শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

রবীন্দ্রনাথ: অপমানের সাত সতেরো

শারফিন শাহ 

১৭:৫১, ১১ মে ২০২১

৩০৫৩

রবীন্দ্রনাথ: অপমানের সাত সতেরো

বাঙালি জাতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের একটা খেদ সবসময়ই ছিল। ওই খেদ নিছক আবেগপ্রসূত নয়, দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের সত্যনিষ্ঠ প্রকাশই বলা যায়। কবি, অকবি, পণ্ডিত, বৈয়াকরণ, নিষ্কর্মাদের দলবদ্ধ আক্রমণে যখন তাঁর সাধনায় ছেদ পড়েছে বারবার, তখন তাঁকেও আত্মরক্ষার স্বার্থে বেছে নিতে হয়েছে অসহিষ্ণুতার পথ। হৃদয়হীন, অহংকার-পরিতৃপ্ত, দুর্বল বাঙালি তাঁর খ্যাতির ওপর কালিমা লেপনের চেষ্টায় কোনো গলদ রাখেনি কখনো। মৃত্যুর এত বছর পরও অপমানের নানামুখী তীর তাঁকে বিদ্ধ করে চলেছে, এর যেন শেষ নেই! 

রবীন্দ্রনাথ গুরুদেব হলেও দেবতা নন। তিনি মানুষ এবং একজন বিশ্বখ্যাত কবি। তাঁর সাহিত্যকর্ম প্রভাবদুষ্ট কিনা, তিনি 'বাংলা ভাষায় প্রথম ইউরোপীয় সাহিত্য রচয়িতা' কিনা তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু এই সুযোগে তাঁকে বিকৃতির চেষ্টা মোটেও যুক্তিসিদ্ধ নয়। মনে রাখতে হবে, শুভদৃষ্টি আর বিষদৃষ্টি এক নয়। একটিতে ফুল থাকে আরেকটিতে হুল। রবীন্দ্রনাথের ভাণ্ডারে যাদের শুভদৃষ্টি পড়ে তারা হয়তো তাঁকে নিবিড়ভাবে পাঠ করেন এবং মধুরসে সিক্ত হন, কখনো নানা অসঙ্গতিও তুলে আনেন, কিন্তু যাদের বিষদৃষ্টি পড়ে তারা তাঁকে পাঠ করা দূরে থাক, পারলে তাঁর সমস্ত গৌরব ধুলোয় মিশিয়ে দেয়! অবস্থাটা এমন দাঁড়ায় যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে ঘষেমেজে একটা সার্বজনীন রূপ দিয়ে অন্যায় করে ফেলেছেন, বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমহলে ছড়িয়ে বড় ভুল করেছেন!

তরুণ বয়সেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে কুম্ভলিকবৃত্তির অভিযোগ ওঠেছিল। 'ভারতী' পত্রিকার মাঘ, ১২৯১ সংখ্যায় 'রামমোহন রায়' প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে তির্যক মন্তব্যের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। মহেন্দ্রনাথ রায় নামে এক সমালোচক লিখলেন, ওই প্রবন্ধের ভাব ও ভাষা অক্ষয়কুমার দত্তের লেখা থেকে চুরি করা। এখানেই থামেননি ভদ্রলোক। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে বললেন,'রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভাষাকে অদ্ভুত পদার্থ করিবার চেষ্টায় আছেন'। এ ঘটনার কিছু আগে প্রবাহ মাসিক পত্রের আষাঢ়, ১২৯১ সংখ্যায় দামোদর মুখোপাধ্যায় নামে একজন রীতিমতো সীমা ছাড়িয়ে বিদ্রূপানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন : 
'তিনি [রবীন্দ্রনাথ ] সুকবি, সুলেখক ও সুসমালোচক। তার ওপর আবার স্বাধীন চিন্তার 'চাষ' করেন।...তার উপর আবার সুগায়ক। একাধারে তিনি এত সু...' 
দামোদর মুখোপাধ্যায় আরও লিখলেন, রবীন্দ্রনাথের হাতেই বাংলা সাহিত্যের শমন উপস্থিত, অচিরেই সে লাটে উঠবে, সাহিত্যের সবই যাবে, থাকবে কেবল 'বৌঠাকুরাণীর হাট' ও 'ছোটঠাকুরাণীর ঠাট' ইত্যাদি। 

বলার অপেক্ষা রাখেনা, এসব অরুচিকর মন্তব্যের উদ্দেশ্য নিছক সমালোচনা নয়, কবির মর্মমূলে আঘাত করে তাঁকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা মাত্র। মূলত রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার দীপ্তির সঙ্গে পারিবারিক আভিজাত্য, দেবতুল্য দেহকান্তি, পরিশীলিত কণ্ঠস্বরের যে অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল তাতে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিল সেকালের বুদ্ধিজীবীরাও। ফলে তাঁর তীক্ষ্ণ সংবেদনশীলতাকে অনুভব করতে ব্যর্থ হয়ে ফুলের বদলে আগাছা দেখেছেন। যারা সাহিত্যের বিষয়বস্তুকে ভবিষ্যতের আয়নায় দেখতে অপারগ, যারা নতুনকে স্বাগত জানাতে বিমুখ, যাদের মূলধন অপর্যাপ্ত তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ শ্রমকাতুরে বাঙালি যে বিধিবদ্ধ চেতনাতেই অভ্যস্ত।

১৯১২ সালে বিদেশ ভ্রমণের সুবাদে বিশ্বসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ বাড়তে থাকে। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভায় আকৃষ্ট হয় বিদেশিরাও। তাঁকে ঘিরে কোন কোন দেশে গড়ে ওঠে গুণমুগ্ধগোষ্ঠী। এসব খবর স্বদেশের সাহিত্য রসিক বা বেরসিকদের গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছিল। রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক স্বীকৃতি যেন তারা মানতেই পারছিলেন না। এ সময় রবীন্দ্রবিদ্বেষ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের 'আনন্দবিদায়' ব্যঙ্গনাটিকা। রসরাজ অমৃতলাল বসুকে উৎসর্গ করে এর ভূমিকায় লেখা হয়েছিল : 
'এ নাটিকায় কোন ব্যক্তিগত আক্রমণ নাই। 'মি'র প্রতি আক্রমণ আছে। ন্যাকামি, জ্যাঠামি, ভণ্ডামি লইয়া যথেষ্ট ব্যঙ্গ করা হইয়াছে। তাহাতে যদি কাহারও অন্তর্দাহ হয় ত তাহার জন্য তিনি দায়ী। আমি দায়ী নহি। আমি তাহাদের সম্মুখে দর্পণ ধরিয়াছি মাত্র।... একজন কবি অপর কোন কবির কোন কাব্যকে বা কাব্য শ্রেণিকে আক্রমণ করিলে যে তাহা অন্যায় ও অশোভন হয় তাহা আমি স্বীকার করিনা। বিশেষত যদি কোন কবি কোনরূপ কাব্যকে সাহিত্যের পক্ষে অমঙ্গলকর বিবেচনা করেন, তাহা হইলে সেরূপ কাব্যকে সাহিত্যক্ষেত্র হইতে, চাবকাইয়া দেওয়া তাঁহার পক্ষে কর্তব্য....।'
রবীন্দ্র সংগীতের প্যারোডি ছাড়া ওই নাটিকার দু'একটি সংলাপের বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় নাট্যকারের ঈর্ষা কতোটা গভীর : 
'২য় ভক্ত : এই একবার বিলেত ঘুরে এলেই ইনি  P. D. হয়ে আসবেন। 
৩য় ভক্ত : P. D. কী?
২য় ভক্ত : Doctor of poetry 
৩য় ভক্ত : ইংরেজরা কি বাংলা বুঝে যে এর কবিতা বুঝবে? 
৪র্থ ভক্ত : এ কবিতা বোঝার তো দরকার নেই। এ শুধু গন্ধ। গন্ধটা ইংরাজিতে অনুবাদ করে নিলেই হোল।
২য় ভক্ত : তারপর রয়টর দিয়ে সেই খবরটা এখানে পাঠালেই আর Andrew দিয়ে একটা সার্টিফিকেট জোগাড় করলেই P. L.
৩য় ভক্ত : P. L. কী?
২য় ভক্ত : Poet Laureate'

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক একসময় খুবই অন্তরঙ্গ ছিল। হঠাৎ করেই সে সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠার হেতু রবীন্দ্রনাথের উত্থান ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি একজন শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার হয়েও আরেজন শ্রেষ্ঠ কবিকে চিনতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে শুধু পুড়েছেন। তা না হলে 'কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা ফুরাল মরি লাজে'র মতো রবীন্দ্র সংগীতকে 'লাম্পট্যগীতি'র তকমা দিবেন ?

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অপমানের ক্ষত না শুকাতেই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে আগে পণ্ডিতদের কাছে হেনস্থার শিকার হন রবীন্দ্রনাথ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পরীক্ষাতে 'ছিন্ন পত্রাবলী' থেকে একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল :' নিম্মলিখিত অনুচ্ছেদটি শুদ্ধ করে লিখো।' রবীন্দ্রনাথ যেহেতু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না তাই পণ্ডিতবৃন্দ তাঁকে এভাবে অবজ্ঞা করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন ব্যাকরণের কষাঘাতে রবীন্দ্ররচনার ব্যবচ্ছেদ করতে। মজার ব্যাপার হলো, রবীন্দ্রনাথ যখন নোবেল পেলেন তখন সেই পণ্ডিতরাই হামলে পড়ে তাঁর গলায় মালা দিতে গিয়েছিলেন। যদিও তিনি কারও সঙ্গেই দেখা করেননি। এ নিয়ে তেমন প্রতিক্রিয়া না উঠলেও নোবেল জয়ের পর শান্তি নিকেতনে তাঁকে যেদিন সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেদিন তাঁর বক্তব্য শুনে সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে কলকাতায় ফিরেছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর এমন কড়া বক্তব্য অনভিপ্রেত হলেও এত এত অপমানের বিপরীতে এইটুকু রূঢ়তা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি নয়।

মহৎ চরিত্র সৌজন্যের আকর। রবীন্দ্রনাথও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তাঁর এই সৌজন্যতার অপচয় হতো পদে পদে। যে কেউ তাঁর দুর্বলতার সুযোগে নিজেদের কার্যোদ্ধার করে নিতে পারতো অনায়সেই। এ জন্য তাঁকে অযথা ভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে। পত্রিকাগুলো তাঁকে ঘিরে মুখরোচক নানা খবর প্রকাশ করেছে। তিনি খাদ্য, পোশাক, প্রসাধনের ওপর সনদপত্র কেন দেন, ক্লাব লাইব্রেরির অনুষ্ঠানে বাণী কেন পাঠান, অভাজনের ছেলের বিয়েতে, মেয়ের অন্নপ্রাশনে কেন আশীর্বাদ জানান—এসব নিয়ে কোন কোন পত্রিকা সরব থেকেছে অবিরাম। রবীন্দ্রনাথ  পত্রিকাগুলোর এমন একচোখা বিচারে মর্মাহত হতেন।
শান্তি নিকেতনের অধ্যাপক ও ঠাকুরবাড়ির গৃহশিক্ষক নন্দগোপাল সেনগুপ্তের  'কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথ' স্মৃতিকথায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন : 'ওরা বোধহয় ভেবেছে যে, এসব থেকে আমি যৎকিঞ্চিৎ বাণিজ্য করি। নয়তো এত উষ্মার কারণ কি? আমি যে কবি মাত্র সে আমি জানি—কিন্তু দেশের শিল্প-বাণিজ্য থেকে শুরু করে পারিবারিক অনুষ্ঠান পর্যন্ত সর্বত্রই আমার ডাক পড়ে। এটা আমি খুব সৌভাগ্য মনে করি তা না, কিন্তু রূঢ়তার সঙ্গে তো কারুকে ফিরিয়ে দিতে পারিনা। আর তা দিলেও কি ধিক্কারের হাত থেকে অব্যাহতি আছে? চারিদিক জুড়ে হৈ হৈ উঠবে, দেখো, দেখো, রবীবাবুর দেশের প্রতি দরদ নেই—দেশবাসীর প্রতি দাক্ষিণ্য নেই!'

নন্দগোপাল সেনগুপ্তের স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পত্রিকাগুলোর অপপ্রচারের আরও রুদ্ররূপ উঠে এসেছে। কবির সমস্ত প্রচেষ্টাকে হীন প্রতিপন্ন করার অদম্য উৎসাহ নিয়ে কোন কোন পত্রিকা তাদের অসংযত আচরণ করেই যাচ্ছিল। 'জন-গণ-মন অধিনায়ক' গানটি দিল্লীর দরবার উপলক্ষে সম্রাট পঞ্চম জর্জকে উদ্দেশ্যে করে লেখা বলে কোন এক পত্রিকা প্রশ্ন তুলে। আরেকটি পত্রিকা সর্বভারতীয়তার প্রয়োজনে 'বন্দেমাতারাম' গানটির শেষাংশ পরিবর্তনের অনুমোদন দেয়ায় তাঁকে অহিন্দু, দেশদ্রোহী, পিরালি অনেককিছুই বলেছিল। এসব দেখে রবীন্দ্রনাথ একটা অমোঘ অস্বস্তিতে মূষঢ়ে পড়েছিলেন। নন্দলাল সেনগুপ্তকে তা জানিয়েছিলেনও : 
'কোন একটা বিষয়ে যদি মনের মতো চলতে না পারলাম, তাহলেই সারাজীবন যা কিছু করেছি তা ধূলিসাৎ করে দিতেও কারো বাঁধেনা। যৌবনে লিখেছিলাম—সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে—যাবার বেলা ঐ উক্তিটি কেটে দিয়ে যাবো আমার রচনা থেকে।' 
উপরোক্ত কথা না রাখলেও রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন রচনায় বাঙালির প্রতি তাঁর ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন। 'সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি' এই ধরনের খেদোক্তি তার প্রমাণ। দেশের মাটিতে যে তিনি যোগ্যতার নিরিখে সমাদৃত হননি তা তাঁর ভেতর ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হয়ে ওঠেছিল। একদল কুৎসাপরায়ণ স্বার্থান্বেষী তাঁর অনুগ্রহে পুষ্ট হয়ে, তারই বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছে। এদের ক্ষুদ্রতা তাঁকে পীড়িত করলেও তিনি ভেঙে পড়েননি। 

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে বাংলার আকাশ। শোকস্তব্ধ  কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন 'রবিহারা' নামের দীর্ঘ কবিতা। আরও অনেক কবি কবিতায় গানে কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানালেন। কিন্তু এরই মধ্যে বাঙালির বর্বরদশার চূড়ান্ত ছবি ভেসে ওঠলো। কবির শবযাত্রায় কিছু অশিষ্ট ও গোঁড়া লোক এমন কাণ্ডের সৃষ্টি করল যা অনেকের কাছে ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়ে রইলো। সত্যজিৎ রায়ের সহধর্মিণী বিজয়া রায় সেই রোমহর্ষক দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনী 'আমাদের কথা'য় লিখেছেন :
'কাঁধের উপর খাট বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন বহু বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে দেহটাকে পেয়ে যা কাণ্ড করছিল, ভাবতে আজও আমার মাথা লজ্জায় নুয়ে আসে। হাত- পা ধরে টানা, দাড়ি ছেঁড়া, চুল ছেঁড়া, শোকে সবাই যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। এরকম একজন মানুষের প্রতি কোথায় শ্রদ্ধা জানাবে, তা না করে এরকম বর্বরতা যেন কল্পনা করা যায়না। আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছিল। আর দেখতে পারলাম না। বললাম, এভাবে তো ওঁর দেহ শ্মশানে পৌঁছাতেই পারবে না। পরে অবশ্য পুলিশের সাহায্যে দেহ অক্ষত অবস্থায় না হলেও শ্মশানে পৌঁছাতে পেরেছিল।' 
রবীন্দ্রনাথ যদি জানতেন বাঙালি তাঁর শেষ বিদায়ের মুহূর্তে পাশবিকতার পরিচয় দেবে, তবে নিশ্চয়ই তাঁর মৃত্যু পরবর্তীতে করণীয় কি তা ঠিক করে যেতেন। কিন্তু তিনি জীবিতকালে হয়তো ভাবতেই পারেননি যে, তাঁর মৃতদেহ নিয়ে এমন হুলস্থূল পড়ে যাবে।

ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে 'হিন্দু কবি'র ঘোষণা দিয়ে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধকরণ প্রকল্প হাতে নেয়। ইকবাল ও নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধনের ভিত পাকা করতে সচেষ্ট হয়। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনে বাঁধা প্রদান করে রবীন্দ্র বিরোধিতা সূচনা করে পাকিস্তান সরকার।  ১৯৬৭ সালে কাগজে কলমে তা গৃহীত হয়। এ সময় গভর্নর মোনায়েম খাঁ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাইকে তার বাসভবনে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আপনি রবীন্দ্র সংগীত লিখতে পারেন না?' অধ্যাপক হাই এরকম অবান্তর প্রশ্নে সংকুচিত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন,'আমি রবীন্দ্র সংগীত লিখব কীভাবে? আমি লিখলে সেটা হবে হাই সংগীত!'

এভাবেই যখন রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি মুসলমানের মন থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছিল, তখন একদল মুক্তচিন্তার মানুষ তা রুখে দিয়ে সোনালি ভোরের স্বপ্ন এঁকেছিল। কিন্তু সেই সোনালি ভোর আজও ধরা দেয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কটুকাটব্য থামেনি। 'রবীন্দ্রনাথ মুসলমানবিরোধী', 'রবীন্দ্রনাথ নজরুলের লেখা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন', 'রবীন্দ্র সংগীত নকল', 'রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন' এমন সব উড়ো কথায় সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের  পর্দা। প্রকৃতপক্ষে এসবের কোনটির পক্ষেই কেউ যথার্থ প্রমাণ দিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের বিপক্ষে লিখেছেন আর হিন্দুর পক্ষে লিখেছেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের দিকেই কলম তুলেছেন তাদের কুসংস্কারবৃত্তিকে কটাক্ষ করে। যেমন করে নজরুলও তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের লেখা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন, এই কথার মতো ভিত্তিহীন কথা আর দ্বিতীয়টি নেই। রবীন্দ্র সংগীত নকল এরকম কুতর্ক করার আগে জানতে হবে সংগীতের ধারা সম্পর্কে, সংগীত না জেনেই সংগীতবিশারদ সেজে ক্ষণিকের তরঙ্গ ওঠানো মোটেও ভদ্রোচিত কাজ নয়। রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছেন এই খবর কোথা থেকে এল, তার কোন হদিস আজও পাওয়া যায়নি। 'মুর্খের দেশে আবার কিসের বিশ্ববিদ্যালয়' এ ধরনের একটি অসত্যও উঠতি প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনে এরকম কোন বাক্য তিনি বলেননি বা রচনাও করেননি। এসব রবীন্দ্রনাথকে অপমানিত করার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।

১৯৩১ সালে ৭০ বছর বয়সে খ্যাতির চূড়ায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ জন্মদিনের শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তরে তাঁর ভেতর জমে থাকা আজীবনসঞ্চিত এক বেদনার উল্লেখ না করে পারেন নি:
'খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে যে গ্লানি এসে পড়ে, আমার ভাগ্যে অন্যদের চেয়ে তা অনেক বেশি আবিল হয়ে উঠেছিল। এমন অনবরত, এমন অকুণ্ঠিত, এমন অকরুণ, এমন অপ্রতিহত অসম্মাননা আমার মতো আর কোন সাহিত্যিককেই সইতে হয়নি।'
আজ ৯০ বছর পরও রবীন্দ্রনাথের সেই অপমানদগ্ধ কথামালার প্রাসঙ্গিকতা ফুরোয় নি। পরনিন্দা ও পরচর্চার একটি ধারা যে বাঙালি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিচারবুদ্ধিবলে রবীন্দ্রকীর্তির মূল্যায়ন না করে, তাঁর সমগ্র রচনাকে তলিয়ে না দেখে, তাঁকে দার্শনিকতার দণ্ডে না মেপে অপোগণ্ডের মতো কেবল ছিদ্রান্বেষণ করে বাঙালি যে পরমানন্দলাভ করে তা দিবালোকের মতো সত্য।

গ্রন্থপঞ্জি 
১. রবীন্দ্র-বিদূষণ ইতিবৃত্ত, আদিত্য ওহদেদার
২. রবীন্দ্র প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের পঁচিশোত্তর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংকলন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
৩. কাছের মানুষ রবীন্দ্রনাথ, নন্দগোপাল সেনগুপ্ত 
৪. আমাদের কথা, বিজয়া রায় 
৫. এলোঝেলো, বুদ্ধদেব গুহ
৬. ধ্রুবপদ রবীন্দ্র সংখ্যা (কবিকে নিয়ে কার্টুন, শোভন অধিকারীর প্রবন্ধ)
৭. শ্বাশ্বতিকী, রবীন্দ্র সংখ্যা, ২০১১

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank