ফুটবলের জন্য প্লেটোনিক ভালোবাসা!
ফুটবলের জন্য প্লেটোনিক ভালোবাসা!
খেলা নিছক আনন্দময় অনুভূতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কখনো কখনো খেলাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অঘটন ঘটে। বিজয়ী দলের ওপর হেরে যাওয়া দল চড়াও হয়েছেন এমন উদাহরণ ভূড়ি ভূড়ি। হারের যন্ত্রণায় আবেগপ্রবণ সমর্থকের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে ফেলার ঘটনাও কম নয়! ভাংচুরও হয়। এক ধরনের সমর্থক হারের ঝাল মেটায় নিজের উপর। হেরে গিয়ে এমন কিছু করে বসেন তাতে নিজেরই ক্ষতিসাধন হয়। এরা ঘরের আসবাবপত্র ভাঙেন, দু-একদিনের অনশনব্রত পালন করে মনোকষ্ট দূর করার চেষ্টা করেন। কারও এইটুকু সামর্থ্য না থাকলে হয়তো মাথার চুল ছিঁড়েন। প্রমাণ দেন, খেলাকে কতোটা মাথার ওপর রাখেন!
খেলা সত্যিকার অর্থেই হরিষে বিষাদের ছায়া। সেই সূচনাকাল থেকেই এর সঙ্গে জড়িত হারজিৎ, তুমুল তর্ক-বিতর্ক, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই, এমনকি রক্তারক্তি। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে রোমান সম্রাটরা তাদের নির্মিত অ্যাম্পিথিয়েটারে গ্লাডিয়েটর ও সিংহের মধ্যেকার খেলা উপভোগ করতেন। মানুষের সঙ্গে সিংহের লড়াই দেখতে ভিড় জমাতেন হাজার হাজার দর্শক। শেষে যখন তরতাজা মানুষটি হেরে সিংহের খাদ্যে পরিণত হতো তখনও দর্শকদের হাততালি থামতো না। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এমন বীভৎস খেলার বিলুপ্তি ঘটেছে; অ্যাম্পিথিয়েটার স্টেডিয়ামে রূপ নিয়েছে; মানুষ ও হিংস্র প্রাণির প্রতিযোগিতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে; যুক্ত হয়েছে নানারকম নিয়মকানুন ও শাস্তির বিধান। শুধু তাই নয়, খেলা এখন হয়ে ওঠেছে টাকার খেলাও। রাজনীতি ও কূটনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবেও খেলার দাপুটে প্রকৃতির কথা কারও অজানা নয়। তাই কোন কোন রাজনীতিক প্রতিপক্ষকে আঁতকে দিতে বলে ওঠেন—'খেলা হবে!'
যতরকম খেলার কথাই উঠুক না কেন, ফুটবলের আবেদনে কখনো ভাটা পড়েনা। এই খেলা নিয়ে বহুরূপী উন্মাদনা দেখা যায় অন্য খেলা তার ধারেকাছেও নেই। দৌড়, ঝাঁপ, নিক্ষেপের মতো একাধিক খেলার সংমিশ্রণ ফুটবলকে দিয়েছে সর্বগ্রাসী এক জাদুবল। টান টান ৯০ মিনিটের উত্তেজনায় বুঁদ হয়ে থাকে গোটা দেহ। সকালবেলার খেলা দেখতে দেখতে কখন যে পেট খালি হয়ে যায় তার হদিস থাকেনা অনেকেরই। ঘোর ভাঙলে জানা যায়, বাজারটাই করা হয়নি। বউ রেগে আগুন হয়ে তেলে শুধু বেগুন ভেজে বসে আছেন! আবার কোনো বউ বাজারে গিয়ে দেখেন, দোকানি বিকিকিনি বন্ধ করে টিভি খুলে হা করে তাকিয়ে আছেন! নড়ন-চড়নের বালাই নেই। এজন্যই ফুটবলের মৌসুম এলে কোনো এক বাঙালি বউ পাড়াসুদ্ধ বলে বেড়াতেন, 'আমাদের সতীন এসেছে রে!' ফুটবল যে বউদের সতীন তার আরও একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। আমার এক সহকর্মীর ফুটবল বাতিক রয়েছে। এদিকে আবার ওর বউয়ের রয়েছে সিরিয়াল বাতিক। একদিন হুট করেই ওর বাসায় গেলাম একসাথে খেলা দেখবো বলে। কিন্তু যে খেলা দেখলাম তাতেই চোখ কপালে ওঠে গেল! ঘরে ওর শ্বশুর, শ্যালক ছাড়া আর কেউ নেই। খেলার বিরতিপর্বে কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাই, ভাবীকে দেখছি না যে!' তিনিও কানে কানে বললেন, 'আপনার ভাবী আমার শ্বাশুড়ি আর শ্যালিকার সঙ্গে সিরিয়াল দেখতে বাপের বাড়ি চলে গেছে। আর শ্বশুর আব্বা ও শ্যালক এসেছেন আমার বাড়িতে। আমরা ফুটবলে ফুটবলে আর ওরা সিরিয়ালে সিরিয়ালে!' আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললাম, 'এ কেমন খেলা!'
ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে বিপজ্জনক বাজি ধরার প্রবণতা রয়েছে। পত্রিকায় পড়েছিলাম, বাংলাদেশের রাজশাহীতে আর্জেন্টিনার একদল পাড় সমর্থক বাজি রেখেছিলেন, তাদের দল ওই বছর বিশ্বকাপ না জিতলে তারা পাঁচ লক্ষ টাকা ব্রাজিল সমর্থকদের মধ্যে ছিটিয়ে দিবেন। বিশ্বকাপ দূরে থাক, কোয়ার্টার ফাইনালেই অশ্রুসিক্ত বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। হারার পরপরই পাঁচ লক্ষ টাকা নিয়ে দুপক্ষ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। চেয়ারম্যান এসে দেখলেন অবস্থা বেগতিক। অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে সবাইকে শান্ত করা গেলেও ক্ষোভ থেকেই গেল। কারণ হলুদ রঙের জার্সি পরা একজন আকাশি রঙের জার্সি পরা আরেকজনের নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। রক্তস্নাত ভাঙা নাক নিয়ে ওই আর্জেন্টিনা সমর্থক প্রতিজ্ঞা করেছিল, 'আমি বেঁচে থাকলে এর শোধ নেব, ব্রাজিল সমর্থকদের কারও নাক আস্ত থাকবেনা!' ফুটবল আদতে এমনই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এক পলকেই।
বেশি অতীতের উদাহরণে যাই কেন? জানেনইতো কোপা আমেরিকা চলছে। খেলছে আমেরিকান দেশগুলো। ফাইনালে উঠেছে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। আর যায় কোথা? বুয়েন্সআয়ারস থেকে ১৫ হাজার মাইল দূর পৃথিবী নামের গোলকটির ঠিক উল্টো দিকে বাংলাদেশে তা নিয়ে উত্তেজনা চরমে। কিন্তু কেউ কেউ, কোথাও কোথাও তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। খবর হয়েছে- ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাকি উত্তেজনা এতটাই বেশি যে পুলিশ সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করতে বাধ্য হয়েছে। জড়ো হয়ে মেগা স্ক্রিনে খেলা দেখা বন্ধ। উদ্দেশ্য একটাই সম্ভাব্য ঝামেলা এড়ানো।
এ জন্যই শেকসপিয়ারের কোন এক নাটকে 'ফুটবলার' শব্দটি 'খিস্তি-খেউড়' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, যেখানে শিশুদের খেলার জন্যে বড় মাঠ নেই, সেখানে অন্য দেশের ফুটবল নিয়ে লাগামহীন মাতামাতি মোটেও বুদ্ধিসুলভ নয়।
এতকিছুর পরও ফুটবল খেলা যুগে যুগে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছে ঠিকই। ধনী ক্লাবগুলো ফুটবলকে নিয়ে গেছে অসীম উচ্চতায়। জাঁকজমকপূর্ণ বড় বড় আয়োজন ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে ফুটবলের জনপ্রিয়তা। আর বিশ্বকাপ তো কাঁপন তোলে সর্বস্তরে। ফলে ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যে অটুট থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। সোভিয়েত লেখক ইউরি ত্রিকোনভ যথার্থই বলেছেন—' আমি প্রায়ই ভাবি, ফুটবলের প্রতি আমার যে ভালোবাসা তার কোনো লক্ষ ও উদ্দেশ্য আছে কী? না হলে এতোটা অমোঘ আকর্ষণের কারণ কী? ফুটবলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আসলে প্লেটোনিক, যা থেকে আমাদের লাভের পরিমাণ অতিশয় কিঞ্চিৎ। তাই ফুটবলের সবকিছু বোঝা সম্ভব এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব—এমনটি ভাবা উচিত নয়। ফুটবলের অনেককিছুই ব্যাখ্যাতীত, ঠিক তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার মতোই।'
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ