ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১১]
ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১১]
১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন |
[পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার] [পর্ব- পাঁচ] [পর্ব-ছয়] [পর্ব- সাত] [পর্ব-আট] [পর্ব-নয়] [পর্ব-দশ]
পর্ব- এগারো
আরও একবার গোটা ক্যান্টিনে চোখ ঘুরিয়ে নিলো উইনস্টন। প্রায় প্রত্যেকেরই চেহারা কুৎসিত, নীল ওভারঅল ছাড়া অন্য কিছু পরলেও এদের এমন কুৎসিতই দেখাতো। কক্ষের দূরের দিকটাতে একটি টেবিলে একা বসে দুঁদে মাছির মতো দেখতে একজন কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর সন্দেহভরা চোখ দু'টি এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছেন। পার্টি তার কর্মীদে জন্য যে শারীরিক গঠন নির্ধারন করে দিয়েছে- লম্বা, পেশিবহুল যুবক, গভীর-বক্ষা, উজ্জ্বল চুলের নারী, রোদে পোড়া, বেপরোয়া ভাব- নিজের দিকে না তাকালে বিষয়টি এমনই এবং ভালো করেই তা বর্তমান বলে বিশ্বাস হয় উইনস্টনের কাছে। কিন্তু বাস্তবিক হচ্ছে, যতটা তার বিচারবুদ্ধি বলে, এয়ারস্ট্রিপ ওয়ানের অধিকাংশ মানুষই এখন বেটেখাটো, কালো আর অবহেলিত। কৌতুহলের বিষয় এই মাছি-আকৃতির মানুষটি মন্ত্রণালয়ের কাজে কিভাবে ঢুকে পড়লো? বেটে মোটা মানুষগুলো, জীবনের গোড়ার দিকেই গায়ে মেদ জমিয়ে ফেলে, খাটো খাটো পায়ে দ্রুত-হন্তদন্ত হাঁটে, আর তাদের ভোমা-দুর্বোধ্য মুখমণ্ডলে কুঁতকুঁতে চোখ। দলের প্রতিপত্তির মতো করে এই ধরনের মানুষগুলোর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।
আরেকবার তুর্যধ্বনি বাজিয়ে প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা শেষ হলো আর শুরু হলো ধাতব সুরের সঙ্গীত। পরিসংখ্যানের ধামাকায় এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকার পর এবার মুখ থেকে পাইপটি বের করে আনলো পারসন্স।
‘প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় এবার নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করেছে,’ যেনো খুব বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিমায় মাথাটি নাড়াতে নাড়াতে বললো সে। ‘আরে শোনো স্মিথ, বুড়ো খোকা, আমার ধারনা তোমার কাছে আমাকে দেওয়ার মতো একটাও রেজর ব্লেড নেই!’
‘একটিও না,’ বললো উইনস্টন। ‘গেলো ছয় সপ্তাহ ধরে আমি একটাই ব্লেড ব্যবহার করছি’
‘ঠিক আছে- ঠিক আছে- ভাবলাম তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি, বুড়ো খোকা।’
‘দুঃখিত,’ বললো উইনস্টন।
মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার সময় সাময়িক বন্ধ থাকা প্যাঁকপ্যাঁক কন্ঠস্বরটি ফের চালু হয়েছে, আগের মতোন সমান সশব্দে। কি কারণেই যেনো উইনস্টনের ভাবনায় এলো মিসেস পারসন্সের কথা। তার ফাঁপা চুল আর মুখের ভাজে ভাজে জমে থাকা ময়লার আস্তর চোখে ভেসে উঠলো। দুই বছরের মধ্যে তার সন্তানেরা তাকে থট পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে আর মিসেস পারসন্স বাষ্পায়িত হয়ে যাবে। অন্যদিকে, পারসন্স কখোনোই বাষ্পায়িত হবে না। সাইমকে বাষ্পায়িত করা হবে। উইনস্টনকে বাষ্পায়িত করা হবে। ও’ব্রায়েনকে বাষ্পায়িত করা হবে, কিন্তু পক্ষান্তরে পারসন্সকে কখনোই বাষ্পায়িত করা হবে না। এই চক্ষুহীন, হংসকণ্ঠের জন্তুটি কখনোই বাষ্পায়িত হবে না। দুঁদে মাছির মতো দেখতে মানুষগুলো, যারা মন্ত্রণালয়ের গোলকধাঁধার মতো বারান্দাগুলোতে ভন ভন করে ঘুরছে, ওদেরও কখনোই বাষ্পায়িত করা হবে না। আর কালো চুলের মেয়েটি, ফিকশন ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি- ওদেরও কখনোই বাষ্পায়িত করা হবে না। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কে টিকে থাকবে আর কে অন্তিম পথের যাত্রী হবে: যদিও টিকে থাকার কারণটি কি তা নিশ্চিত করে বলা সহজ নয়। মস্তিষ্কে প্রকাণ্ড একটা ঝাঁকুনি বোধ করে দিবাস্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরলো সে। পাশের টেবিলের মেয়েটি ইষৎ ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই সেই কালোকেশী। একপাশ থেকে কৌণিক দৃষ্টি ফেলে সে তাকিয়ে উইনস্টনের দিকে, গভীর কৌতুহলভরা সে চাহুনি। চোখাচোখি হতেই মেয়েটি দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো।
উইনস্টনের মেরুদণ্ড বেয়ে ঘাম নেমে গেলো। ভীষণ এক ভীতি বয়ে গেলো তার শরীরের ভেতর দিয়ে। খুব দ্রুত তা চলেও গেলো বটে তবে মনে এক ধরনের অস্বস্তির অনুভূতি রেখে গেলো। মেয়েটি কেনো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো তাকে? কেনো সে সারাক্ষণই তাকে অনুসরণ করছে? দুর্ভাগ্যজনক যে, সে যখন পৌঁছায় তখন মেয়েটি এই টেবিলে বসেছিলো, না কি পরে এসে বসেছে তা উইনস্টন স্মরণ করতে পারছে না। কিন্তু গতকালও দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচির সময় মেয়েটি তার ঠিক পেছনে বসে পড়ে, যার আসলে কোনোও প্রয়োজন ছিলো না। বোঝাই যায় তার আসল উদ্দেশ্য ওর কথা শোনা এবং পর্যাপ্ত জোরে সে চিৎকার করছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া।
পুরোনো চিন্তা আবার ফিরে আসে উইনস্টনের মন জুড়ে: মেয়েটি থট পুলিশের সদস্য হবে বলে তার মনে হয় না, তাহলে হতে পারে সে শখের গুপ্তচর, সবার জন্যই যে বড় বিপদের কারণ। তার জানা নেই, কতক্ষণ ধরে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, হতে পারে পাঁচ মিনিট ধরেই, আর এও সম্ভব পুরো সময়ই নিজের সকল অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলো উইস্টন। জনসমক্ষে কিংবা টেলিস্ক্রিনের আওতার মধ্যে থেকে চিন্তাজগতকে উদ্দেশ্যহীন পথে হাঁটতে দেওয়ার বিপদ ভয়ঙ্কর। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনও বিষয়ই আপনাকে বিপদে ফেলে দেবে। একটা সামান্য স্নায়ুবিক খিচুনি, একটি অবচেতন উদ্বেগের দৃষ্টি, স্বগোতোক্তির অভ্যাস- যে কোনোটা অস্বাভাবিক কিছু একটা নির্দেশ করে, ধরেই নেওয়া হবে, আপনি কিছু লুকোতে চাইছেন। একটি বেঠিক মুখোভঙ্গির (যেমন ধরুন কোনও যুদ্ধ জয়ের ঘোষণার সময় আপনাকে নিস্পৃহ দেখাচ্ছে) প্রকাশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এনিয়ে নিউস্পিকে একটি শব্দও রয়েছে, যাকে বলে ফেইসক্রাইম।
মেয়েটি তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসলো। হতে পারে মেয়েটি আদতে তাকে অনুসরণ করছেই না। হতে পারে পরপর দুই দিন তার কাছাকাছি মেয়েটির বসা স্রেফ ঘটনাক্রমেই ঘটে যাওয়া। উইনস্টনের সিগারেট নিভে গেছে। অতি সতর্কতায় সেটি টেবিলের এক কোনায় রাখলো। ভেতরের তামাকগুলো ধরে রাখতে পারলে কাজের শেষে ওটি আবার ধরাবে। হতেই পারে পাশের টেবিলের মেয়েটি থট পুলিশের চর, আর এও হতে পারে তিন দিনের মধ্যেই তার স্থান হবে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের গরাদের ভেতর। কিন্তু তাই বলে একটি সিগারেটের গোড়া নষ্ট করার কোনও মানে থাকতে পারে না। সাইম তার হাতের কাগজটি ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। পারসন্স ফের বকবক শুরু করেছে।
‘তোমাকে বলেছি নাকি, বুড়ো খোকা,’ পাইপের গোড়া চেপে ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো সে, ‘আমার পাজি দুটো পুরান বাজারের এক মহিলার স্কার্টে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। ওরা দেখতে পেলো মহিলাটি বি.বি’র একটি পোস্টার ছিঁড়ে সসেস পেঁচিয়ে নিচ্ছে। সন্তর্পণে ওর ঠিক পেছনে গিয়ে দেয়াশলাই ঠুকে দিলো আগুন ধরিয়ে। আমার ধারনা, ভালোই পুড়েছে। ছোট দুই পাঁজি! তবে বেশ চটপটে। স্পাইজে আজকাল ওরা প্রথম পর্যায়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে- ভালোই আমাদের সময় এমন প্রশিক্ষণ পাইনি। তুমি কি জানো, ওদের কাছে কি আছে? চাবির ছিদ্র দিয়ে কথা শুনার এক ধরনের শ্রবনযন্ত্র পার্টি ওদের দিয়েছে। এক রাতে আমার কন্যা ওগুলোর একটি বাড়িতেও নিয়ে এসেছিলো- আমাদের বসার ঘরের দরজা থেকে পরীক্ষা করে দেখেছে, বললো খালি কানে যতটুকু শুনতে পায় এর শব্দ তার দ্বিগুন। অবশ্যই এটি খেলনা বৈতো নয়, তারপরেও এতেই কাজ দিচ্ছে, ওরা ঠিক ঠিক ধরে ফেলতে পারছে।
ঠিক এই সময়ে টেলিস্ক্রিনে কানফাটা সিটি বেজে উঠলো। কাজে ফিরে যাওয়ার সংকেত। টেবিলের তিনজনই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো, লিফটের কাছে পৌঁছানোর লড়াইয়ে সামিল হতে। আর অমনি উইনস্টনের সিগারেটের শেষাংশের তামাকগুলো ঝুরঝুর করে নিচে পড়ে গেলো।
ষষ্ঠ অধ্যায়
ডায়রি লিখছিলো উইনস্টন।
তিন বছর আগের কথা। কোনও এক সন্ধ্যার অন্ধকারে, বড় রেলওয়ে স্টেশনের কাছাকাছি একটি সরু গলির ভেতর দেয়াল ঘেঁষে দরজাপথের পাশেই সড়কবাতির নিচে দাঁড়িয়েছিলো মেয়েটি। এই গলির সড়কবাতিগুলো কদাচই আলো দিতো। তরুণী-মুখ, গাঢ় রং মাখা। এই রংটির সত্যিই একটা আবেদন আমার কাছে ছিলো, এর সাদাটেরূপ, ঠিক মুখোশের মতো, আর লাল-উজ্জ্বল ঠোঁট। পার্টির মেয়েরা তাদের মুখে রঙ মাখায় না। সেই সন্ধ্যার সড়কে আর কেউই ছিলো না, কোন টেলিস্ক্রিন ছিলো না। মেয়েটি বললো.. দুই ডলার। আমি-
ওই মূহূর্তে লেখা চালিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন মনে হলো। চোখ দুটি বন্ধ করে আঙ্গুল চেপে ধরলো সে। দৃশ্যটি ভাবনা থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেটাই ঘুরে ঘুরে আসছে। তার মনে হচ্ছিলো নোংরা ভাষায় গালি-গালাজ করে, দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠোকে নয়তো কালির দোয়াতটা জানালা দিয়ে সজোরে বাইরে ছুড়ে দেয়- সহিংস কিংবা বেদনাদায়ক কিছু একটা করে, হৈচৈ হট্টগোল বাঁধিয়ে দেয় যাতে স্মৃতি থেকে সরে যায় সবকিছু।
স্নায়ুতন্ত্রটিই আসলে সবচেয়ে বড় শত্রু। যে কোনো ক্ষণেই আপনার ভেতরের দুশ্চিন্তাটা কিছু একটা বাহ্যিক লক্ষণ হয়ে আপনার ওপর ক্রিয়া করতে থাকবে। এবার তার মাথায় এলো সপ্তাহ কয়েক আগের এক স্মৃতি। রাস্তায় উল্টো দিক থেকে আসছিলো একজন। অতিসাধারণ দেখতে, দলেরই সদস্য। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ, লম্বাটে-পাতলা গড়নের, হাতে ব্রিফকেস। দুজনের মধ্যে যখন কয়েক মিটারের দূরত্ব, তখন হঠাৎই তার মনে হলো লোকটির মুখমণ্ডলের বাম দিকটা খিচে ভেঙ্গেচুড়ে যাচ্ছে। এরপর ঠিক যখন দুজন-দুজনকে অতিক্রম করে গেলো তখনও একই ব্যাপার দেখতে পেলো। ঘটনাটি এক লহমার, ঠিক যেমন বিদ্যুৎ ফড়কানো কিংবা শিহরণ জাগানোর মতো কিছু একটা। ক্যামেরার ক্লিকে শাটার পড়ার মতোই ক্ষণস্থায়ী। তখনই তার মনে হয়েছিলো এই বেচারা তো মহাবিপদে আছে। বিপদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপদ ঘুমের মাঝে বকা। যতটা সে বুঝতে পারে, এ থেকে মুক্তি নাই।
গভীর শ্বাস নিয়ে আবার লিখতে শুরু করলো সে:
আমি তার সঙ্গে দরজাপথ পেরিয়ে পেছনের আঙ্গিনা ধরে বেজমেন্টের একটি রান্নাঘরে ঢুকলাম। দেয়ালে লাগোয়া একটি বিছানা পাতা, টেবিলের ওপর একটি বাতি জ্বলছে মৃদু আলোতে। মেয়েটি-
দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো সে। মনে হলো থুঁতুর পিচকিরি ছিটাবে। তখনই বেজমেন্টের রান্নাঘরের সেই নারীর পাশাপাশি তার মনোজগতে এসে হানা দিলো ক্যাথরিন, তার স্ত্রী। উইনস্টন বিবাহিত ছিলো, একটা সময় পর্যন্ত বিবাহিত ছিলো, সম্ভবত এখনও সে বিবাহিত, যদ্দুর জানে, তার স্ত্রী এখনও মারা যায়নি। আবারও যেনো বেজমেন্টের রান্নাঘরে গুমোট গরম আবহাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে সে, ছারপোকা, নোংরা কাপড়, সস্তা সুগন্ধীর মিশ্রনে এক উদ্ভট গন্ধ, তবে সম্মোহনী, কারণ পার্টির মেয়েরা কখনোই সুগন্ধী মাখে না, এমনকি মাখার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কেবল প্রোলরাই সুগন্ধী মাখে। তার মনে ব্যাভিচারের ভাবনার সঙ্গে ওই গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।
মেয়েটির সঙ্গে যখন গেলো সেটি ছিলো ওই সময়ে অন্তত দুই বছরের মধ্যে তার প্রথম স্খলন। পার্টিতে পতিতাগমন নিষিদ্ধ। তবে এটিও সেইসব নীতির একটি যা মাঝেমধ্যে ভাঙ্গার সাহস করা যায়। ধরা পড়লে বিপদ আছে। কিন্তু এটি জীবন-মরণ কোনও বিষয় নয়। গণিকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলে, যদি অন্য কোনো অপরাধে সম্পৃক্ততা না থাকে, বাধ্যতামূলক শ্রম ক্যাম্পে আপনার পাঁচ বছরের অন্তরীণ জীবন, এতটুকুই সাজা, এর বেশি নয়। আবার আইনের চোখ বাঁচিয়ে কাজটি করাও কঠিন কিছু নয়। অপেক্ষাকৃত গরীবদের কোয়ার্টারগুলোতে নারীরা নিজেদের বেচতে প্রস্তুত হয়ে থাকে। এমনকি এক বোতল জিনের বিনিময়েই ওরা আপনার ভোগের পণ্য হয়ে বিকোয়। প্রোলদের জন্য জিন নিষিদ্ধ বলেই হয়তো আরও সহজ। কৌশলে দলই পতিতাবৃত্তিকে উৎসাহিত করে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলো অবদমন করে রাখার চেয়ে সেগুলো মিটিয়ে ফেলার একটি পথ রাখতেই হয়। ছোট ছোট পাপস্খলণ বড় কিছু নয়। বিশেষ করে যখন তা গোপনে-নিরানন্দে ঘটে চলে, আর তাতে জড়িত থাকে কেবলই নিম্নস্তরের ঘৃণিত নারীরা। দলের সদস্যদের জন্য প্রকীর্ণতা ক্ষমার অযোগ্য। আর এটি এমন এক অপরাধ যে বিচারের মুখে অভিযুক্তকে তা স্বীকার করে নিতেই হয়- সুতরাং অনেকেই এমন অপরাধ সংগঠনের কথা চিন্তায়ও আনে না।
পার্টির উদ্দেশ্য কিন্তু স্রেফ নারী ও পুরুষদের এমন একটি নীতির প্রতি অনুগত করে তোলা নয়; বরং প্রকৃত এবং অঘোষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌনকর্মের যে আনন্দ তা বিলীন করে দেওয়া। ভালোবাসা নয়, এখানে যৌনকামনাই শত্রু, হোক তা বিবাহভুক্ত কিংবা বহির্ভূত। দলের সদস্যদের মধ্যে বিয়ে হতে হলে এ জন্য গঠিত কমিটির অনুমোদন লাগে। নীতির বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ঘোষণা নেই; তবে পাত্র-পাত্রীকে শারীরিকভাবে আকৃষ্ট মনে হলে বিয়ের অনুমতি মেলে না। বিয়ের একমাত্র স্বীকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে দলের সেবায় শিশুর সংখ্যা বাড়িয়ে চলা। প্রশ্রাবদ্বারে সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ ঢোকানোর মতো একটি বিরক্তিকর কাজ হিসেবেই দেখা হয় যৌনমিলনকে। কথাগুলো সরাসরি হয়তো কোথাও বলা হয় না, কিন্তু দলের সদস্যদের শিশু বয়স থেকেই যৌনতার প্রতি আগ্রহ ঘষে ঘষে মুছে দেওয়া হয়। জুনিয়র এন্টি সেক্স লিগের মতো কিছু সংগঠন রয়েছে যারা নারী-পুরুষ উভয়কেই পুরোপুরি কৌমার্যের পথে ধরে রাখতে কাজ করছে। শিশুদের জন্ম হচ্ছে কৃত্রিম পরিনিষেকে (আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন, নিউস্পিকে যাকে বলা হয় আর্টসেম) আর বেড়ে উঠছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। এটাই, উইনস্টন জানে সবমিলিয়ে হয়তো ঐকান্তিকভাবে কাজটি হচ্ছে না, তবু কোনও না কোনওভাবে এটাই দলের সাধারণ আদর্শ। যৌনতায় আগ্রহকে হত্যা করতে চায় দল, অথবা, হতে পারে হত্যা নয়, এর একটা বিকৃত রূপ দিতে চায়, নোংরা করে তুলতে চায়। সে জানে না, কেন এমনটি করা হচ্ছে, তবে মনে হচ্ছে এটাই হওয়া উচিত। আর যখন বিষয়টিতে নারীরা সম্পৃক্ত, দলের এই প্রচেষ্টা যথেষ্ঠই সফল।
আবারও চিন্তাজগতে ক্যাথরিনের প্রবেশ। নয়-দশ বছর হবে, এগারোও হতে পারে, তারা আলাদা হয়ে গেছে। কৌতুহলের বিষয়, কদাচই সে তার কথা ভাবে। কখনো দিনের পর দিন সে ভুলেই বসে থাকে যে একদা তার বিয়ে হয়েছিলো। তারা একসঙ্গে ছিলো পনেরো মাসের মতো। দল তালাকের অনুমতি দেয় না, বরং বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে আলাদা থাকার বিষয়টিকেই উৎসাহিত করে।
ক্যাথরিন লম্বা গড়ণের, সুন্দর চুলের মেয়ে, অসাধারণ দেহ সৌষ্ঠব। ঈগলসদৃশ দৃঢ়-বাঁকানো চেহারা, যা দেখলে যে কেহই বলবে ‘অনন্যা’, অন্তত যতক্ষণ না তারা বুঝবে এর ভেতরটা ফাঁপা। বিবাহিত জীবনের খুব গোড়াতেই সে বুঝে ফেলেছিলো- যদিও তুলনা করে দেখার মতো অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গেই তার খুব একটা ঘনিষ্টতা কখনোই হয়নি- তার পরেও যতজন দেখেছে তার মনে হয়েছে, সন্দেহাতীতভাবেই এই মেয়েটি তাদের মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধ, ফালতু আর শুণ্যমনা। পার্টির স্লোগানের বাইরে তার মাথায় আর কিছু নেই। দলের কথা মনের মধ্যে ধরে রাখতে না পারার মতো এতটা নিবুর্দ্ধিতা আর কারো মধ্যে দেখা যাবে না। মনে মনে সে তার নাম দিয়েছিলো ‘মানব শব্দযন্ত্র’। তারপরেও তার সঙ্গে বসবাস চলতো যদি সহবাসের বিষয়ে তাদের বনিবনাটা হয়ে যেতো।
তাকে ছুঁলেই কুঁকড়ে শক্ত হয়ে যেতো। তাকে জড়িয়ে ধরা আর একটি কাঠের পুতুলকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলো না। আরও অদ্ভুত ছিলো- যখন তাকে কাছে টানতো, তখন মনে হতো ও যেনো প্রাণপণে তাকে দূরে ঠেলছে। তার শক্ত হয়ে থাকা নির্লিপ্ত পেশিগুলো অন্তত সেই বার্তাই দিতো। না ছিলো প্রতিরোধ, না সহযোগিতা। কেবল চোখ বন্ধ করে নিজেকে সমর্পন করে শুয়ে থাকতো। বিষয়টি ছিলো অস্বাভাবিকরকম বিরক্তিকর, আর কিছুক্ষণ পর তা হয়ে উঠতো ভয়াবহ অসহনীয়। তারপরেও মেনে নিয়ে একসঙ্গে থাকা যেতো যদি তারা দুজনই কৌমার্য ধরে রাখার ব্যাপারে একমত হতে পারতো। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ক্যাথরিনই তাতে বাঁধ সাঁধলো। সে বললো, সম্ভব হলে তারা অবশ্যই একটা বাচ্চা নেবে। সুতরাং কাজটি ওভাবেই চললো। একেবারেই অসম্ভব হয়ে না পড়লে সপ্তাহে একদিন, নিয়ম করেই চলতো। সপ্তাহের দিনটি এলেই সকালেই মনে করিয়ে দিতো সন্ধ্যার কাজটির কথা। এ জন্য দুটি কথা ব্যবহার করতো ও- একটি ছিলো ‘সন্তান পয়দার কাজ’ অন্যটি ‘দলের প্রতি দায়িত্ব’ (সত্যি এই দুটি কথাই সে বলতো)। যখনই নির্দিষ্ট দিনগুলো আসতো উইনস্টনের ভেতর একটি ইতিবাচক শঙ্কার অনুভূতি কাজ করতো, তবে ভাগ্যক্রমে সন্তান আগমনের খবর মিলতো না। আর অবশেষে দু'জনই এই প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দেওয়ার বিষয়ে একমত হলো। আর এর কিছু দিনের মধ্যেই তারা আলাদা হয়ে গেলো।
একটা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেললো উইনস্টন। কলম তুলে নিয়ে ফের লিখতে শুরু করলো:
আচমকা মেয়েটি নিজেকে বিছানায় ছুড়ে দিলো, কোনো ধরনের রাগমোচনের প্রস্তুতি ছাড়াই, কল্পনাতীত বিভৎসতায় সে তার স্কার্টটি উপরে তুললো। আমি-
সে দেখছে, সে যেনো বাতির মৃদু আলোয় দাঁড়িয়ে, নাসিকারন্দ্রে এসে লাগছে ছারপোকার গন্ধ, সস্তা সুগন্ধী। আর হৃদয়খানি বিদীর্ণ হচ্ছে পরাজয়ের গ্লানি ও অপরাধবোধে। এরই মাঝে ভাবনা জগতে এসে মিশলো ক্যাথরিনের ধবল দেহখানি, পার্টির সংবেশন ক্ষমতায় যা চিরতরেই বরফহীম হয়ে গেছে। সবকিছুই এমন কেনো হবে? কেনো তার জন্য নিজের একজন নারী থাকবে না। কেনো তাকে বছরের বিরতিতে এমন ঘৃণ্য নোংরা নারী সান্নিধ্যে আসতে হবে? একটি সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্ক মোটামুটি অচিন্তনীয় বিষয়। পার্টির নারীগুলো সবই একই রকম। পার্টির প্রতি আনুগত্যের মতোই কৌমার্য্যরে শুদ্ধতার বিষয়টি তাদের মনের গভীরে প্রোথিত। সতর্ক বাল্যশিক্ষায়, খেলায়, শীতল স্নানে, স্কুলের পাঠে, স্পাইজে, ইউথ লিগে, বক্তৃতায়, মিছিলে, গানে, স্লোগানে, যন্ত্রগীতে সবকিছুর মধ্য দিয়েই বিষয়টি তাদের মধ্যে চালিত। এতে তাদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অনুভূতিগুলোই গেছে মরে। তার যুক্তিগুলো বলছে, কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু হৃদয় মোটেই তা বিশ্বাসে রাজি নয়। এরা সব অজেয়, ঠিক যেমনটি দল চায় তেমনভাবেই অলঙ্ঘনীয়। আর সে কি চায়! সে ভালোবাসা চায় না, বরং জীবনে একটি বার হলেও সে এই শুদ্ধতার দেয়ালটি ভেঙ্গে দিতে চায়। যৌনতা, সাফল্য দুইই এখানে বিদ্রোহের নামান্তর। এখানে ইচ্ছা বা প্রত্যাশার নাম চিন্তাঅপরাধ। এমনকি একবারও যদি শয্যায় সঙ্গমে সে যৌনাবেদনে জাগরুক এক ক্যাথরিনকে পেতো তা হয়ে যেতো শ্লীলতাহানি, অথচ সেতো তার স্ত্রীই ছিলো।
যাইহোক গল্পের পরের অংশ লেখা হলো ডায়রিতে। সে লিখলো:
আমি বাতির সলতেটা বাড়িয়ে দিলাম। আর তখন আমি মেয়েটিকে আরো আলোয় দেখতে পেলাম-
অন্ধকার কেটে গেলে হারিকেনের দুর্বল আলোকেই বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। এই প্রথম সে মেয়েটিকে ঠিক মতো দেখতে পেলো। এক পা মেয়েটির দিকে এগিয়ে ফের থমকে দাঁড়ালো, তার মধ্যে তখন কামলিপ্সার সহিংস রূপ। ঠিক যে কাজটি সে করতে যাচ্ছে তা নিয়ে বেদনার্তভাবেই আবার সে সচেতনও। খুবই সম্ভব, বের হওয়ার পথেই টহলদাররা তাকে ধরে ফেলবে; হতে পারে এ জন্য তারা এরই মধ্যে বাইরে অপেক্ষমান। এখানে যে কাজে সে এসেছে তা না করেও যদি এখুনি বের হয়ে যায় তাহলেও!
একটু দ্রুতই লিখে চলেছে সে, সেই একই অবিন্যস্ত হাতের লেখায়:
আমি বাতির আলোতে দেখতে পেলাম স্রেফ একটা বুড়ি, নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ বছরতো হবেই। কিন্তু আমি এগিয়ে গেলাম। এবং যা করার ঠিক তাই করলাম।
আবারও চোখের ওপর আঙুলগুলো চেপে ধরলো সে। অবশেষে কথাগুলো লিখে ফেলেছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সেই যে নোংরা ভাষায় চিৎকার করে বলার তীব্র বাসনা তা তীব্রতর হলো।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই