শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কেউ কেউ কসাই নয়, সকলেই কসাই

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান

১৯:৩৬, ১৯ জুলাই ২০২১

আপডেট: ২০:০৭, ১৯ জুলাই ২০২১

২৪৬২

কেউ কেউ কসাই নয়, সকলেই কসাই

"আমার বলবার কথাটা এই যে, অল্প একটু চেষ্টা করলে যে-কেউ কবিতা লিখতে পারে। 
আমার গিন্নির... ভাই এক সওদাগরি আপিসের বড়োবাবু। আগে সে-ও কবিতা লিখত, কিন্তু আপিসে তাই নিয়ে হাসাহাসি হওয়ায় এবং বড়োসাহেব তাকে একদিন চোখ পাকিয়া “হোয়াট্‌’স দিস্‌ আয়া’ম্‌ হিয়ারিং অ্যাবাউট ইউ” বলায়, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছে এখন গোয়েন্দা-গল্পের ভক্ত হয়েছে। তার কাছে সেদিন একটা ইংরেজি বই দেখলুম। বইয়ের নাম বুচার্‌ বেকার্‌ মার্ডার মেকার্‌। অর্থ অতি পরিষ্কার। যে-কেউ খুন করতে পারে। নৃশংস কসাইও পারে, আবার নিরীহ রুটিওয়ালাও পারে। খুন করবার জন্যে যে একটা আলাদা রকমের লোক হওয়া চাই, তা নয়।"
(নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)

আজ কবি ও কবিতা নয়। কোরবানির ইদে কসাই নিয়ে  লিখব। কসাই ছাড়া কোরবানীর ঈদ অসম্ভব! হোক না করোনা কাল! 

ডাক্তারকেও কেউ কেউ কসাই বলে। এই করোনাকালেও। ডাক্তার কেন কসাই? করোনা ডেংগু আক্রান্ত এই ঈদে ডাক্তার না থাকলে কী হতো ভাবুনতো! 

তবে এই লেখায় আমার কসাই ভাগ্য অথবা কসাই হতে কি যোগ্যতা লাগে! এই সব নিয়ে কিছু কথা বলছি। কোথাও যাবেন না, পড়া শেষ না করে-

কেউ কেউ কসাই নয়, সকলেই কসাই...

ছোটবেলার কথা চিন্তা করুন। কী আনন্দ সেই ঈদে! সাত ভাগের সেই কোরবানীর গরু সবাই মিলে যখন কাটাকুটি করতাম। এলাকার সকল পুরুষ! তখন কসাই। মাংস কাটায় যে যত পটু, তার কদর সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে যে চা-পাতি চালাতে পারতো... কোরবানির দিনে সেই সেরা কসাই। সেই হিরো।

কসাইয়ের শরীরে ভেজা গেঞ্জি, ঘাম আর মাংস থেকে ছিটে আসা রক্ত, টুকরো মাংস গায়ে লেগে আছে। মাঝে মাঝে প্রশংসার ফুলঝুরি চারপাশে। কী দারুন সময় ফেলে এসেছি, যখন সবাই ছিলাম কসাই।

ডাক্তারের কসাই ভাগ্য

সেমাই ছাড়া রমজানের নাকি ঈদ হয় না। তেমনি কসাই ছাড়া হয়না কোরবানীর ঈদ! তারপর ও কী নৃশংস এই শব্দ "কসাই"। বারো রকম কসাই সমাচার নিয়ে গল্প করলে সারা রাতেও শেষ হবে না। তবে আমার পছন্দ এক্সপার্ট  কসাই। 

দুই বছর আগে ঈদুল আযহার কথা বলছি। আমার ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার ফরিদের মাধ্যমে ঠিক হলো আমার গরু বেলা ১১টায় কোরবানি হবে।তবে তার আগে সকাল থেকে ফ্লাটের অন্য মালিকদের গরু কোরবানি হবে। ফরিদই কসাই ঠিক করেছে। ও জানালো গত কয়েক বছর ধরে এ-ই সবচেয়ে এক্সপার্ট কসাইই।

ফ্ল্যাটের সবার কোরবানির পশু বানানোর কাজ করেছে। আমি এখানে নতুন এসেছি, আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমি ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় বসে আছি নিশ্চিন্তে। বেলা ১১ টায় ফরিদকে ফোন দেই। ফরিদ খবর কি? স্যার, খবর খারাপ। কসাই সকালে আসেনি।

কারো গরুই এখনো কাটা শুরু হয়নি। কসাই খোঁজা হচ্ছে।

আমি নিচে নেমে ধানমন্ডি ৪ থেকে ৫ এ আসতেই  দেখা হলো জাহাঙ্গীর  ভাইয়ের সাথে। জাহাঙ্গীর ভাই  বললেন,  ভাই, কিখবর?  বললাম, এই খবর।

জাহাংগীর ভাই বললেন, আপনি আমার কসাই নিয়ে যান, আপনার গরু আগে বানিয়ে নিন। তারপর দেখা যাবে।

ওই কসাই দল আমার গরু সোয়া এক ঘন্টায় বানিয়ে ফ্ল্যাটের অন্য দুইজনের গরু বানানোর কাজে হাত দিল। মাত্র ১০মিনিটের মধ্যে এক্সপার্ট কসাই ম্যানেজ করায় ফ্ল্যাটের মালিক সমিতি আমাকে বাহবা দিলেন। সংগে আবদার করলেন, ভাই, আপনাকে এই ফ্লাটের সেক্রেটারির দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম,  না ভাই, আমি এ কাজ পারবো না। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা।

সেই থেকে আমি এখনো সেক্রেটারি। কসাই ভাগ্যে সেক্রেটারি। 

কসাই ভাগ্যের আরো প্রমান

এবার গরুর হাটে যাবার সময় হয়নি। সকালে নাস্তার টেবিলে হোয়াটসঅ্যাপে গরুর লাইভ ছবি দেখে এক মিনিটেই গরু কিনে ফেলি। কথা হলো, আমার কোরবানির গরু ঈদের দিন সকাল ১০ টার মধ্যেই বানিয়ে দিতে হবে। যথারীতি ঈদের আগের রাতে ফোন এলো, স্যার, কসাই আপনার ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকারের কাছে এখন মাল-সামাল রেখে আসবে। মোবাইল ফোন হাত থেকে  না রাখতেই বাসার ইন্টারকম বেজে উঠলো। ফরিদ জানালো, হৃদয় নামে একজন কসাই এসেছে হাতিরপুল থেকে। আমি বললাম, ওর মাল- সামাল রেখে দাও। ফরিদ বললো স্যার, কোনো ছুরি-চাপাতি আনেনি কসাই। কিছু সময় পর জানতে পারি, এ কসাই অন্য কসাই। যে কসাই গত কোরবানির ঈদে অতি দ্রুততার সাথে আমার গরু বানিয়ে দিয়েছিল। সে এবারো আমার কোরবানির গরুর কাজ করতে চলে এসেছে।

কী মধুর সমস্যা! আর্জেন্টিনা অথবা  ব্রাজিল কোচ ছাড়া আর কার আছে এ ভাগ্য এ মুহূর্তে বলুনতো!

আমি অত্যন্ত লজ্জিতভাবে হৃদয়কে বললাম, ভাই আমার মোবাইল ফোনটি হারিয়ে যাওয়ায় তোমার ফোন নম্বরটি হারিয়ে ফেলেছি। তাই তোমার সাথে এবার যোগাযোগ করতে পারিনি। অন্য একজন( কসাই) আমি ঠিক করে ফেলেছি। 

ডাক্তার কেন কসাই

একটি সুপার স্টোরে প্রায়ই যেতে হয় মাংস কিনতে। ডাক্তার বলে এক্সট্রা খাতির পাই সব সময়। বেছে বেছে মাংস দেয়। যেদিন মাংস ভালো থাকে না  সেদিন আমি মাংস কিনতে গেলে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় আজকের মাংস ভালো নয়। কাল আসতে। তো একদিন কসাই সালাউদ্দিনের মন ভীষণ খারাপ। আমি জিজ্ঞেস করি  কি হয়েছে ? সে বললো, স্যার প্রথম যখন এই সুপার স্টোর খোলে তখন কাস্টমার ছিলো না, মাংসও বিক্রি হতো না। আমি অন্য এক দোকানে কাজ করতাম। সেখান থেকে আমাকে যে চুক্তিতে এনেছিলো এখন তারা সেটা মানছেনা । তারা নিজেদের লোক বসাবে। এখন আমি প্রতিদিন ১০০-১৬০ কেজি মাংস বিক্রি করি... তাই…। আমি স্যার এখান থেকে চলে যাবো। বললাম , কোথায় যাবে? ঠিক নাই। তয় নতুন একটা দোকান পাইলে এই এলাকায় মাংস বিক্রি করবো। আমার মায়া হলো। আমি বললাম কত পুঁজি লাগে? যা লাগে লাগুক বিপদে পড়লে আমি পুঁজি দেবো। সবাইতো এমনিই কসাই বলে... এবার না হয় সত্যি সত্যি কসাই হলাম। সেই থেকে আমিও কসাই ।

ডাক্তার কেন কসাই (২) 

ডাক্তারদের কেউ কেউ কসাই বলে গালি দেয়। কেন দেয় আমি সত্যি জানিনা। আমাকে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু  (নাম বলতে চাই না) কসাই বলে সম্বোধন করেছিলো। তার সাথে আমার অনেক দিন পর দেখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিইউতে। তিনি হাসপাতালে ভর্তি তার এক আত্মীয়কে দেখতে এসেছিলেন। সন্ধ্যা ৬ টায়। আমি তখনো ক্যাথল্যাবে রোগিদের করোনারী অ্যান্জিওগ্রাম/ অ্যান্জিওপ্লাস্টি ( রিং বসানো) করছিলাম। তখন বিভিন্ন মিডিয়ায় ডাক্তারদের ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছিল। কুশল বিনিময়ের পর কথার এক পর্যায়ে বললাম, সরকারি নিয়মে আমার অফিস সময়ের পরেও  এই সময়ে হাসপাতালে থাকার কথা নয়। সেই সকালে ক্যাথল্যাবে কাজ শুরু করেছি। তিনি বললেন, আপনারাতো কসাই। আমি মৃদু হেসেছিলাম। গুনিজনেরা বলেন, বড় হতে হলে চলার পথে সব কথা ধরতে নেই।

আমার সেই বন্ধুর রোগি ভর্তি ছিল অন্য একজন অধ্যাপকের তত্বাবধানে। দিন কয়েক যেতেই তার সেই আত্মীয় আবদার করলো আমার হাতেই তার অ্যান্জিওগ্রাম পরীক্ষাটি করাতে ইচ্ছুক। 

যাহোক অ্যান্জিওগ্রাম পরীক্ষার সকালে আমি রোগির পায়ের নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করতে পা টিপে দেখছিলাম। রোগি বললেন, স্যার কী করেন? আপনি আমার পা ধরে সালাম করলেন। আমি বললাম, একটু পর আমি কসাই হয়ে ছোট্ট একটু কাজ করবো। তাই মাফ চেয়ে নিলাম।যাহোক রিং বসানোর পর সেই রোগিও আমার একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গেছেন। নিয়মিত ফলোআপে আসেন। আমার জন্য বাড়ির বাগানের ফল ফলাদিও সঙ্গে নিয়ে আসেন। এরপর ও কী  বলবেন আমি কসাই?

আমি যখন কসাই ছিলাম

আমার বড় ছেলের আকিকার সময় আমাকে কসাই হতে হয়েছিল। অনেকটা বাধ্য হয়েই। খাসি আমি নিজ হাতেই জবাই দিয়েছিলাম। তারপর যে কসাই ঠিক করেছিলাম সে এতটাই ধীরগতির এবং কাঁচা ছিলেন যে আমাকে বাধ্য হয়েই ছুরি চাপাতি হাতে নিতে হয়েছিল। যদিও আমি তখন এমবিবিএস উত্তর এমডি কোর্সে অধ্যয়নরত ছিলাম।

কসাই হতে কী যোগ্যতা লাগে? 

নৃশংস কসাই যে কেউ হতে পারে। রুটিওয়ালা থেকে রিকশাওয়ালা। কোরবানি ইদ কাছে এলে সবাই নিজেকে কসাই পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে। ডাক্তার তো কসাই-ই।

কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই কসাই হতে লাইসেন্স লাগে। কসাইখানায় চাকরির ইন্টারভিউ হয়। পত্রিকায় অ্যাডভার্টাইজমেন্ট ছাপা হয়। কসাইয়ের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি লাগে।

পুনশ্চ: "এ রক্তমাখা কসাইখানা আমার দেশ না।"
                                            (কবি নবারুন ভট্টাচার্য)

 

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান: ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank