শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

অধিকারহরণ, শোষণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি ও উন্নয়নে বাধা

মো. শামসুর রহমান

২১:২২, ১২ অক্টোবর ২০২১

১০১৫

অধিকারহরণ, শোষণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি ও উন্নয়নে বাধা

শিক্ষার ধারণাগত সংজ্ঞায় বলা হয়ে থাকে শিক্ষা হলো ব্যক্তিগত বিকাশ ও সামাজিক উন্নয়নের শক্তিশালী মাধ্যম। শিক্ষা হলো একটি পদ্ধতিগত ও জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। ব্যক্তির মাঝে যে সুপ্ত প্রতিভা থাকে, তার মানসিক শক্তির বিকাশ ঘটানোই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। 

দার্শনিক প্লেটো শিক্ষাকে সনাক্ত করেছেন ন্যায় বিচার অর্জনের উপায় হিসেবে। তিনি বলেছেন, “শিক্ষা হলো ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায় বিচার উভয়ই অর্জনের উপায়”। অ্যারিস্টটল বলেছেন, “সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরির নামই শিক্ষা”। 

ব্যাপক অর্থে শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রত্যেকেই শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত কেউ নেই, শিক্ষা আচরণগত পরিবর্তন আনে, শিক্ষা হলো একটি মানবীয় প্রচেষ্টার ফল, শিক্ষা একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, শিক্ষা হলো নির্দেশনার সমষ্টি, শিক্ষা হয়ে থাকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যনির্ভর, শিক্ষা একটি সামাজিক ও মনোসামাজিক প্রক্রিয়া। অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি বা শিক্ষার্থীর চাহিদা, আগ্রহ, প্রবণতা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদিকে গুরুত্ব প্রদান করে অগ্রসরমান সমাজ বা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী করে গড়ে যোগ্য জনসম্পদরূপে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, সে প্রক্রিয়াকে আধুনিক শিক্ষা বলা হয়। আধুনিক বিশ্বের আধুনিক শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবসম্পদ তৈরি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আলাদা করে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির আগমন, কর্মসংস্থানের সৃষ্টি ও কর্মসংস্থানে প্রবেশের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজন। বৃত্তিমূলক শিক্ষাই মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে, সমাজ ও দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে। 

সঙ্গত কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে শিক্ষা কমিশনের সদস্যদের দিক নির্দেশনামূলক পরামর্শ প্রদানকালে বলেছিলেন, “আমি চাই আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান একটি শিক্ষা ব্যবস্থা”। এছাড়া, ১৯৭৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনেও তিনি বলেছিলেন, “শুধু বিএ, এমএ পাস করে লাভ নাই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ও কলেজ, যাতে সত্যিকারের মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বাঁচতে পারবে”। বঙ্গবন্ধু’র শিক্ষাদর্শনের আলোকে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের স্টাডি রিপোর্ট ও সুপারিশের ভিত্তিতে ২০০০ সালে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাকোর্স ৪ বছরে উন্নীত করেন। কোন ধরনের পূর্ব স্টাডি-গবেষণা ব্যতিত দীর্ঘ ২১ বছর ধরে চলমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিভাবে গ্রহণযোগ্য এই শিক্ষাকোর্সের মেয়াদ ১ বছর হ্রাস করে ৩ বছরে রূপান্তরের আত্মঘাতি উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে এবং ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং আগত প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করার জন্য যেখানে পৃথিবীব্যাপী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়নে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের আত্মঘাতি উদ্যোগ দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হবে। 

আধুনিক শিক্ষায় যখন জীবন ঘনিষ্ট শিক্ষা হিসেবে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, যে পথে সরকার প্রধান দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে যাবার প্রত্যয় বার বার ব্যক্ত করছে, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ক্ষত নিরসনে অনেকটা উদাসীন। প্রকৃত সমস্যা সমাধানের চেয়ে নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে জটিলতা বাড়িয়ে দেয়াটা যেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্য। লক্ষ্য করা যাচ্ছে- প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকার পরও বিগত ১০/১২ বছরেও পলিটেকনিক ও টিএসসিসমূহে তীব্র শিক্ষক সংকট (৭০% শিক্ষক নেই) এবং ল্যাব-ওয়ার্কসপের সমস্যা সমাধান করা হয়নি। উপরন্তু করোনায় কঠোর লকডাউনের মাঝে পলিটেকনিক ও টিএসসিসমূহের সার্ভিস রুল রাতারাতি পরিবর্তন করে ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরের দুই সহ¯্রাধিক টেকনিক্যাল পদে ননটেকনিক্যাল জনবল নিয়োগ দিয়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি চরমভাবে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন। ৫ বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষকগণ পদোন্নতিযোগ্য হলেও পলিটেকনিক ও টিএসসিতে ১৫/২০ বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নানা অযৌক্তিক অজুহাতে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয় শিফটের শিক্ষক-কর্মচারিদের সম্মানি ভাতা হ্রাস করাসহ বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরও ঝঞঊচ-এ কর্মরত শিক্ষকদের নিয়মিত করা হয়নি। বরং বিগত ১৪ মাস বেতন দেয়া হচ্ছে না।  কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তর, আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক পদে ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পদে অকারিগরি এবং কারিগরি শিক্ষায় অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ/ প্রেষণে নিয়োগ/ দায়িত্ব দিয়ে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভিজ্ঞদের অবজ্ঞা করে তাদের পদোন্নতির সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ থেকে কারিগরি শিক্ষা এবং ৯ম-১০তম এ মাধ্যমিক ও দাখিল মাদ্রাসায় এসএসসি (ভোক) কোর্স ২০২০-২০২১ সালের মধ্যে চালু করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ২০২১ শিক্ষাবর্ষেও বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশ অনুসারে ছাত্র বৃত্তির সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদেরকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং ভাতা উপ-সহকারী প্রকৌশলীর স্কেলের বেসিক পে এর সমপরিমাণ অর্থ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। 

শুধুমাত্র কারিগরি শিক্ষাকে অবনমন নয়, এই শিক্ষায় উত্তীর্ণ পেশাজীবী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নানাভাবে অধিকারহরণ করাসহ বিভিন্ন সময়ে নানা কালাকানুনের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর একাধিকবার সুস্পষ্ট নির্দেশনার পরও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র ও শিক্ষকদের ন্যায্য পেশাগত সমস্যাসমূহ সমাধান করা হয়নি। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০-এ জনগণকে জিম্মি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রকৌশলীদের অবমূল্যায়ন করে জনস্বার্থবিরোধী ধারা অন্যায়ভাবে সংযোজন করা হয়েছে। নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যে নামে ডিগ্রি/ডিপ্লোমা সনদ পেয়ে থাকেন আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি সে অনুযায়ী ‘ইঞ্জিনিয়ার’ এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করলেও বিএনবিসি-২০২০ এ ইঞ্জিনিয়ার-এর সংজ্ঞায় এর প্রতিফলন হয়নি।  নির্মাণ ক্ষেত্রে চলমান সরকারি নীতিতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ (সিভিল) ৪ তলা পর্যন্ত বিল্ডিং-এর স্ট্রাকচারাল ডিজাইন অত্যন্ত সফলতার সাথে করে ভবন নির্মাণে জনগণকে সেবা দিয়ে আসছিল। কিন্তু বিএনবিসি ২০২০ এ সম্পূর্ণরূপে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে গ্রাম, ইউনিয়ন, জেলা, উপজেলার জনগণসহ দেশের সকল গণমানুষ একটি ৪/৫ তলা বাড়ি করতে গিয়ে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের জন্য কতিপয় ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) এর নিকট জিম্মি হবেন। এছাড়া, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চরমভাবে অবমূল্যায়ন করে ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির সুপারিশের আলোকে অদ্যাবধি সংশোধনপূর্বক গেজেট প্রকাশিত হয়নি। যা, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের গভীরভাবে হতাশ করেছে। 

অন্যদিকে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের কর্মস্পৃহা জোরদারকরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ ১২ বছর পূর্বে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রাথমিক নিযুক্তিতে অন্যান্য পেশাজীবীদের ন্যায় ১টি স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট এবং ডিজাইন, প্ল্যানিং বিভাগে কর্মরত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সহকারী প্রকৌশলীদের ন্যায় ৩টি স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট প্রদান, পদোন্নতির কোটা ৫০% এ উন্নীতকরণ, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, পেট্রোবাংলা ও বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং টীম কনসেপ্ট অনুযায়ী অর্গানোগ্রাম প্রণয়ন, বিদ্যুৎ কোম্পানিসমূহে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদান এবং প্রাইভেট সেক্টরে কর্মরত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ন্যূনতম বেতন ও পদবী নির্ধারণের আশ্বাস প্রদান করলেও অদ্যাবধি এর একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। 

যেখানে প্রধানমন্ত্রী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশে গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের উদাসীনতা ও আত্মঘাতি উদ্যোগ পক্ষান্তরে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের বিপরীতে যাচ্ছে কিনা, সেটি জাতির একান্ত জিজ্ঞাসা। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সাম্য ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ নির্মাণে যখন নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, সেখানে একটি উৎপাদন ঘনিষ্ট পেশাজীবী গ্রুপকে সর্বক্ষেত্রে দাবিয়ে রাখার যে কৌশল গণপূর্ত, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিখুতভাবে পালন করে যাচ্ছে, সেটা চূড়ান্ত বিচারে কোন্ পক্ষকে জয়ী করবে, সেই বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয় না, এটি ভয়ঙ্কর ও দেশদ্রোহিতার শামিল’। আমাদের মনে রাখতে হবে অধিকারহরণ ও অধিকার প্রপ্তির ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্তের মধ্য দিয়ে শোষণ প্রক্রিয়া প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়। এটি কখনো সমন্বিত জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে না। বরং উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। যার চড়া মাশুল সমগ্র জাতিকে দিতে হবে। যা কারো কাম্য হতে পারে না। 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, আইডিইবি ও চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড, এনপিআই ইউনির্ভাসিটি অব বাংলাদেশ

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank