বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ || ১১ পৌষ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পরীমণি, মিডিয়া ট্রায়াল ও আব্দুল গাফফার চৌধুরীর শঙ্কা

কবির য়াহমদ. সাংবাদিক ও লেখক

১১:৫৮, ১০ আগস্ট ২০২১

আপডেট: ১৫:১৪, ১৩ আগস্ট ২০২১

২৮৭৯

পরীমণি, মিডিয়া ট্রায়াল ও আব্দুল গাফফার চৌধুরীর শঙ্কা

চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমণির বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করেছে র‍্যাব। এরপর তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, আইস নামের মাদক উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র‍্যাব। আটকের আগে রুদ্ধশ্বাস এক অভিযানের সম্পন্ন করে এলিট বাহিনীটি, ‘ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী’ ধরতে যে পরিস্থিতি হয় এক্ষেত্রেও তার চেয়ে আয়োজন কম কিছু ছিলো না। পরীমণির ফেসবুক লাইভসহ নানা লাইভের মাধ্যমে ঘটনাটি দেখেছে দেশবাসী। বাসা থেকে নিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় গ্রেপ্তারও দেখানো হয়। তারপর আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে পরীমণিকে।

আলোচিত এই অভিনেত্রীকে আটকের আগে-পরে আরও কজনের বাসায় একইভাবে অভিযান চালানো হয়। ওই অভিযানগুলো দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেনি। মৌ ও বিপাশা নামের দুই মডেলের বাসায় অভিযানের পর একইভাবে মদ, মাদক উদ্ধারের কথাও জানায় র‍্যাব। এরপর পরিচালক রাজের বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে একইভাবে মদ, মাদক, সীসার সরঞ্জাম, ইয়াবা ও বিকৃত যৌনাচারের উপাদান উদ্ধারের কথাও জানানো হয়। তারও আগে সম্প্রতি আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামের একটি সংগঠনের নামে নেতা তৈরি করতে চাওয়া আলোচিত ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকেও বিদেশি মদ, বিদেশি মুদ্রাসহ আরও কিছু উপাদান উদ্ধারের কথাও জানানো হয়।

৪ আগস্ট পরীমণির বাসায় অভিযানের পরের দিন র‍্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইং যে জব্দ তালিকা প্রকাশ করে যেখানে বলা হয় এই অভিনেত্রীর বাসা থেকে ১৯ বোতল বিদেশি মদ, চার গ্রাম আইস ও একটি এলএসডি ব্লটার উদ্ধার করা হয়েছে। মদের মধ্যে আছে- আট বোতল প্লাটিনাম লেবেল, তিন বোতল ব্ল্যাক লেবেল, দুই বোতল সিভাস রিগ্যাল, দুই বোতল ফক্সগ্রোভ, এক বোতল ব্লু লেবেল, দুই বোতল গ্লেনলিভেট, এক বোতল গ্লেনফিডিচ। র‍্যাব বলছে ওখানে নাকি মিনি-বারের অস্তিত্বও রয়েছে। র‍্যাব এবং অজানা সূত্রের বরাত দিয়ে কিছু গণমাধ্যম বলছে পরীমণিসহ এই মডেলরা অনেককে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ উপার্জন করতেন।

পরীমণির গ্রেপ্তারের পর জানা যাচ্ছে, একটি ব্যাংকের এমডি নাকি এই অভিনেত্রীকে তিন কোটি টাকার গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ব্যাংকার সে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন তার সঙ্গে পরীমণির পরিচয়ই নাই, গাড়ি উপহার দেওয়া দূরের কথা। আলোচিত ওই ব্যাংকার একজন লেখকও। তার দাবি তার শত্রুরা এই প্রোপ্যাগান্ডা চালাচ্ছে। এই গাড়ি উপহারের যে তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হলো এবং গাড়ির একটি ছবিও প্রকাশ হলো সেই সূত্রও অজানা।

বেকায়দায় পড়ে যাওয়ার পর পরীমণির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ- তিনি একাধিক বিয়ে করেছেন। গ্রামের গরিবের ঘরের সন্তান ছিলেন। ঢাকায় বিশেষ করে সিনেমার জগতে এসে রাতারাতি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে গেছেন। এই অর্থবিত্ত এসেছে তার ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে। এখানে অনেকেই সরাসরি কিংবা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে যৌনতার বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের দিকে ইঙ্গিত করছেন। অথচ এইধরনের অভিযোগের সপক্ষে কেউ তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি, এবং অথবা বলা যায় এই পথেও যাননি। একজন সুন্দরী নারীর অর্থের উৎস স্রেফ যৌনতা ও ব্ল্যাকমেইলিং ছাড়া আর কিছুই নয়- এ ধারণা অনেকের।

পরীমণি বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো নিয়ে সরগরম সোশ্যাল মিডিয়া তার জন্যে কারও তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের দরকার পড়ছে না, আগ্রহীও নয় কেউ। একপাক্ষিক এই মিডিয়া ট্রায়াল, যেখানে আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়াই পরীমণিকে অপরাধী সাজানো হচ্ছে। অথচ কেউ পুলিশ বা র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হলেই যে সে অপরাধী নয় এটা কে বুঝাবে তাদের? র‍্যাব কোন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া পরীমণিকে আটক করেছে, এরপর মদ উদ্ধারের পর তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এখানে তিনি অপরাধী কি না এ সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারকারীদের যেমন নাই, র‍্যাবেরও নাই। এটা নির্ধারণের এখতিয়ার এককভাবে আদালতের। তবু এখানে পরীমণিকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে।

কেন হচ্ছে এমন? প্রথমতঃ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের খাসলত, যেখানে তারা যে কাউকে সুযোগ পেলেই অপরাধী সাজিয়ে বসে। দ্বিতীয়তঃ পরীমণি সাম্প্রতিক সময়ের দেশের আলোচিত এক নাম। সাম্প্রতিক বোট ক্লাব কাণ্ডে নাসির উদ্দিন মাহমুদ নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনে আলোচনায় আসেন। ওই ঘটনায় প্রথমে পুলিশ মামলা নিতে না চাইলেও নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করার পর মামলা হয় এবং নাসির উদ্দিন মাহমুদ গ্রেপ্তারও হন। যদিও পরবর্তী কালে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। তৃতীয়তঃ পরীমণি অনিন্দ্য সুন্দরী এক নারী। দেশবরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘পরীমণি বাংলাদেশের সুচিত্রা সেন’। এই অভিনেত্রীর রূপের প্রশংসায় কবি আরও বলেছিলেন- ‘পরীমণির সুন্দর মুখ থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। সৌন্দর্যের একটা সুষম বিকাশ আছে ওর দেহাবয়বে’। কবি গুণ এই অভিনেত্রীর প্রশংসা সম্প্রতি করেননি অবশ্য। ২০১৮ সালে পরীমণি অভিনীত ও গিয়াসউদ্দিন সেলিম পরিচালিত ‘স্বপ্নজাল’ চলচ্চিত্রের প্রশংসা করতে গিয়ে নির্মলেন্দু গুণ এসব কথা বলেছিলেন। কে জানে সৌন্দর্যে হয়ত ঈর্ষা অনেকের, যদিও সৌন্দর্য ঈর্ষার নয়; মুগ্ধতার!

পরীমণির বিরুদ্ধে চলমান এই মিডিয়া ট্রায়ালের একইভাবে একই পথে হেঁটেছে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। তারা বাংলা চলচ্চিত্রের এই সময়ের শীর্ষ নায়িকা পরীমণির সদস্যপদ স্থগিত করে দিয়েছে। আটকের তিনদিনের মাথায় অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বিএফডিসিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমিতির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যপদ স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানান। সংগঠনটির সভাপতি মিশা সওদাগর লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনানোর সময়ে তার পাশে উপস্থিত ছিলেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান, ডিপজল, রুবেল, অরুণা বিশ্বাস, অঞ্জনা সুলতানা, আলেকজান্ডার বো, জ্যাকি আলমগীর এবং আলীরাজরা। একজন শিল্পীর দুর্দিনে অন্য শিল্পীরা তার পাশে দাঁড়াতে পারত নাকি অপরাধ প্রমাণের আগে তাকে অপরাধী বিবেচনা করে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই সঠিক হয়েছে, সেটা প্রশ্নাতীত নয়।

এই যখন পরিস্থিতি, যখন সবকিছু বিপক্ষে যাচ্ছে তখন পরীমণির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও একুশের গানের রচয়িতা আব্দুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। ‘পরীমণি যেন প্রতিহিংসার শিকার না হন’ শিরোনামের এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি পরীমণি ইস্যুকে ‘অর্গানাইজড প্রোপাগান্ডা’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এরও আগে আরেকটা লেখা পরীমণির পক্ষে যাওয়ার কারণে বর্ষীয়ান এক সাংবাদিককে অপরিচিত নাম্বার থেকে হুমকির স্বরে বলাও হয়- ‘তুমি শিগগিরই দেখবে তোমার পরীমণির অবস্থা আমরা কী করি?’ ভাবা যায়! লেখা পরীমণির পক্ষে যাওয়া আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মত ব্যক্তিত্বরাও যখন হুমকির মুখে পড়েন তখন সবকিছু কি ঠিকঠাক মত চলছে বলে মনে হয়? এই অভিযান মদ-মাদক উদ্ধার, ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ, অর্থের বিনিময়ে যৌনতার অভিযোগের সত্যতা কোথায় দাঁড়ায়?

আব্দুল গাফফার চৌধুরী স্রেফ পত্রিকায় লিখেই থেমে যাননি পরীমণি ষড়যন্ত্রের শিকার মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তাকে বাঁচানোর আবেদনও জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এটি তার একার আবেদন নয়। দেশে প্রশাসন, একটি বিত্তশালী গোষ্ঠী এবং মিডিয়া গোষ্ঠী মিলে ২৮ বছরের এক তরুণীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার যে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতন নাগরিক সমাজের আবেদন।’ 

তিনি লিখেছেন, ‘পরীমণিকে গ্রেপ্তারের জন্য দু'চার জন র‌্যাব কিংবা পুলিশ সদস্য গেলেই হতো, সেখানে যে আয়োজন করা হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল কোনো ভয়ঙ্কর ডাকাতকে গ্রেপ্তারের জন্য এই যুদ্ধযাত্রা। গ্রেপ্তারের পর থেকেই পরীমণির বিরুদ্ধে একটার পর একটা স্ক্যান্ডাল ছড়ানো হচ্ছে। এটা বোঝাই যায়, কোনো একটি মহল থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এগুলো করা হচ্ছে। অর্থাৎ বিচারের আগেই বিচার। ...দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কাছে আবেদন জানাই, তারা পরীমণির ওপর এই হেনস্থার প্রতিবাদ করুন। দয়া করে চুপ থাকবেন না। পরীমণির ওপর অত্যাচারের নিন্দা জানান। মিডিয়ার কাছে অনুরোধ, তারা যেন অত্যাচারিতের পক্ষে দাঁড়ান। অত্যাচারী গোষ্ঠীর পক্ষে না যান’; যোগ করেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী পরীমণির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক প্রচারকে ‘অর্গানাইজড প্রোপাগান্ডা’ বলছেন। এজন্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এই হস্তক্ষেপ বিচার থেকে রক্ষার জন্যে নয় বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। তিনি পরীমণিকে ‘হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। যথার্থই এ আবেদন। তার এই আবেদনে আমিও ব্যক্তিগতভাবে একাত্মতা প্রকাশ করি।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank