ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৮
খ ম হারূন |
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ ম হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-২৮]
১৯৮০ থেকে ১৯৯০, এই সময়ে যারা বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত দর্শক ছিলেন, তাদের অনেকেরই এখনো তিনটি নাটকের নাম মনে থাকার কথা। মহা প্রস্থান, লাগুক দোলা, নীলপানিয়া। ড. রাজীব হুমায়ূন রচিত এই তিনটি নাটকের নির্মাতা যেহেতু আমি ছিলাম, তাই অনেকেই নাটকগুলি সম্পর্কে আমার কাছে নানা তথ্য জানতে চান।
‘মহা প্রস্থান’ নাটকটি বিটিভিতে প্রথম সম্প্রচারিত হয় ২২ জুন ১৯৮৪ তারিখে, 'লাগুক দোলা' ১ আগষ্ট ১৯৮৪ এবং 'নীলপানিয়া' ২৭ মার্চ ১৯৮৬। এরপর নাটকগুলো বহুবার পুনঃসম্প্রচার করা হয়েছে বিটিভিতে, কিন্তু কখনে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
মহা প্রস্থান এবং লাগুক দোলা- দুটি নাটকই বিদেশি গল্পের রূপান্তর, যা অত্যন্ত দক্ষতা ও সৃজনশীলতার সাথে বাংলায় রূপান্তর করেছিলেন রাজীব হুমায়ূন। ‘নীলপানিয়া’ নাট্যকারের শতভাগ মৌলিক একটি রচনা। যে নাটকের মাঝে আছে বাংলার উপকূলীয় অঞ্চলের সংগ্রামী জীবনকথা, সেই সাথে আছে স্বাধীনতার কথা, বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করার কথা।
একটি দ্বীপের নাম ‘নীলপানিয়া’। ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সাথে দ্বীপবাসীদের নিত্যজীবন। কষ্ট করে বীজ বোনে কিন্তু ফসল চলে যায় সাগরের করাল গ্রাসে। ১২ নভেম্বর ১৯৭০। জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় নীলপানিয়াবাসীর জীবন। পর্যুদস্ত এক পরিবারের মানুষেরা সিদ্ধান্ত নেয় আর প্রকৃতির ভয়াল থাবার মুখে জীবনযাপন নয়। ওরা চলে যাবে রাজধানীর কাছাকাছি, আনন্দগড়ে। সেখানে ঘূর্ণিঝড় নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই, নেই সাগরের ভাঙণ। প্রকৃতির খেয়ালের কাছে আর মাথা নত করে জীবনযাপন নয়। একে বাঁচা বলে না। এই পরাধীন জীবন আর নয়।
১৯৭০ এর মহাপ্লাবন আর ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত প্রতীকি একটি নাটক ‘নীলপানিয়া’। এই নাটকে যারা অসাধারন অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্য আছেন- ফেরদৌসী মজুমদার, লাকী ইনাম, রওশন জামিল, জামালউদ্দিন হোসেন, আতাউর রহমান, ড. ইনামুল হক, মজিবুর রহমান দিলু এবং কামালউদ্দিন নীলু।
নীলপানিয়া নাটকের জন্য বেশ কিছু ছড়া লিখেছিলেন নাট্যকার। ছড়াগুলির মধ্য দিয়ে সে সময়ের (১৯৭০-৭১) গ্রামীণ জীবনের কিছু চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়, যা খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো সেই আশির দশকে যে সময় জয় বাংলা বলা যেতো না বা পাকিস্তান বিরোধী কোনো কথা বলা যেতোনা। কিন্তু আমরা তা বলেছিলাম সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিতে।
দুঃখ-কষ্ট, ঝড়-তুফান নিয়ে ছড়া:
ঘরের পিছে তুফাইন্যা লতা
কারে কমু দুঃখের কথা
কারে কমু ছুলুক
তুফানে গেলো মুল্লুক।
ঝড়-তুফানের পর যে রিলিফ আসে তা নিয়ে ছোটোরা ছড়া কাটে:
আটার রুটি কলের পানি
রাইত পোহাইলে টানাটানি
দেড়মইন্যা বস্তা
চেরমাইন্যার নাস্তা।
একসময় দ্বীপের মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তারা শ্লোগান দেয়:
তোমার আমার ঠিকানা
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।
জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান
আজিমপুরের গোরস্তান।
হারিকেনের তলা নাই
কালা মিয়ার গলা নাই।
পাকিস্তানের দিন শেষ
জয় বাংলা, বাংলাদেশ।
এর আগে ১৯৮৪ সালে ‘মহা প্রস্থান’ নাটকটি নির্মাণ করা হয়। কয়েক বছর পরিশ্রম করে হিন্দি নাটক ‘অন্তিম যাত্রা’কে বাংলায় রূপান্তর করেন রাজীব হুমায়ূন। পটভূমি বাংলার পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তরের পার্বত্য অঞ্চল। যেখানে একটি গ্রামে কয়েকটি পরিবারের বসবাস। পাহাড়ের সেই সব মানুষের কষ্টকর জীবন যাপনের কথা, মন্দিরের পুরোহিত যেখানে সব থেকে ক্ষমতাধর মানুষ, তাকে খুশি রাখতে পারলেই গ্রামবাসীদের স্বর্গলাভ হয়। সেখানকার নিয়ম একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, যখন সে সংসারের বোঁঝা হয়ে দাড়ায়, তাঁর দু একটি দাঁত পরার সাথে সাথে পরিবারের অন্য সদস্যরা বুঝে নেয় বৃদ্ধ মানুষটির এখন অন্তিম যাত্রার সময় চলে এসেছে। শুরু হয় আয়োজন। যখন শীত আসে তখন পরিবারের সন্তানেরা পুরোহিতের আশীর্বাদ নিয়ে বৃদ্ধ মানুষটিকে ঘাড়ে করে নিয়ে যায় পাহাড় চূড়ায়, যেখানে বরফে আচ্ছন্ন থাকে প্রান্তর। বৃদ্ধ মানুষটিকে একাকী ফেলে রেখে তারা চলে আসে নিজ গ্রামে। নীচে নামতে নামতে তারা শুনতে পায় ফেলে আসা মানুষটির কান্না। একসময় তা থেমে যায়। পাহাড়ী ভাল্লুকের ভয়ে সেই সব মানুষের হাতে থাকে মশাল। একসময় পুরোহিত ঘোষণা করে ফেলে আসা মানুষটির স্বর্গলাভ হয়েছে। সবাই তখন আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে।
‘মহা প্রস্থান’ নাটকে ঐ বৃদ্ধার ভূমিকায় অভিনয় করেন রওশন জামিল। তার পৌত্র বিয়ে করে বৌ আনবে, বৃদ্ধাকে তাই তার ঘর ছেড়ে দিতে হবে। অথচ তার একটিও দাঁত পরেনি। পরিবারের সবার মনে আতঙ্কের ছাপ। পুরোহিত বৃদ্ধাকে কি পরামর্শ দেয় তা বৃদ্ধাই জানে। এক সন্ধ্যায় বৃদ্ধা নিজ হাতে তার সামনের দাঁতগুলি ভেঙে ফেলে। এখন তো তার আর অন্তিম যাত্রায় যাবার ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকেনা। এই নাটকের মূল চরিত্র বৃদ্ধা রওশন জামিলের পুত্রের ভূমিকায় কামালউদ্দিল নীলু, পুত্রবধূ ডলি জহুর, পৌত্র খালেদ খান যুবরাজ এবং যুবরাজের পছন্দ করা মেয়েটির ভূমিকায় অভিনয় করেন তারানা হালিম। নাটকের পুরোহিত হিসেবে অসামান্য অভিনয় করেছিলেন মজিবুর রহমান দিলু।
রওশন জামিল বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র এবং টিভিতে উল্লেখ করার মতো অসংখ্য চরিত্রে তিনি রূপদান করেছেন। এতো বড় একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী তাঁর শেষ জীবনের একটি সাক্ষাতকারে বলেন, মহা প্রস্থানে তিনি যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন, তা ছিলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয়।
মনে আছে এই নাটকটির রিহার্সেল হয়েছিলো টিভি ভবনের তিন তলায় ছয় সপ্তাহ ধরে। কসটিউমের জন্য থান কাপড় কিনে সেগুলো দিয়ে বিভিন্ন চরিত্রের জন্য নিজেই ডিজাইন করে তৈরী করিয়েছিলাম সেলাইবিহীন পোশাক। সেট ডিজাইন করেছিলেন জি এম রাজ্জাক। ৩ নং স্টুডিওর পুরোটা জুড়ে পাহাড়, বাঁশের ঘর আর বনপথ তৈরী করেছিলেন তিনি। পুরো নাটকটি ছিলো স্টুডিওতে ধারনকৃত। শত বছর আগের আবহ তৈরী করা হয়েছিলো সেটে, পোশাকে, মেকআপে এবং সঙ্গীতে।
১৯৮৪ সালে ড. রাজীব হুমায়ূন আরেকটি নাটক রচনা করেন, লাগুক দোলা। যেটি ছিলো একটি আমেরিকান ছোটো গল্পের নাট্যরূপ। নাটকটি সম্পর্কে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী আমার এক বন্ধু, যিনি বিটিভির নাটক ও অনুষ্ঠান নিয়ে গবেষনা করেন, কাজল রিপন, তার কিছু কথা উল্লেখ করছি।
“লাগুক দোলা ছিলো সম্পূ্ন ভিন্নধর্মী এক গল্পের সফল নাট্যরূপ। কিছু নতুন মুখের সফল আবির্ভাব ঘটে এই নাটকে। আশি ও নব্বই দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রী লুৎফুন্নাহার লতা, এই নাটকের মাধ্যমেই যার টিভি নাটকে অভিষেক। এর আগে তিনি খ ম হারূন প্রযোজিত জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘প্রচ্ছদ’ এ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে সময়ের স্বনামধন্য টিভি প্রযোজক সালেক খানও অভিনয় করেছিলেন এই নাটকে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে সুদর্শন টগবগে যুবক খালেদ খান (যুবরাজ নামে সুপরিচিত) এর ষষ্ঠ টিভি নাটক ছিল এটি। সবচে মজার ব্যাপার, সঙ্গীত শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা এই একটিমাত্র টিভি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। অবশ্য তার আগমন গল্পের প্রয়োজনে। কারন গল্পের মূল নারী চরিত্র দোলা একজন সঙ্গীত শিল্পী, যে কিনা নির্জন পাহাড়ে, গভীর বনে, গাছের ছায়ায় একা একা বসে গান গায়। তাকে দূর থেকে দেখে, গান শুনে, প্রখ্যাত ফুটবল খেলোয়ার হাবিব (খালেদ খান) মুগ্ধ হয়। মনে মনে ভালোবেসে ফেলে। হাবিব ধীরে ধীরে দোলার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে, সারাক্ষন দোলার কথা ভাবে, এমনকি খেলার মাঠেও। অসাবধানতাবশত হাবিব দূর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পায়। ডাক্তারের (মাসুদ আলী খান) আন্তরিক চিকিৎসা চলে, কিন্তু কোন উন্নতি নেই। ডাক্তার ধারনা করেন অসুখটা পায়ে নয় মনে। যুবরাজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সালেক খানকে ডেকে পাঠায় ডাক্তার। সালেক খানের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে যুবরাজকে সারিয়ে তুলতে বন্ধুকে অনুরোধ করে। এদিকে সালেক খানের স্ত্রী লুৎফুন্নাহার লতা, দোলার বান্ধবী। লতা স্বামীর বন্ধুর শুভকামনা করে প্রস্তাব নিয়ে যায় দোলার কাছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। মেঘনায় গড়িয়ে যায় অনেক জল। দোলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। খবর পেয়ে হাসপাতালের বিছানায় যুবরাজ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। অবশেষে জানা যায় তুখোড় খেলোয়ার হাবিব (যুবরাজ) আর কোনদিনই ফুটবল খেলতে পারবে না। নাটকের করুণ বিয়োগান্তক পরণতি দর্শকমনকে দারুণভবে নাড়া দেয়। ফলে বিপুল জনপ্রিয়তা পায় এটি, দর্শকমহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়। আমার মতো হয়তো আজও অনেকের মনে দোলা দেয়।”
ফিরে যাই আরও আগে, সত্তুরের দশকে। ১৯৭৬ এর নভেম্বর। ক্লাস শেষে আমরা সবাই এনএসডি’র ওপেন এয়ার থিয়েটারে রিহার্সেলে ব্যস্ত। ক’দিন পরেই এখানে মঞ্চস্থ হবে প্রথম বর্ষের প্রযোজনা ‘অন্তিম যাত্রা’। একদিন হোস্টেলে ফিরে দেখি আমাদের অপেক্ষায় বসে আছেন পুনে থেকে আগত একজন বাঙালী ছাত্র। খুব চেনা চেনা মনে হলো। আমার খোঁজ করছিলেন। বললেন, ‘হারূন আমি হূমায়ূন কবীর, সূর্যসেন হলে তোমার দু’বছরের সিনিয়র ছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে পড়াই। এখন পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পিএইচডি করছি’। চিনতে কোনো অসুবিধা হয় না। ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ওনার স্কলারশিপ সংক্রান্ত কিছু কাজ আছে, তাই দিল্লি এসেছেন। ক’দিন আমাদের সাথেই থাকবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কথাই মনে পড়লো। উনি একবার বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল থেকে বাংলা বিভাগ ছাত্র সংসদের জন্য নির্বাচন করেছিলেন। বেবী মওদুদ ভিপি আর হুমায়ূন কবীর জিএস ক্যান্ডিডেট। বেবী-হুমায়ূন পরিষদের কলা ভবনের মিছিলে বাংলা বিভাগের ছাত্র না হওয়ার পরেও আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম।
‘অন্তিম যাত্রা’ পরিচালনা করছিলেন আমাদের বৃটিশ শিক্ষক বেরি জন (Barry John), তিনি মূলত আমাদের অভিনয়, পাশ্চাত্য নাটকের ক্রমবিকাশ, এলিজাবেথিয়ান থিয়েটার এবং রেনেসাঁ উত্তর ইউরোপীয় নাটক, এসব বিষয় পড়াতেন। তিনি আমাদের নিয়ে শুরু করেছিলেন একটি জাপানী কাহিনী থেকে রূপান্তরিত নাটক Journey To The Mountain Beyond, যার হিন্দি নাম ‘অন্তিম যাত্রা’। নাটকে অভিনয়সহ মঞ্চ ও নেপথ্যের সকল কাজে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিলো বাধ্যতামূলক। বেরি জন নিজেই সেট ডিজাইন করেছিলেন। লাইট ডিজাইন করেছিলেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জামিল আহমেদ। হুমায়ূন ভাই যে ক’দিন দিল্লি ছিলেন, প্রতিদিন নাটকের রিহার্সল দেখেছেন গ্যালারিতে বসে। নাটকের প্রথম মঞ্চায়নের দিনও তিনি নাটকটি মনোযোগ দিয়ে দেখেছিলেন। পুনে যাবার আগে তিনি আমার কাছ থেকে ‘অন্তিম যাত্রা’র একটি হিন্দি পাণ্ডুলিপি কপি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন বেশ ভালো হিন্দি জানতেন। পুনে থেকে তিনি আমাকে দুটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, বলেছিলেন তিনি ‘অন্তিম যাত্রা’র বাংলা রূপান্তরের কাজে হাত দিয়েছেন।
১৯৭৭, আমরা আইসিসিআর ইন্টারন্যাশনাল সামার ক্যাম্পে কাশ্মীর যাওয়ার প্লান করেছি। আমি ও তারিক আনাম যাবো এনএসডি থেকে। জুন মাসের ১ তারিখ হতে ক্যাম্প শুরু হবে এক মাসের জন্য। মে মাসের ৩০ তারিখ সন্ধ্যায় নয়া দিল্লি রেল স্টেশনে পৌঁছে গেছি আমি ও তারিক আনাম। দিল্লি থেকে একই ট্রেনে আরো অনেক বিদেশি ছাত্র ছাত্রী যাচ্ছে তবে সবার সাথে পরিচয় হয়নি তখনো। এর মাঝে লেডি হার্ডিন্জ মেডিকেল কলেজের ছাত্রী রাশীদা এবং তার বোন সাঈদা আমাদের গ্রুপে যোগ দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে কালো সোয়েটার ও ক্যাপ পরা অবস্থায় হুমায়ূন ভাইকে দেখলাম আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন দূর থেকে হাত নাড়াতে নাড়াতে। তিনি পুনে থেকে ট্রেনে নয়া দিল্লি এসেছেন। আমরা পাঁচজন একসাথে ট্রেনে উঠলাম, একসাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছি। প্রথমবার যাচ্ছি কাশ্মীর। অন্যরকম এক অনুভূতি। একসাথে রাতের খাবার খেলাম। তারপর যার যার আসনে ঘুমিয়ে পড়লাম। বেশ ভালোভাবেই জম্মু পৌঁছে গেলাম খুব ভোরে।
জম্মুতে নেমেই পেয়ে গেলাম আরো সাতজন বাঙালী ছাত্রকে। হুমায়ূন ভাই ই প্রথম তাদের আবিস্কার করেন প্লাটফর্মে। এর মাঝে শান্তি নিকেতন থেকে এসেছে সাদি মহম্মদ, মৃদুল কান্তি, তপন বৈদ্য, বাবু রহমান ও সমীর। জম্মু স্টেশনের বাইরে অনেকগুলো বাস দাড়িয়ে। আমরা একশ' জন ছাত্র চারটা বাসে যাচ্ছি শ্রীনগর। এর মাঝেই হুমায়ূন ভাই বাংলাদেশের ছাত্রদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে ফেলেছেন।
দিল্লিতে যখন ভীষণ গরম তখন কাশ্মীরের শীতল আবহাওয়ায় একমাস দেখতে দেখতে কেটে গেলো। শ্রীনগর, গুলমার্গ, পহেলগাম। গুলমার্গে তখনো বরফ পরে মাঝে মাঝে। শেষ সপ্তাহে কাশ্মীরের গভর্নরের রাজভবনে আমাদের আমন্ত্রণ। সারাদিনের প্রোগ্রাম। রাজভবনে আমাদের স্বাগত জানালে গভর্নর এল কে ঝা এবং তাঁর স্ত্রী মেখলা ঝা। বিহারের সন্তান এল কে ঝা ১৯৬৭ থেকে তিন বছর রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর ছিলেন। ১৯৭০ থেকে তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত, তারপর ১৯৭৩ থেকে আট বছর কাশ্মীরের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমরা যারা বাংলাদেশের তাদের ডেকে পাঠালেন মিসেস ঝা। তিনি আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন। জানালেন তিনি কুমিল্লার মেয়ে। বৃটিশ আমলে এল কে ঝা যখন তরুণ আইসিএস অফিসার তখন তিনি একবার কুমিল্লা আসেন এবং পরবর্তীতে তাঁদের বিয়ে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এল কে ঝা যখন ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত সে সময়কার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর অনেক কূটনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার জন্য এল কে ঝা এবং মেখলা ঝা দুজনেই অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।
আমাদের মাঝে শান্তিনিকেতনের অনেকেই ছিলেন সঙ্গীত ভবনের ছাত্র। মিসেস ঝা তার বিশাল ঘরে আমাদের নিয়ে আসর জমালেন। সাদি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলো, তপন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। সমীর সেতার বাজিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলো। হুমায়ূন ভাই বাংলায় সুন্দর বক্তব্য রাখলেন। মেখলা ঝা কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন। তিনি অনেক গুণী একজন শিল্পী। অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে আপন করে নেবার অসাধারন ক্ষমতা আছে। তাঁর আপ্যায়নে কি ভাবে যে কেটে গেলো সারাটা দিন বুঝতেই পারলাম না।
ক্যাম্প শেষে আমরা সবাই নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গেলাম। হুমায়ূন ভাইও পুনে চলে গেলেন জম্মু থেকে। তিনি তার থিসিসের কাজ শেষ করে এনেছেন। এ বছরেই তিনি বাংলাদেশ ফিরে যাবেন জানালেন।
১৯৮২, একদিন বাংলা একাডেমিতে গেলাম ‘প্রচ্ছদ’ অনুষ্ঠানের কাজে। আমি আসাদ চৌধুরী ভাইয়ের রুমে। আমার গলা শুনে রশীদ হায়দার ভাইয়ের রুম থেকে বের হয়ে আসলেন হুমায়ূন ভাই। তিনি আমার সব খবর রাখেন বলে জানালেন। আরো জানালেন, এখন থেকে তিনি আর হুমায়ূন কবীর নন। এফিডেভিট করে নাম পরিবর্তন করেছেন। এখন তিনি রাজীব হুমায়ূন। বাংলা সাহিত্য জগতে আরো হুমায়ূন কবীর থাকায় তিনি তার নাম পরিবর্তন করেছেন। এর মাঝে তার বেশ ক’টি বইও প্রকাশিত হয়েছে নতুন নামে।
ড. রাজীব হুমায়ূন তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সরকারি অধ্যাপক। কিছুদিন পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে। আরো পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়, যে বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েক বছর।
১৯৯৬ সালে আমরা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলাম হুমায়ূন ভাইয়ের প্রচেষ্টায়। Association for Bangladesh Scholars Studied in India (ABSSI) নামে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি ড. রাজীব হুমায়ূন, আমি সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। অনেক শিল্পী, অধ্যাপকসহ অনেক গুণী মানুষেরা এই সংগঠনের সদস্য ছিলেন। হুমায়ূন ভাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের জন্য সময় দিয়েছিলেন।
২০০৪ সালে রাজীব হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেন। বেশ কিছু গবেষণার কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন। একসময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। লেখালিখি বন্ধ হয়ে যায়। ৬ জুলাই ২০১৭ তারিখ ছিলো তার ৬৬ বছরের এক মূল্যবান কর্মময় জীবনের শেষ দিন। তার কথা যখনই মনে হয়, মনে হয় কাশ্মীরের আনন্দময় দিনগুলির কথা, লাগুক দোলা আর নীলপানিয়ার কথা, অন্তিম যাত্রা আর মহা প্রস্থানের কথা।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৩
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২২
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২১
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২০
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই