ধারাবাহিক উপন্যাস
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৬
ধারাবাহিক উপন্যাস
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৬
১০.
লতা।
শহরে থাকত বলে তাকে জীবনানন্দের বনলতা বলা যাবে না। শুধুই লতা। কিন্তু মুখ তার জীবনানন্দের বনলতার মতো। যেন শ্রাবস্তীর কারুকার্য। একদম কাটা কাটা সুন্দরী না। কিন্তু তার ভেতরে কি যেন ছিল। বিশেষ করে মুখটা। মুখ জুড়ে হালকা বিষন্নতার আভা। কিন্তু সেই বিষন্নতা তার চেহারায় একটা অন্যরকম ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে।
আতিকের চেয়ে এক ইয়ার নিচে পড়ত লতা। ইউনিভার্সিটির হলেই থাকত।
থার্ড ইয়ারের ঘটনা।
অর্থাৎ আতিক তখন থার্ড ইয়ারে পড়ত। তখনকার।
লতা ছিল সেকেন্ড ইয়ারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা হওয়ার ফার্স্ট ইয়ারেই হয়ে যায়। নতুন ব্যাচের মেয়েদের ওপরের ক্লাসের ভাইয়েরা বুক করে ফেলে। ফার্স্ট ইয়ার শেষ হতে হতে হাতে গোনা দু-চারজন ছাড়া কোনও মেয়ে বাকি থাকে না।
যারা বাকি থাকে তারা হয় প্রেমের ব্যাপারে আগ্রহি না। মা-বাবার পাত্রের প্রতি তাদের অগাধ আস্থা। বাবা-মা যাকে এনে সামনে দাঁড় করাবে তার গলাতেই ঝুলে পড়বে। কিছু আছে আগে থেকেই অন্য কারও সাথে গিট্টু দেয়া থাকে। যে গিট্টু তারা ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত নিয়ে আসে।
আর কিছু আছে তারা দেখতে এমনই যে সহসা প্রেম হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাদের জন্য উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা লাগবে। তারা আছে উদ্ধারকারী জাহাজের অপেক্ষায়।
লতা যে ধরনের মেয়ে সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত তার ফাঁকা থাকার কথা না। খোঁজ-খবর করে জানা গেলো লতা ফাঁকাই আছে। ক্যাম্পাসে অতীত প্রেমের কোনও ইতিহাসও তার নেই।
আতিকুল হক ভীতু টাইপ ছেলে।
ভীতু টাইপ ছেলেদের মনে প্রেম বেশি থাকে। তাদের মনে প্রেম যত গভীর হয় বুকে ভয়ও তত বাড়ে। মাঝে মধ্যে অবশ্য এ ধরণের কেউ কেউ দুঃসাহসি হয়ে ওঠে। তখন স্বভাবের বাইরে গিয়ে তারা কিছু একটা করে ফেলে। তবে সে হার খুব কম।
আতিকুল হক বেশির দলে।
লতার প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগলো আতিকুল হক। ভালোবাসার লতায় সে চারদিক থেকে পেঁচিয়ে পড়ল।
কিন্তু লতাকে বলার মতো সাহস তার নেই। নিরাপদ দূরত্ব রেখে লতার পিছনে ঘুরঘুর করে সে। দূর থেকে তাকে দেখে। লতার পেছনে ঘুরে ঘুরে তার তেল দেয়া চুলও উসকো খুসকো হয়ে যায়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না।
আতিকুল হক লতার পেছনে ঘুরতে থাকে।
একদিন লতাই তাকে জিজ্ঞেস করে বসে।
ক্লাস শেষে লতা যাচ্ছিল কমনরুমের দিকে। অন্যদিনের মতো আতিক ছিল তার পেছন পেছন।
অন্যদিনগুলোতে লতা যা করেনা সেদিন তাই করল। হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে পেছন ঘুরে আতিকের কাছে আসলো।
আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান? বেশি কিছুদিন ধরে খেয়াল করছি আপনি আমাকে ফলো করেন।
চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করে তাকে।
আতিকুল হক ভীতু টাইপ ছেলে। লতার প্রশ্নে সে খেই হারিয়ে ফেলে। মুখে কিছু বলতে পারে না। দুদিকে ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দেয় সে কিছু বলতে চায় না। তারপর তাড়াহুড়ো করে লতার সামনে থেকে উধাও হয়ে যায়। রুমে গিয়ে এক বসায় তিন গøাস পানি খায় আতিক। এরপর বাথরুমে যাওয়ার প্রচন্ড চাপ নিয়েও সে ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমের মধ্যে সে একটা স্বপ্ন দেখে।
খুব সুন্দর একটা জায়গায় ঘুরতে গেছে। তার সঙ্গে আছে লতা। জায়গাটা একটা বিলের মতো। চারদিকে পানিতে টইটুম্বুর। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা সড়ক। অনেকটা আশুলিয়া টাইপ। কিন্তু আশুলিয়া না। কারণ আতিক বাস্তবের আশুলিয়া গেছে। স্বপ্নের জায়টাকে তার কাছে পুরোপুরি আশুলিয়া মনে হয় না।
লতা বলল, এই চল না নৌকায় উঠি। নৌকায় চড়ে ওই দূরে, অনেক দূরে চলে যাই।
লতা আঙুল দিয়ে দূরের দিকে দেখায়।
সেই দূরটা আসলে কত দুল আতিক বোঝে না।
তারা দুজন নৌকায় ওঠে।
এখানকার নৌকাগুলো অন্যরকম। নৌকার দু’মুখ পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখলে নৌকায় উঠে লাভ কি? আতিক বুঝতে পারে না।
আতিকের কথা শুনে লতা হাসে।
তোমাকে বুঝতে হবে না। আসো তো।
আতিককে হাত ধরে টেনে নৌকার মধ্যে নিয়ে যায় লতা।
নৌকার মাঝি বয়সে তরুন।
নৌকার মাঝি বলতে চোখের সামনে বয়স্ক একজন মানুষের ছবি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। এই মাঝি সেরকম না। নৌকার ব্যবসা এখানে জমজমাট। হয়তো এই কারণে অনেকে মাঝি হচ্ছে। এই তরুণ সেই দলের।
নৌকা চলতে শুরু করে। বিলের দখিনা বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকছে নৌকার মধ্যে। দু পাশের পর্দাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাগলা বাতাস। পর্দার সাথে তাল মেলাচ্ছে লতার চুল আর ওড়না। নিজের চুল আর ওড়না সামলাতে হিমশিম খায় লতা। এলো চুলে তাকে ভীষণ সুন্দর লাগে। তার মুখে এসে পড়ছে শরতের শেষ বিকেলের নরম রোদ। লতার কোমল ত্বকে রোদটা বসে যাওয়ায় অলৌকিক সুন্দর লাগে তাকে। মুখের বিষন্ন ভাবটা হারিয়ে যায়।
জীবনানন্দ বেঁচে থাকলে এই দৃশ্য দেখে আরও একটা কবিতা লিখে ফেলত। দুর্ভাগ্য, আতিক কবিতা লিখতে পারে না। খুব একটা পড়েও না।
সে কবিতা জাতীয় কিছু একটা বলতে চায়। এ রকম পরিবেশে সে ধরণের কথাই বলতে হয়। কিন্তু তার কিছুই মনে পড়ে না।
আতিকের হাত ধরে লতা।
আজকের আকাশটা সুন্দর না?
হু। আতিক মাথা নাড়ে।
হু কি! বলো সুন্দর। আচ্ছা আতিক, তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?
আতিক মাথা নাড়ে।
সে কিছু বলতে চায়।
কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হয় না।
আতিক চিৎকার বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি লতা। আই লাভ ইউ।
আতিক অবাক হয়ে খেয়াল করে চিৎকারের শব্দ তার নিজের কান পর্যন্তই পাঁছায় না।
কিছু একটা শোনার আশায় আতিকের দিকে তাকিয়ে আছে লতা।
কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বের হয় না।
প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে ঘুম ভাঙে আতিকের।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য লতার সাথে আতিকের প্রেমটা হয়েছিল।
না, আতিক মুখ ফুটে লতাকে কিছু বলতে পারেনি।
লতায়-পাতায় সম্পর্কিত আতিকের আত্মীয় টাইপ এক মেয়ে পড়ত একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। লতাকে না পারলেও মনের কথাটা আতিক তাকে বলতে পেরেছিল। শেষে আতিকের পক্ষে সেই মেয়ে দূতিয়ালি করে। এবং এক পর্যায়ে লতা আর আতিকের প্রেমটা হয়ে যায়।
প্রেম হওয়ার ক্ষেত্রে আতিকের নাকি ওই আত্মীয় মেয়ের, কার কৃতিত্ব বেশি সেটা অবশ্য উত্তরহীন প্রশ্ন হিসেবে থেকে যায়। কারণ অতিক আর লতার মধ্যে নানান দিক দিয়ে ফারাক ছিল।
তারপরও কেন জানি লতা শেষ পর্যন্ত আতিককেই পেঁচিয়ে ধরেছিল।
এক বছরের কিছু বেশি সময় তাদের প্রেমটা টিকে ছিল।
তবে তাদের প্রেমটা ভেঙে গেছে এমন কথা বলা যাবে না। কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে এমন ঘোষণা তাদের দুজনের কারও পক্ষ থেকেই আসেনি।
প্রেমের কথাটা যেমন আতিকুল মুখ ফুটে বলতে পারেনি। না কথাটাও সে বলতে পারেনি।
শুধু কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিল।
জরুরি কথা আছে বলে একদিন লতা তাকে আর্টস বিল্ডিংয়ের পাশের আমতলায় নিয়ে যায়।
জরুরি কথা লতা প্রায়ই বলে। সেসব কথা লতা যতটা জরুরি মনে করে বলে আতিকের কাছে ততটা জরুরি মনে হয় না। কিন্তু লাতাকে তা বুঝতে দেয় না। লতার চেয়েও বেশি জরুরি মনে কথাগুলো শোনে সে।
কিন্তু সেদিন লতা যা বললো তার জন্য আতিক মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
বাসা থেকে লতার পাত্র ঠিক করা হয়েছে। ছেলে সরকারি চাকরি করে। বিদেশে একটা স্কলারশিপ পেয়েছে। তিন বছরের। এখন বিয়ে করে বউকে নিয়ে বিদেশ যেতে চায়। এক সপ্তাহের মধ্যে পাত্র পক্ষ শুভ কাজ সারতে চায়। ছেলের হাতে সময় কম।
আমাদের হাতেও।
লতা বলে।
যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।
কথাটা বলে আতিকের চোখের দিকে তাকায় লতা। আতিক চোখ নামিয়ে ফেলে। সে লতার চোখের দিকে তাকাতে পারে না।
পুরোটা সময় লতা একাই কথা বলে যায়। আতিক টের পায় তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা ঘাম নেমে যাচ্ছে।
লতা তাকে পালিয়ে বিয়ে করার কথা বলে। পুরো পরিকল্পনার কথা জানায়। কিভাবে লতা বাসা থেকে পালিয়ে আসবে। তারপর কোথায় কখন তারা একত্রিত হবে। সেখান থেকে কোথায় যাবে বিস্তারিত সব।
নির্দিষ্ট দিনে লতা বাসা থেকে পালিয়ে আসে কাজি অফিসের সামনে।
আতিকও পালায়।
তবে সে লতার কাছে যায় না।
পালিয়ে তার গ্রামের বাড়ি চলে যায়।
এরপর লতার সাথে সে আর যোগাযোগ করেনি।
লতা অবশ্য তার হলের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়েছিল।
খুব সংক্ষিপ্ত সেই চিঠিতে কোন ধরনের ভূমিকা ছাড়া দুটি লাইন ছিল।
কাপুরুষদের প্রেমিক হওয়া মানায় না।
ভালো থেকো।
সেই থেকে আতিকুল হক কোনও মেয়ের দিকে প্রেমিক চোখে তাকাতে পারে না। তার লতার কথা মনে পড়ে।
লতাকে সে ঠিকই ভালোবেসেছিলো।
তবে পালালো কেন?
চলবে...
আরও পড়ুন
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৫
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৪
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৩
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই