মাস্ক দেখা যায় একপাশ থেকে খোলা। কান থেকে ঝোলা। অথচ মাস্ক ব্যবহারের প্রথম শর্ত হলো, নাক এবং মুখ ঢেকে রাখতেই হবে। এইটুকু শর্ত পালনই যথেষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাক-মুখ ঢাকা না থাকলে মাস্ক পরে আত্মপ্রসাদ লাভ হতে পারে। কিন্তু তাতে উপকার চার আনাও মিলবে না। আর তাই, বাড়ির বাইরে যতক্ষণ থাকছেন, ততক্ষণ মাস্ক থাকবে নাক ও মুখের উপর। পকেটে বা থুতনিতে মোটেই নয়।

মাস্ক কেনো দরকার?
কথা বলার সময়, হাঁচি, কাশির সময় মুখ-নাক থেকে বেশকিছু তরলবিন্দু বেরিয়ে আসে। এই তরলবিন্দুকে বলে ড্রপলেট। মুশকিল হলো, একজন করোনা আক্রান্তের ড্রপলেটে থাকে ভাইরাস। আক্রান্ত মানুষটা কথা বললে, হাঁচলে বা কাশলে ড্রপলেট বের হয়। যেগুলো বাতাসে ৩-৪ ঘণ্টা ভেসে থাকতে সক্ষম। সেই ড্রপলেট কোনও সুস্থ্য ব্যক্তির নাক, মুখ, চোখ হয়ে শরীরে প্রবেশ করলেই বিপদ! তখন সুস্থ্য মানুষটার দেহের অন্দরে প্রবেশ করে করোনাভাইরাস। মানুষটা করোনায় আক্রান্ত হন। অথচ মাস্ক পরলে মাইক্রো-ড্রপলেট থেকে রক্ষা পাবার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। ভাইরাস ঠেকাতে মাস্ক তাই অন্যতম এক পরিধানের অনুষঙ্গ। সংক্রমিত ব্যক্তি ঠিকঠাক ভাবে মাস্ক পরলে, তার নাক, মুখ থেকে ড্রপলেট বেরুলেও মাস্ক আটকে দেয়। আক্রান্তের কাছাকাছি চলে আসা সুস্থ্য মানুষের পক্ষে তখন রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এই মাস্ক। অন্যদিকে একজন সুস্থ মানুষ মাস্ক পরলে একইভাবে করোনা আক্রান্তের মুখ-নাক নিঃসৃত ড্রপলেট হুট করে তার শরীরে ঢুকতে পারে না। সংক্রমণের আশঙ্কাও কয়েকগুণ কমে। এখন এটাও জানা, উপসর্গ দেখা দেয়ার আগে থেকেই সংক্রমিত ব্যক্তি ভাইরাস ছড়াতে পারেন। তাই মাস্ক পরা থাকলে আপনি কাউকে সহজে সংক্রমিত করতে পারবেন না। তিনিও আপনার শরীরে সংক্রমণ ছড়াতে ব্যর্থ হবেন।

মাস্ক কি করোনা রুখতে পারে?
গবেষকরা জোর গলায় বলেন, ‘জী হ্যাঁ পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারে। তবে সঙ্গে চাই বাকি প্রোটোকল মেনে চলা।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ‘তিনটে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ যা বিশ্ববাসীকে মেনে চলতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হলো মাস্ক পরা। অন্য দু’টো হলো, সামাজিক, শারীরিক দূরত্ব এবং নিয়মিত হাত ধোয়া নয়তো যথার্থ স্যানিটাইজারের ব্যবহার।’ ল্যানসেটের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, ‘মাস্ক পরা, চোখকে সুরক্ষা দেয়া ও ঠিকঠাকভাবে শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখতে পারলে করোনা সংক্রমণ হওয়ার হার হ্রাস পেতে পারে।’ মোট জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ সিঙ্গাপুরবাসী নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করছেন। স্পেনে ৯০, থাইল্যান্ড ৮৮, হংকং ৮৬, জাপান ৮৬ শতাংশ মাস্ক ব্যবহার করে। চীনে করোনা নেই। তবুও এখনও ৮০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরে তবেই ঘরের বাইরে বেরোচ্ছে। চীনের সর্বত্র, এমনকী আনাচে-কানাচেও মানুষের শৃঙ্খলাবোধ, আত্মসংযত মনোভাব, অনুশাসন দৃষ্টান্তমূলক। পুলিশের ডান্ডা, প্যাদানি, খোঁচানি দিয়ে এমনটা শেখানো যায় না। 

বাইরে পা দিলেই জরুরি মাস্ক 
বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত্র রোগীরা উপসর্গহীন। এদের শরীরে ভাইরাস বাসা বাঁধলেও রোগ লক্ষণ ফুটে ওঠে না। মুশকিল হলো, এরা কিন্তু অন্যের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে দিতে পারে। রোগ লক্ষণ থাকে না বলে এদের চিহ্নিত করাও কঠিন। আপনি বুঝতেও পারবেন না, সামনের মানুষটা উপসর্গহীন কি না! এই সমস্যা সমাধানে বাড়ির বাইরে পা দিলেই মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি। সাম্প্রতিক নতুন কিছু গবেষণাতে মাস্ক পরার উপকারিতার প্রমাণ মিলেছে। বলা হয়েছে, মাস্ক সংক্রমণের মাত্রা কমাতে পারে। ‘ফেসমাস্ক পরলে শরীরের ভেতর হয়তো অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোন উপসর্গ দেখা যাবে না।’ তার মানে, তারা যদি প্রকাশ্য স্থানে অন্য মানুষদের সংস্পর্শে আসেন বিশেষ করে বাস-মিনিবাস- ট্রেনের মত গণপরিবহনে যাতায়াত করার সময় অন্যদের কাছাকাছি আসেন। তাহলে অন্যদের সংক্রমিত হবার ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। 

মাস্ক মানে ওষুধ
মাস্কই হলো করোনা থেকে বাঁচার অন্যতম পথ। করোনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাইরাস কোনো ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করলে ওই ব্যক্তি সংক্রমিত হন। তার আগে নয়। এই মুহুর্তে সকলেরই বোঝা দরকার, মাস্ক হলো এমন একটা ওষুধ, এমন একটা ভ্যাকসিন যা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে রুখে দেয়া যায় করোনা। নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরে থাকলে ভাইরাস থেকে যেমন নিজে সুরক্ষিত থাকা যায়, তেমনই অন্যকেও সংক্রমিত করার অপরাধ থেকে বাঁচা যায়। মাস্ক পরা অবস্থায় সুস্থ ব্যক্তি করোনা সংক্রমিতের কাছে গেলেও সুস্থ ব্যক্তির শরীরে যে পরিমাণ ভাইরাস ঢুকতে পারে তা অধিকাংশক্ষেত্রেই ওই ব্যক্তিকে কাবু করার ক্ষমতা রাখে না। বরং মাস্কের মধ্য দিয়ে সামান্যতম ভাইরাস ঢোকার ফলে দেহে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তা পরবর্তী সময়ে প্রায় ভ্যাক্সিনের মতো কাজ করে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অভিমত। তাই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা আত্মহত্যার শামিল। কোন কারণে দূরত্ব হয়তো সবসময় মানা সম্ভব হয় না। বাঁচার একমাত্র উপায় চোখ, নাক, মুখ ঢেকে রাখা। এতে মুখোমুখি হলে মাস্কই বাঁচাবে। মাস্ক পরার অর্থ নিজেকে বাঁচানো এবং রোগ না ছড়ানো।

নো মাস্ক, নো সার্ভিস 
বাংলাদেশ এ মুহুর্তে করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় দফা সংক্রমণের আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞরা সাবধান করছেন। আবহাওয়া একটু ঠান্ডা হলেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বেশি হবে। যদি তাই হয় তাহলে শীতকালে আমাদের দেশে ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাবে। শীতে দ্বিতীয় ঢেউ এলে সেক্ষেত্রে প্রায়শ্চিত্তটা নিদারুণ হবে। ইতোমধ্যে ভ্যাক্সিন হিরো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশ দিয়েছেন, ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি কোনো অফিসেই মাস্ক ছাড়া কেউ ঢুকতে পারবে না। কোনো সেবাও পাবে না।

মাস্ক এখন মাস্ট কেনো?
গবেষকদের আশংকা, আসছে শীতে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে গুরুতর অসুস্থ রোগীর সংখ্যা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর নেমে আসতে পারে অসম্ভব চাপ। স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা শুরুর দিন থেকেই টানা লড়াই করতে করতে ক্লান্ত। রোগীর সংখ্যা হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলে আহত যোদ্ধা দিয়ে যুদ্ধ জেতা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এই সঙ্কট থেকে বাঁচতে গেলে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে সচেতনভাবে বাইরে বেরিয়ে মাস্ক পরতেই হবে। নিজের পাড়ায় রয়েছি বলে করোনা হবে না, এমনটা কিন্তু নয়। তাই পাড়ায় আড্ডায় বসলেও মাস্ক পরতেই হবে। পাশাপাশি আড্ডার আবহেও অবশ্যই মানতে হবে শারীরিক দূরত্ব। নিজে মাস্ক পরলে সুরক্ষা মেলে। তবে সামনের ব্যক্তিটা মাস্ক পরে থাকলে সুরক্ষাবলয় আরও দৃঢ় হয়। তাই মাস্ক নিজে পরুন। অন্যকে পরতে উৎসাহিত করুন। সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে কোনওভাবেই মাস্ককে হেলাফেলা করা চলবে না। নইলে তার ফল হবে মারাত্মক।

মাস্ক পরায় হেলাফেলা নয়
যদিও পরিসংখ্যান বলছে, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সুস্থতার হার বেশি। মৃত্যু হার কম। তবুও বিপুল জনঘনত্বের দেশে মানুষ একবার রাস্তায় বেরুলে গায়ে গায়ে ঠেসাঠেসি অনিবার্য। পেট বড় দায়। সংক্রমিত হবার ঝুঁকি রয়ে যায়। পাশাপাশি  অপ্রয়োজনীয় ঘোরাফেরাও হচ্ছে প্রচুর। বেড়েছে ছোটখাটো অনুষ্ঠানাদি, আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা। বাস বা অন্যান্য যানবাহনে গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। হাট-বাজারে মানুষ গাদাগাদি করে কেনাকাটা করছে। রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দিচ্ছে। দেখা যায়, বেশির ভাগ মানুষ মুখে মাস্ক পরছে না। সরকারিভাবে সতর্ক করা হচ্ছে, ‘করোনাভাইরাস সংক্রমন রোধে ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বার বার করে বলে আসছে, ‘মাস্ক পরলে 'জীবাণু’র ড্রপলেট থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব।’ বিজ্ঞানীরাও দাবি করছেন, ‘করোনা বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়।’ তাই মাস্ক ব্যবহারে আর হেলাফেলা নয়। মাস্ক এখন অতি দরকার। 

মনে রাখতে হবে, করোনায় আক্রান্ত কোনো রোগীর মুখের লালা রস বা কোনো সংক্রমিত এলাকার সংস্পর্শে এলে অন্য মানুষ সংক্রমিত হবেন। এতে কোনো রেহাই নেই। এক্ষেত্রে মাস্ক পরা থাকলে চট করে কোনো সুস্থ মানুষের নাকে বা মুখে আক্রান্তের থুতু যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মাস্ক পরলে অনেকটাই নিরাপদে থাকা যায়। মাস্কের সাহায্যে অনেক দেশই সংক্রমণের হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। মাস্ক পরার ফলে সংক্রমণ বেড়েছে, এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। 

ফুল খেলার দিন আজ নয় হে প্রিয়। আজ এই বোধ নিয়ে বাঁচাই শ্রেয়। স্থগিত থাকুক বনলতার মুখোমুখি বসিবার ক্ষণ। চাপা থাকুক, শ্রাবস্তীর কারুকার্য, মাস্কের আড়ালে মোনালিসার হাসিমুখ।

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank