শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

হীরেন পণ্ডিত

১১:১৮, ২ মার্চ ২০২২

আপডেট: ১১:১৯, ২ মার্চ ২০২২

৮৬৭

নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারও। ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজার। চাল-ডাল-তেল-চিনি সবকিছুর দাম এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের। এ অবস্থায় সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকে নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও ভিড় জমাচ্ছেন। কোভিড-১৯ মহামারির একের পর এক ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষেরা যখন অসহায়ত্বের চরমে শিখরে পৌঁছেছেন। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি তাঁদের কষ্ট আরো একটু বাড়াচ্ছে। ফলে প্রতিদিনের ব্যয় নির্বাহ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য।

করোনা মহামারির অভিঘাতে বিপর্যস্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ এমনিতেই প্রবল আর্থিক অভাব-অনটনের মধ্যে রয়েছেন। সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৫.৮ শতাংশ। কিন্তু নিত্যপণ্যের বেপরোয়া মূল্যবৃদ্ধি বাস্তবে মূল্যস্ফীতির এই হিসাবের তুলনায় বহুগুণ বেশি। সরকারি সংস্থা টিসিবির বাজার দামেই দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় চালের দাম গড়ে ৩১ শতাংশ, ময়দা ৩৩, সয়াবিন তেল ৪৫, চিনি ৫০ ও মশুর ডাল ৩০ শতাংশ বেড়েছে। রান্নার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, বাড়তে চলছে পানি ও বিদ্যুতের দাম। একদিকে নিশ্চিত দামবৃদ্ধি অন্যদিকে অনিশ্চিত আয়ে সাধারণ মানুষের জীবন এখন দিশেহারা। কঠিন এই বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত কী করে টিকবে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আবারো খুঁজতে হবে। কোভিডের কারণে চাকরিচ্যুতি নিয়মিত বেতন-ভাতা না পাওয়া এসব সমস্যা তো রয়েছেই। এঁদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। তাহলে সংকট উত্তরণের কী উপায়? কোভিড-১৯ সংক্রমণজনিত এ সংকটকালীন সময়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সার্বিক সুরক্ষা ও জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জনবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। 

জীবনযুদ্ধের এক কঠিন সময় পার করছি আমরা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকেই। এই সংকট শুধু বাংলাদেশেরই নয় গোটা বিশ্বেরই। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলওর সর্বশেষ রিপোর্টে যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে তো সংকট আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোড়া। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ দিশেহারা। অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে অভিয়োগ আছে।

সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে মানুষ ভিড় করেন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের সামনে। কিন্তু সেখানেও কি শান্তি আছে? সেখানেও বিড়ম্বনা। ভিড় বাড়ায় পণ্য কিনতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার পণ্যের সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় মুহূর্তেই খালি হয়ে যায় টিসিবির পণ্যবোঝাই ট্রাকগুলো। ফলে অনেককে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। তুলনামূলকভাবে টিসিবির ট্রাকে সাশ্রয়ী দামে পণ্য কিনতে পারায় সেখানেই ভিড় করেছন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন। 

এদিকে টিসিবির ডিলাররা সরবরাহ কম থাকার কারণে সঠিকভাবে লাইনে দাঁড়ানো সবার কাছে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব না হচ্ছে না বলে দাবি করা হয়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন টিসিবির প্রায় ১৭০টি ট্রাক পণ্য সরবরাহ করে। টিসিবির ট্রাকের সামনে কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে আসত শুধু নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তারা পেশায় কেউ ছিলেন দিনমজুর, কেউ রিকশা বা গাড়িচালক, কেউ গৃহকর্মী। কিন্তু এখন সেই লাইনে পণ্য কিনতে ভিড় করছেন মধ্যবিত্তরাও। 

মহামারি করোনার কারণে দেশে বহু মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর প্রভাব সরাসরি আমাদের অর্থনীতিতে পড়ছে। মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট এখন প্রকট। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম এখন মুখ্য। করোনাকালে উদ্ভূত জটিল এবং অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতিতে মহাসংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য তালিকা টানানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাজার মনিটরিং করা খুব জরুরি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরও একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে সরকারকে। 
করোনায় সরকারী প্রণোদনার সুফল সাধারণ মানুষ খুব একটা পায়নি। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস, তখন নিত্যপণ্যের বাজারেও যেন আগুন লেগেছে। সবকিছুর দামই বাড়তি। সরকারের উচিত আগে বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করা। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে ক্যাব ভোক্তা অধিকার কতটুকু সংরক্ষণ করতে পারছে, তা একটা বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসতে পারে। তাই সকলকে মিলেই এ বিষয়ে কাজ করা উচিত।

মধ্য মেয়াদে খাদ্য সরবরাহ ও দামকে প্রভাবিত করে এমন কিছু পদ্ধতিগত শক্তির বিপরীতে নীতিনির্ধারকরা সহজেই মজুদ এবং অনুমানের সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তবে এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই সমস্যা মেনে নিয়ে তা চিহ্নিত ও সমাধান করতে উদ্যোগী হওয়া চাই। 

মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে। বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৭ শতাংশ। দেশের জনগণের দৈনিক ক্যালরির ৭০ শতাংশের বেশি আসে এই চাল থেকে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে চাল উৎপাদন তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যপণ্যের, বিশেষ করে প্রধান খাদ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি দেশের স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। চালের মূল্যস্ফীতিকে তারা ভয় পান। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বাড়ছে সব পণ্যের দাম। বিশেষ করে দেশে নিত্যপণ্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। গত কয়েক মাস থেকে যা আশঙ্কা করা হচ্ছিল তাই হচ্ছে। গরিব ও অতি গরিব এক বিরাট জনগোষ্ঠীর খাদ্য সংগ্রহে আর্থিক সক্ষমতার অভাব এবং এর ফলে তাদের অপর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যে পুষ্টিমানের স্বল্পতা, নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এখনো কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। 

টিসিবির মাধ্যমে দেশের এক কোটি মানুষকে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, টিসিবির ট্রাক কেবল জেলা ও উপজেলা শহরকেন্দ্রিক হওয়ায় গ্রামের লোকজন এর বাইরে থেকে যাচ্ছে। ফলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের বড় অংশই সরকারের এই সেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অন্যদিকে, অল্পসংখ্যক ট্রাক এবং সারা দেশে চাহিদার তুলনায় অল্পসংখ্যক স্থানে এই সেবা দিয়ে কোনোভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বিশেষত করোনা মহামারীর কালে দেশে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বৃদ্ধির হিসাব আমলে নেওয়া দরকার। সেই বিবেচনায় বলতে হয়, মহামারীকালে একদিকে দেশে নতুন করে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলায় সরকারের কোনো বিশেষ পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, মহামারীর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে, সরকার যে সোয়া লাখ কোটি টাকার ওপর বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে সেসব আসলে কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছে, কিংবা এই প্রণোদনার সুফলভোগী কারা হয়েছে? একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিংবা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যেসব পরিসংখ্যান সামনে আসছে তার সঙ্গে এই দারিদ্র্য ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ? এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ মনোযোগের পাশাপাশি এর রাজনৈতিক অভিঘাত সম্পর্কেও সরকারের বিশেষভাবে সতর্ক থাকা দরকার। বিষয়টি নিয়ে ভাবনা জরুরি ও পদক্ষেপ গস্খহণ করা জরুরি।

হীরেন পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank