শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটেছে!

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

০৯:২৪, ৩০ নভেম্বর ২০২১

আপডেট: ১৭:৪৫, ৩০ নভেম্বর ২০২১

৮৯৪

সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটেছে!

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার ব্যালফোর (১৯০২-১৯০৫) অহঙ্কারের সঙ্গে বলেছিলেন, “আমি সংবাদপত্র পাঠ করি না এবং আমি কোনোকিছুই হারাইনি।” 

একশ’ পনেরো বছরের বেশি সময় আগেও সংবাদপত্রে পরিবেশিত খবরের সত্যতা নিয়ে সমাজে সন্দেহ ছিল। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতো যে সংবাদপত্রের কাজই হলো কোনো খবরকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, রঙ-রস যোগ করে -- সোজা কথায় অতিরঞ্জিত করে প্রচারের ব্যবস্থা করা। 

তবুও ওই সময়ে সমাজের একটি অংশ সংবাদপত্রে পরিবেশিত খবর বিশ্বাস করতো, প্রকাশিত মতামতের মধ্যে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখতে পেত। 

কিন্তু সময় বদলেছে। বিজ্ঞানের উন্নয়নের প্রতিটি ধাপের সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমেও পরিবর্তন এসেছে। রয়টার্স তাদের খবর সংগ্রহের জন্য কবুতর ব্যবহার করতো এবং সংগৃহীত খবর পৌঁছে দিত তখন বিশ্বের প্রধান নগরীগুলোর সংবাদপত্র অফিসে। টেলিফোন, টেলেক্স, ফ্যাক্স প্রাচীন নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। এখন বিশ্বের সকল অংশের মুহূর্তের তাবৎ সংবাদ মানুষের তর্জনীর অগ্রভাগে।  
   
সংবাদের সত্যতা নিয়ে যে সন্দেহ আগেও ছিল, এখন সেই সন্দেহ এত প্রকট হয়েছে যে প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমতে কমতে নেমে এসেছে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। অনেক নিষ্ঠাবান সাংবাদিক আছেন, যারা ক্রমহ্রাসমান আস্থা ফিরিয়ে আনতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছু করে উঠতে পারছেন না। তারা পদে পদে বাধার সম্মুখীণ হচ্ছেন। সমাজের মূল প্রতিষ্ঠানই হলো বিশ্বাস ও আস্থা। সরকার এবং মিডিয়া, যে দুটি প্রতিষ্ঠান সমাজকে এক করে রাখার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে, সেক্ষেত্রে দুটির ওপরই সমাজ যদি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে সমাজের প্রতিটি স্তরে অবক্ষয় রোধ করা অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হয় এবং বাংলাদেশে অবক্ষয়ের সেই বিপ্লব ঘটেই গেছে। 

সংবাদপত্র, অনলাইন মিডিয়া এবং রেডিও ও টেলিভিশনের খবর ও ভাষ্যের ওপর কতজন লোক বিশ্বাস করে? শুধু বাংলাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বেই সংবাদ মাধ্যমের ওপর থেকে ক্রমেই মানুষের আস্থা অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। প্রচলিত মিডিয়ার ওপর তো নেই-ই। 

যুক্তরাষ্ট্রে এলডারম্যান’স এর বার্ষিক ট্রাস্ট ব্যারোমিটার অনুযায়ী ৫৬ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন যে সাংবাদিকরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে লিপ্ত। তাদের মতে সাংবাদিকরা জেনে শুনে মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশন করেন। ৫৮ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেন যে, অধিকাংশ সংবাদ প্রতিষ্ঠান জনগণকে তথ্য দেওয়ার পরিবর্তে কোনো মতবাদ বা রাজনৈতিক অবস্থানের সমর্থনে খবর প্রচার করে। মাত্র ২৯ শতাংশ আমেরিকান সংবাদপত্র, টেলিভিশন বা রেডিও’র সংবাদ বিশ্বাস করেন। এ অবস্থাকে কেউ কেউ ভুল বা মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের সমস্যার চেয়ে আস্থার সংকট হিসেবেই দেখছেন। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো প্রচলিত সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপর মানুষের অনাস্থা সৃষ্টির কারণ হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করলেও দেখা গেছে যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পক্ষে সংবাদ মাধ্যমে বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারীদের মাত্র ১৩ শতাংশ এবং অষ্ট্রেলিয়ার ১৭ শতাংশ সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত খবরে বিশ্বাস করে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর কারণে বরং বিভ্রান্ত হয় বেশি। সংবাদ, শিরোনাম, পন্যের বিজ্ঞাপন ও বিনোদনের উপকারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত বেশি উঠে আসে যে বোধগম্য কারণেই এসবের ব্যবহারকারীদের পক্ষে কোনটা বিশ্বাসযোগ্য এবং কোনটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, তা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে ওঠে। 

সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওপর পাঠক ও দর্শক-শ্রোতার আস্থাহীনতার সম্ভবত বড় কারণ সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন দানকারী সরকার। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক-কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আদর্শ একটি মুখ্য বিষয় এবং অবশ্যই তা সরকারি দলের আদর্শের অনুবর্তী হতে হবে। এর সঙ্গে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে মালিকদের আদর্শের অনুকূলে উপযুক্ত সাংবাদিক নির্বাচনও জরুরী, যারা মালিকের স্বার্থের খেয়াল রাখবে এবং সরকার বা সরকারি দলের বিপক্ষে যায় এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকবে। 

রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিটি মানুষের অবশ্যই থাকবে এবং থাকা উচিত। সংবাদ প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারকরাও তাদের নিজস্ব নীতি স্থির করেন এবং তা অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। এতে কারও আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। আপত্তি তখনই ওঠে, যখন নীতি পক্ষপাতমূলক হয়ে ওঠে। পক্ষপাতও দোষনীয় নয়, যদি তা দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে হয়। পক্ষপাত একদেশদর্শী হলে তা সকলের জন্য বিপজ্জনক বার্তার ইঙ্গিত দেয়। 

আমাদের দেশে অনেক সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় নামের গা ঘেঁষে ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা থাকে ‘সত্যের সন্ধানে নির্ভীক,’ ‘মুক্তপ্রাণের প্রতিধ্বনি,’ ‘আমরা দেশ ও জনগণের পক্ষে,’ ‘অসংকোচে সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস,’ ‘শুধু দেশ বা জনগণের পক্ষে,’ ইত্যাদি। উদ্দেশ্যগুলো মহৎ হলেও কারও পক্ষে নির্ভীক হয়ে ও দুরন্ত সাহস প্রদর্শন করে সত্য প্রকাশ ও প্রচার করা সম্ভব হয় না। অদৃশ্য ইশারায় সব সাহস উবে যায়। কার ধড়ে কটি মাথা আছে? অতএব নীতি বিধৃত নীতির খোল-নলচে পাল্টে প্রতিধ্বনিত হয় কারও না কারও স্বার্থের বাণী।  

বিবিসি, এসোসিয়েটেড প্রেস, রয়টার্স, এএফপি’র মত আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রচার করে যে তাদের কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত নেই। তাদের বক্তব্য পুরোপুরি সত্য নয়, অর্ধসত্য। তারা যে সত্য প্রচারের ভান করে তা স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে সংবাদ বোদ্ধারা জেনেছেন। স্নায়ু যুদ্ধের পরও নতুন করে ‘ওয়ার অন টেরর’ এর নামে তাদের ভুল, পক্ষপাতদুষ্ট ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রচারের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার দৃষ্টান্ত দুই দশক আগে থেকে  দেখতে শুরু করেছে বিশ্বের পাঠক ও দর্শক-শ্রোতারা। 

সাদ্দাম হোসেনের ইরাকে ‘ওয়েপনস অফ মাস ডেসট্রাকশন’ (ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র) এর মজুতের কথা আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশের সরকারগুলো যত না প্রচার করেছে, তাদের দাবীর সত্যতা যাচাই না করে আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো ঢালাওভাবে তা প্রচার করে ইরাককে ধ্বংস করার অভিযান সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। 

বাইবেলের একটি বাণী হচ্ছে: “ঘৃণা সংঘাতকে উস্কে দেয়,’ এবং মুসলিম বিশ্বকে লক্ষ্য করে পরিচালিত পশ্চিমা জগতের ‘ওয়ার অন টেরর’কে সংবাদ মাধ্যমগুলো অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে বিশ্বব্যাপী ঘৃণার আবহ সৃষ্টি করেছে। 

সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠতার অভাব এখন সর্বব্যাপী, যে কারণে ভুল ও পক্ষপাতমূলক তথ্য পরিবেশনকে কেউ আর আপত্তিকর বা নীতি-গর্হিত বলে বিবেচনা করে না। এভাবেই ক্ষয়ে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো। অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রশ্ন ওঠছে যে অমরা কীভাবে আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা করবো?  

আমেরিকান সামরিক ইতিহাসবিদ ও খ্যাতনামা লেখক ভিক্টর ডেভিস হ্যানসন বলেছেন, “চলমান ঘটনা প্রচার করার অর্থে বোঝানো হলে প্রচলিত সংবাদ মাধ্যম এখনও বিদ্যমান। কিন্তু সংবাদের নিরপেক্ষ প্রকাশ বলতে একসময় আমরা যে সাংবাদিকতাকে বুঝতাম এটি সেই সাংবাদিকতা নয়। এখন সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটেছে, সংবাদ মাধ্যম বেঁচে আছে। --- আমরা কী কারণে বিশ্বাস করবো যে সাংবাদিকরা সহসা  নীতি, অবাধ অনুসন্ধান ও বাক স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন?”

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank