শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ যেদিন সংগীত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের শক্তি

ড. নাদির জুনাইদ, শিক্ষক ও কলামিস্ট

১৯:২১, ৩০ জুলাই ২০২১

আপডেট: ২০:৩৯, ৩০ জুলাই ২০২১

২১৮৮

‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ যেদিন সংগীত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের শক্তি

কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী বিশ বছরে কখনো দেশের কোনো সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নিয়ে কোনো লেখা দেখিনি। তখন তো ইন্টারনেট ছিলো না। দরকার হলেই গুগল বা ইউটিউবে কোনো কিছু খোঁজ করার সুযোগ ছিলো না। বাংলাদেশ টেলিভিশন তখন দেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল। ১৯৯১ সালের শেষ দিকে একদিন, বিটিভিতে জনপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে হানিফ সংকেত দর্শকদের জানালেন সেই কনসার্টের কথা। বললেন, কিভাবে ১৯৭১ সালে বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী রবি শংকর এবং জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত হয়েছিল একটি কনসার্ট। হানিফ সংকেত আরও জানিয়েছিলেন সেই কনসার্টটির একটি গানের দুর্লভ ভিডিও (যা সেই সময় সংগ্রহ করা ছিল খুবই কঠিন) তিনি সংগ্রহ করেছেন, এবং ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে তখন তা দেখানো হবে। 

তারপরই ‘ইত্যাদি’-তে প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশ।’ এক দল তারকা সংগীতশিল্পীর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া অনন্য সুরে জর্জ হ্যারিসন তার মোহনীয় কন্ঠে গেয়েছিলেন সেই মন-স্পর্শ-করা গান “মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ, টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ানটেড হেল্প বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ।” আমার মনে পড়ে, সারা শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠেছিল গানটি শুনে। গানটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও সেই গানের অসাধারণ অভিঘাত মনে অনুভব করছিলাম। সেই মুহূর্ত থেকে পুরো দেশের বহু মানুষ জেনে গিয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আয়োজিত সেই কনসার্টটির কথা, আর সেই কনসার্টে আমাদের দেশ নিয়ে গাওয়া জর্জ হ্যারিসনের সেই অবিস্মরণীয় গানটির কথা। বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়ে তখন আমরা কথা বলতাম এই গানটি সম্পর্কে। 

ঐতিহাসিক ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো। বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবী দানবীয় শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে থামিয়ে দেয়ার জন্য প্রতাপশালী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা শুরু করে। বাঙালি পুলিশ আর আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপরও সেই রাতে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে আমাদের দেশের মানুষদের সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালাতেই থাকে, যার কারণে পরবর্তী কয়েক মাসে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তৈরি করা শরণার্থী শিবিরে তীব্র দুর্দশা, উদ্বেগ, আর কষ্টের মধ্যে দিন কাটছিল বাংলাদেশের অগণিত মানুষের। এক ভারত ছাড়া সেই সময় অন্য কোনো দেশের সমর্থন বাংলাদেশ পায়নি। পাশ্চাত্যের ক্ষমতাধর দেশগুলো বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের উপর কোনো চাপ প্রয়োগ করেনি। গণতান্ত্রিক নিয়ম মানার প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা এবং সাধারণ নাগরিকদের উপর বর্বর অত্যাচার চালানোর পরও পাকিস্তান ঠিকই ক্ষমতাশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছিল। 

এমন পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই এক গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাংলাদেশের মানুষদের সাহায্য করার জন্য আয়োজন করা হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় সিতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকর একজন বাঙালি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা এবং যন্ত্রণা দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। জর্জ হ্যারিসনের সাথে রবি শংকরের ছিল গভীর ঘনিষ্ঠতা। এক সময় জর্জ হ্যারিসন তার কাছে কিছুদিন সিতারও শিখেছিলেন। বাংলাদেশের পীড়িত এবং বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য রবি শংকর যখন একটি কনসার্ট আয়োজনের কথা বলেন, জর্জ হ্যারিসন বন্ধুর প্রস্তাবে সাড়া দিতে দেরি করেননি। দরকার ছিল দ্রুত বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাহায্য পাঠানো। তাই কনসার্টটির আয়োজনে বেশি সময় পাওয়া যায়নি। পুরো জুন মাস আর জুলাই মাসের অর্ধেক সময় জর্জ হ্যারিসন বিভিন্ন বিখ্যাত সংগীতশিল্পীকে টেলিফোন করে কনসার্টে অংশগ্রহণের জন্য তাদের অনুরোধ করেন। সাড়া দিয়ে কনসার্টে অংশগ্রহণের জন্য নানা স্থান থেকে বিখ্যাত সংগীতশিল্পীরা উপস্থিত হন নিউ ইয়র্কে।  

পাশ্চাত্যের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে বৃটিশ রক ব্যান্ড ‘বিটলস্’-এর মতো খ্যাতি আর দর্শকপ্রিয়তা আর কোনো ব্যান্ডই পায়নি। বিটলস্-এর চারজন বিখ্যাত সদস্যের একজন ছিলেন জর্জ হ্যারিসন। ১৯৭০ সালের শুরুর দিকেই ভেঙ্গে গিয়েছিল ব্যান্ডটি, আর চার সদস্যের প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত অ্যালবাম তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯৭০ সালেই জর্জ হ্যারিসন বের করেছিলেন তার অ্যালবাম “অল থিংস মাস্ট পাস।” অ্যালবামটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ দুই স্থানেই জনপ্রিয় অ্যালবামগুলির মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে থাকে। বলা হচ্ছিলো বিটলস্ দল নিয়ে একসময় দর্শকরা যে উন্মাদনা দেখাতো, সেই উন্মাদনা এখন শুরু হয়েছে ‘শান্ত বিটল’ বলে পরিচিত জর্জ হ্যারিসনকে ঘিরে। নিজের সংগীত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ এবং সাফল্য-ঘেরা সময়ে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের জন্য কনসার্ট আয়োজনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কনসার্টের আগে প্রেস কনফারেন্সে যখন একজন সাংবাদিক জর্জ হ্যারিসনকে প্রশ্ন করেন যে বিশ্বে এতো সমস্যা থাকতে কেন তিনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কনসার্ট আয়োজন করছেন, তখন জর্জ হ্যারিসন খোলাখুলি উত্তর দেন, “কারণ আমার বন্ধু আমাকে অনুরোধ করেছেন, তাই।”

জর্জ হ্যারিসনের অনুরোধে কনসার্টে অংশগ্রহণ করতে নিউ ইয়র্কে যান বিটলস্-এর আরেক প্রাক্তন সদস্য রিংগো স্টার, সর্বকালের সেরা গিটার বাদকদের একজন বৃটিশ সংগীতশিল্পী এরিক ক্ল্যাপটন, মার্কিন সংগীতশিল্পী বিলি প্রেস্টন আর লিওন রাসেল, জার্মান সংগীতশিল্পী ক্লাউস ভুরম্যান, ড্রামার জিম কেল্টনার প্রমুখ। প্রথিতযশা মার্কিন সংগীতশিল্পী বব ডিলান শরণার্থীদের সাহায্য করার চিন্তাটি খুব পছন্দ করলেও ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের অনেক বাতির মধ্যে হাজার হাজার দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাওয়ার ব্যাপারে স্নায়ুবিক চাপ অনুভব করছিলেন।  অনুষ্ঠানের আগের দিনও তিনি ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেননি, এবং এক পর্যায়ে বলেছিলেন যে পরদিন তার পক্ষে অনুষ্ঠানে গান গাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জর্জ হ্যারিসন তাকে আসার জন্য জোর দিয়ে অনুরোধ করলে পরদিন ভয় কাটিয়ে বব ডিলান কনসার্টে অংশ নেন। হাজার হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বব ডিলান সেদিন গেয়েছিলেন নিজের বিখ্যাত কয়েকটি গান।

কনসার্টে আরও অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন গিটার বাদক জেসি এড ডেভিস, ডন প্রেস্টন, কার্ল রেডল, বৃটিশ ব্যান্ড ‘ব্যাডফিঙ্গার’-এর সদস্যরা, ‘দ্য হলিউড হর্নস’ দলের সদস্যরা, এবং আরও বেশ কয়েকজন সংগীতশিল্পী। পশ্চিমা শিল্পীদের অংশগ্রহণ ছিল কনসার্টের দ্বিতীয় পর্বে। প্রথম পর্বে অংশ নিয়েছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় শিল্পীরা যাদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত রবি শংকর, উস্তাদ আলি আকবর খান, উস্তাদ আল্লা রাখা, এবং কমলা চক্রবর্তী। এই কনসার্টই ছিল বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করার জন্য আধুনিক সময়ে বিশ্বে আয়োজিত প্রথম কনসার্ট। এই ধরনের বেনিফিট কনসার্ট পরবর্তীতে আরও অনেক হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। আর এর সূচনা হয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে। এক সঙ্গে এতোজন তারকা সংগীতশিল্পীকে এক মঞ্চে দেখার সুযোগ দর্শকদের এর আগে হয়নি। তাই ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-কে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল গভীর আগ্রহ আর আলোড়ন। টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই টিকিট কেনার জন্য দর্শকদের বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের ভিড় শুরু হয়। দেখা যায় ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের সামনে কনসার্টের আগে অনেকে রাত কাটাচ্ছে। 

কনসার্টে নিজেদের পর্বের আগে উপস্থিত প্রায় চল্লিশ হাজার দর্শকের উদ্দেশে রবি শংকর বলেন, “আমরা শিল্পী। আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা শুধু একটি বার্তা পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সংগীত আপনাদের বাংলাদেশে ঘটে চলা দুঃখজনক ঘটনা আর বাংলাদেশের মানুষের তীব্র মনোবেদনা অনুভব করতে সাহায্য করুক।”

সেতার-সরোদ-তবলা-তানপুরা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র স্পর্শকাতর। তীব্র আলোয় বাদ্যযন্ত্রগুলোর সুরের মাত্রা ঠিক থাকে না। শিল্পীরা তাই এক মিনিটের মতো সময় নিয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলোর সুর ঠিকঠাক করতেই পশ্চিমা দর্শকরা তুমুল হাততালি দিয়ে ওঠে। রবি শংকর তখন হাসিমুখে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “আপনারা যদি টিউনিং-ই এতো পছন্দ করেন, তাহলে আশা করি বাজানো আপনারা আরও অনেক বেশি উপভোগ করবেন।” এরপর চার শিল্পী পরিবেশন করেন বাংলার লোকসংগীত অবলম্বনে রচিত এক অনন্য সুর ‘বাংলা ধুন।’ বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে নিউ ইয়র্ক শহরে এক মঞ্চে যেন হঠাৎ তৈরি হয় বাংলার সবুজ গ্রামের এক আবহ। এরপর শিল্পীরা বাজান তিন তালের একটি ‘গৎ।” রবিশংকরের সেতার আর উস্তাদ আলি আকবর খানের সরোদ যেন কথা বলতে থাকে একে অপরের সাথে। আর সেই সাথে থাকে উস্তাদ আল্লা রাখার তবলার তাল। পশ্চিমা দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে দেখেন বিখ্যাত ভারতীয় শিল্পীদের অসাধারণ উপস্থাপন। পর্বটি শেষ হয় দর্শকদের তুমুল করতালির মধ্যে।  

বিখ্যাত পশ্চিমা শিল্পীদের নিয়ে কনসার্টের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতেই জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেন নিজের নতুন অ্যালবামের একটি দর্শকপ্রিয় গান “ওয়াহ্ ওয়াহ্।” কনসার্টে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও গান গেয়েছিলেন বিলি প্রেস্টন, রিংগো স্টার, লিওন রাসেল, এবং বব ডিলান। খুব দ্রুততার সাথে কনসার্ট আয়োজনের জন্য এবং কোনো কোনো শিল্পী অনেক পথ বিমানে পাড়ি দিয়ে নিউ ইয়র্কে আসার কারণে এতো বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের আগেও শিল্পীরা খুব কমই রিহার্সেলের সুযোগ পেয়েছিলেন। কখনো কোনো রিহার্সেলই হয়নি। কিন্তু কনসার্টটির সাথে শিল্পীরা মানসিক দিক দিয়ে এতো নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন এবং বহু শিল্পীর আর অজস্র দর্শকের উপস্থিতিতে এমন মোহময় এক পরিবেশ সেখানে তৈরি হয়েছিল যে শিল্পীদের প্রত্যেকের পরিবেশনই হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। জর্জ হ্যারিসনের বিখ্যাত গান “হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস” গানটিতে লিড গিটারের একটি দীর্ঘ অংশ আছে। সুরটি একই সাথে স্পন্দনময় এবং বিষাদমগ্ন করে তোলা প্রয়োজন আর এই কঠিন কাজটি করার দায়িত্ব ছিল এরিক ক্ল্যাপটনের উপর। এরিক ক্ল্যাপটন কনসার্টের কয়েকদিন মাত্র আগে লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে যান, এবং রিহার্সেলে অংশ নেয়ার তেমন সুযোগ তিনি পাননি। তারপরও অনুপম দক্ষতায় গিটারের এই কঠিন অংশটি সেদিন বাজিয়েছিলেন এরিক ক্ল্যাপটন। সুরের অপূর্ব মূর্চ্ছনা সেদিন বার বার মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। কনসার্টের শেষ গানটি ছিল জর্জ হ্যারিসনের বিশেষ গান ‘বাংলাদেশ,’ যা তিনি লিখেছিলেন এই কনসার্টের জন্যই। 

এই গানটির কথাগুলো উল্লেখ করে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান বলেছিলেন, গানটির কথাগুলো শুনলে গানের পেছনে যে মানুষটি আছে তার মন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যে বাংলাদেশে তিনি কোনোদিন আসেননি, সেই দেশের মানুষদের যন্ত্রণার কথা শুনে জর্জ হ্যারিসন লিখেছিলেন এমন একটি গান যা শুধু বাংলাদেশের না যেকোনো দেশের মানুষেরই মন স্পর্শ করে। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ থেকে আড়াই লক্ষ ডলার পাওয়া গিয়েছিল যা ইউনিসেফকে দেয়া হয় এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আর এই দেশের বহু মানুষের কষ্ট সম্পর্কে যে সচেতনতা সারা বিশ্বে সেদিন এই কনসার্টের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল তার গুরুত্ব ছিল টাকার চেয়ে অনেক বেশি। তখন পর্যন্ত পাশ্চাত্যে বাংলাদেশের পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান নামটিই ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই কনসার্টের পর, রবি শংকরের বক্তব্যে বাংলাদেশ নামের উল্লেখ এবং জর্জ হ্যারিসনের বিশেষ গানটির পর সারা বিশ্বে এক মুহুর্তে ‘বাংলাদেশ’ নামটি ছড়িয়ে পড়েছিল। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিল, তখন অজস্র মার্কিন তরুণ-তরুণী দেখলো তাদের প্রিয় সংগীতশিল্পীরা বাংলাদেশের মানুষের বিপদের দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান কী তা নিয়ে সেই সংগীতশিল্পীরা চিন্তা করেননি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে তারা এই ঐতিহাসিক কনসার্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং এই জন্য কাউকে কোনো টাকা দেয়া হয়নি। মানবতার প্রতি দায়িত্ব পালন করতে সেই সংগীতশিল্পীরা সেদিন সমবেত হয়েছিলেন, আর তাদের সংগীত শক্তি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য। 

সেই ঐতিহাসিক কনসার্টের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার এই সময়ে গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি সেই কনসার্ট আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে যারা ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের বিপদগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন, আর বিশ্বের বহু মানুষকে সচেতন করেছিলেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে। আশা করবো, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নাগরিকরাও জানবেন এই কনসার্টটি সম্পর্কে, আর মনে রাখবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সেই অসাধারণ সংগীতশিল্পীদের অসামান্য অবদানের কথা। 

ড. নাদির জুনাইদ: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank