সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

দক্ষিণ চট্টগ্রামের যত জমিদার বাড়ি

রাজিব শর্মা

১২:১৭, ১২ জুন ২০২১

৪৯৩৫

দক্ষিণ চট্টগ্রামের যত জমিদার বাড়ি

চট্টগ্রামের আনোয়ারার পরৈকোড়ায় জমিদার যোগেশ চন্দ্রের বাড়ি
চট্টগ্রামের আনোয়ারার পরৈকোড়ায় জমিদার যোগেশ চন্দ্রের বাড়ি

গ্রাম, গ্রামই। অন্তত শহর বলা যায় না কোন অর্থেই। চারপাশে মলিন গাছপালা, ঝোপঝাড়, বুনো জঙ্গল নতুন বর্ষার পানি পেয়ে পান্নার মতো ঝলসাচ্ছে দুপুরের রোদে। বৃষ্টি থমেছে ঘন্টা দুয়েক। পূর্ব দিকে মেঘ জমেছে আবার। রাস্তা কিছুটা পিচের, কিছু কাচাঁও-সেখানে খানাখন্দ। গর্তে জমে উঠেছে ঘোলাপানি। দু-চারটে মোড়ে নির্জীব মড়াখেকো মুদির দোকান, সেখানে অবিশ্যি কোক-পেপসিও চোখে পড়ল দু’বার। জায়গাটা গরিবই। ১৫০ বছর আগেও আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া গ্রাম এত হতশ্রী, এত নিঃস্ব ছিল না? চেনা যেত তাকে প্রতাপশালী জমিদার যোগেশ চন্দ্রের রাজধানী বলে। এই প্রশ্ন সে কখন থেকে ঘুরছে মাথায়। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রত্মতত্ত্বগুলো দেখতে গিয়ে একেকটি ঐতিহাসিক উঠোনে যাচ্ছি আর মন ভরাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। জমিদার যোগেশ চন্দ্র রায় ১৮৩৪ সালের দিকে মূল জমিদারির স্থপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন জনদরদী, মহানুভব ও দানশীল এবং বিলাসী প্রকৃতির মানুষ। তার রাজপ্রাসাদটি প্রায় ৪০ কানি জায়গার উপর নির্মিত হয়। এতে রয়েছে ৪টি বড় বড় পুকুর, খেলার মাঠ, নাচঘর, খাজনাঘর, মাগুবঘর, বৈঠকখানা, অভ্যর্থনা প্রাচীর, পুরাবড়ি, সিতলা মন্দির, জালাতনী মন্দির, দশভূজা মন্দির। এছাড়া রয়েছে বিশ্রামাগার।

রাজপ্রাসাদের কেন্দ্রিয় প্রবেশ পথে ৪টি বলয়রেখা অলংকৃত ও হরেক নকশাকরা তোরণ। যা উঁচু উঁচু খুঁটি ও পুর্তগীজ সভ্যতার শৈলী শিল্পে নকশা করা। তোরণগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। বেলতলা পুকুরের মাঝ খানে পিতলের তৈরি পান্থশালা ছিল সেসময়। এখন তা গল্প-কাহিনী। মূল জমিদার বাড়িটি এবরো তেবরোভাবে পড়ে আছে। আনোয়ারার পরৈকোড়া গ্রামে রয়েছে আরেক প্রতাপশালী জমিদার প্রসন্ন কুমার রায়ের স্মৃতি বিজড়িত রাজবাড়ি। ১৮৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন ওই জমিদার। ১৮ কানি জায়গার উপর নির্মিত জমিদার বাড়ির প্রধান তোরণ পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে ভাঙ্গাচোরা ইটের পাঁজার ফাঁক গলে ভিতর বাড়িতে গেলে গা ছমছম করে।

একসময় ওই বাড়িতে জৌলুস আর জৌলুস ছিল। এখন হাহাকার। জমিদার প্রসন্ন কুমার ছিলেন ধর্মভিরু, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি মনা। রাজপ্রাসাদটির অস্তিত্ব বলতে যা বোঝা যায় তা হল কয়েকটা লুপ্ত দেয়াল মাত্র। রাজভবনের সামনে মেহমানখানা। ৬ রুম বিশিষ্ট দ্বিতল ভবন। সামনে ছোট্ট পরিসরে হল রুম। ভবনের ফ্লোরজুড়ে নানা শৈলীতে গাঁথা মোগল স্থাপত্য শিলা বিন্যাসে তৈরি মোজাইক করা। ভবনের গাঁয়ে পোড়া মাটি দিয়ে খচিত আছে দেবদেবীর মুর্তি, ফুলেল ছবির প্রচ্ছদ। কিন্তু নেই আগের মত জৌলুস, চাকচিক্য, শাসন-শোষণ। 

পরদিন এলাম পশ্চিম পটিয়ার বড় উঠান গ্রামে জমিদার আসাদ আলীর প্রাসাদে। যার নাম শুনলে বাঘে- মহিষে একঘাটে জল খেত। ১৮০০ সালে নির্মিত বাড়ির দরবার ঘর ছিল অত্যন্ত ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকপূর্ণ। পারসি কায়দায় দরবার সুসজ্জিত ও আড়ম্বরপূর্ণ ছিল তাদের বিলাসী জীবন। এখন কেবল তা স্মৃতিমাত্র। বিশাল জমিদারি বাড়ি-ঘর ও জায়গা থাকলেও বর্তমানে ভোগ দখলের নেই তেমন কোন লোকজন। ২০ কানি জায়গার উপর নির্মিত বাড়িটি দেখলে মনে হবে এ যেন ভূতের বাড়ি। রাজপ্রাসাদের বাইরে রয়েছে নাচঘর, আদালত, ভূমি রেজিষ্ট্রির অফিস, মসজিদ, তেরজুরি (টাকা রাখার সুরক্ষিত ঘর)। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে তোলা এ প্রাসাদের একটি সাদাকালো ছবি পেলাম আমরা। তাতেও বৈভবের ছাপ স্পষ্ট। আর ২০১২-এ ? হয়তো যেকোনো সময় অবশিষ্ট ছাদ ধসে পড়ে মাটিতে মিশে যাবে জমিদার আসাদের প্রাসাদটির শেষ স্মৃতিটুকু। 

অবাক হওয়ার মত বর্ণনা শুনলাম চন্দনাইশের খাঁন বাড়িতে গিয়ে। বিখ্যাত সুফি-সাধক ও ধর্ম প্রচারক নবাব ইয়াছিন আলী খাঁন খাঁন বাড়িতে বসেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম প্রচারের কাজ করেছিলেন। এখন রাজপ্রাসাদটি বিলুপ্ত। আছে তাঁর বংশধর ফজর আলী খাঁন এর শেষ স্মৃতি বিজড়িত একটি ছোট বাড়ি। ওই বাড়িতে এখনও পর্যন্ত কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে না। কারণ লোকমুখে শোনা, স্থায়ীভাবে কেউ বসবাস করতে গেলেই অলৌকিকভাবে আগুন জ্বলে উঠে। ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে তুরস্ক থেকে নবাব ইয়াছিন আলী খাঁন চট্টগ্রামে ধর্ম প্রচারে আসেন। তাঁর বিনম্রতা, বদন্যতা এবং সুবিচারের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল সর্বজনের।

এলাকাবাসীরা জানান, ফজর আলী খাঁন ২২ গ্রামে ২২টি দিঘী, ২২টি মসজিদ, ২২টি বিরাট আকারের ফুলের বাগান তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। গল্প করতে করতে এক পসলা বৃষ্টির মধ্যে ফিরে এলাম পটিয়ার পাইরুল গ্রামে। সেখানে রয়েছে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রতাপশালী জমিদার অভিমন্যুর জমিদার বাড়ি। এক সময় ওই জমিদারের জমিদারী ছিল পটিয়ার জঙ্গলখাইন, গৈড়লা, পাইরুল, ধলঘাট, মুকুল নাইট ও আমজুরহাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এখন শুধু ১২ কামরা বিশিষ্ট জীর্ণশীর্ণ জমিদার বাড়িটি ছাড়া আর কিছুই নেই। জমিদার অভিমন্যুর বাড়ির সামনে দিয়ে কেউ জুতা পায়ে হেঁটে যেতে পারতো না। নিষ্ঠুর স্বাভাবের এ জমিদার ছিলেন অত্যাচারি। কালের অতল গহব্বরে হারিয়ে গেল তাঁর সমস্ত স্মৃতি। শেষ স্মৃতিটুকুও ভেঙ্গে পড়ে পড়ে অবস্থা। 

রাজবাড়িগুলো আজ দাঁড়িয়ে আছে অতীতের কঙ্কাল হয়ে। ছিয়াত্তরের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর এই রাজ বাড়ির মানুষগুলো অসামান্য অত্যাচার চালিয়েছিলেন ব্রিটিশের রেভিনিউ কালেক্টর হিসাবে। সে রকম একটি বাড়িতে গেলাম লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নে।

রাজবাড়ির নাম গুপ্ত এস্টেট। ১৭০০ খৃস্টাব্দে দ্বিতীয় মহারাণী ভিক্টোরিয়া রামমোহন রায়কে দান করেছিল বিশাল সম্প্রতি। বান্দরবান জেলা ও সাতকানিয়া- লোহাগাড়া উপজেলা বিশাল জায়গা ছিল তাঁর জমিদারির আওতায়। অত্যাচারি ওই জমিদাবেরর বিশাল বাড়িটি কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে অত্যাচারি বলছি এই জন্য তাঁর জমিদারি এলাকায় মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা জুতা পায়ে হাঁটতে পারতো না। তেওয়ারি হাট এলাকায় অবস্থিত জমিদার বাড়িটি ৯ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত। মূল বাড়িটি দুইতলা বিশিষ্ট। ঘরের দেয়ালগুলো প্রায় ২৪ ইঞ্চি প্রস্থ। বিশাল আকারের নকশায় তৈরি থাম ও ফটক গেইট এখনো বাড়িটির অস্তিত্ব জানান দেয়। শেষ বিকেলে আমরা দেখলাম আনোয়ারা উপজেলার তৈলারদ্বীপ এলাকার সরকার বাড়ি। সরকার বাড়ি অনেক ষড়যন্ত্রের সাক্ষী। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে সরকার বাড়িতে নির্যাতিত মানুষের বীভৎস কান্না শোনা যেত। ওই বাড়ির পাশদিয়ে মানুষ হাঁটতে ভয় পেত। সেই সরকার বাড়িতে আজ কোনো সরকার নেই। শুধু দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী ও ব্যর্থ ইতিহাস হয়ে জীর্ণশীর্ণ অহংকারী সরকার বাড়ি। 

জমিদার এরশাদ আলী ছিলেন সাহসী ও রাজস্ব আদায়ে নির্ভীক স্বভাবের। তাঁর সময়ে কঠোর হস্তে রাজস্ব আদায়ের ফলে কৃষক শ্রেণীর মানুষরা চরমভাবে নির্যাতিত হয়। এরশাদ আলীর জমিদারি ছিল চকোরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও চন্দনাইশ উপজেলা পর্যন্ত। প্রাচীন শৈল চিত্রে অঙ্কিত স্থাপত্যের সরকার বাড়িটি এখন পরিপাটি এবং সুরক্ষিত রয়েছে। 

রাজিব শর্মা: সাংবাদিক ও তরুণ লেখক, চট্টগ্রাম।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত