‘স্যার’ বলবেন না প্লিজ, ‘ভাই’ বলবেন
‘স্যার’ বলবেন না প্লিজ, ‘ভাই’ বলবেন
আগের দু-এক কিস্তি লেখা পড়ে কেউ যে পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষায় থাকবে না সেই বিশ্বাস আমার আছে। মানে নিজের কলমের জোর কেমন, তা নিজে না বুঝলে কি চলে! কী বলেন ‘ভাই’। তবুও যদি একটু কষ্ট করে পড়েন ‘ভাই’ এবং আপাসকল। ইনভার্টেড কমায় আবদ্ধ ‘ভাই’ শব্দটি দেখে নিশ্চয়ই একটু ধাঁধায় পড়েছেন। না, ধাঁধার কিছু নেই। খেজুরে আলাপে আজকে থাকছে ‘ভাই’। একদমই দাপ্তরিক ‘ভাই’। জ্বী ভাই।
ম্যালা দিন আগের ঘটনা। সবে চাকরি হয়েছে। চাকরির চিঠি পেয়ে তো বিশ্বাসই হয়নি আমার মত এক নাখান্দা বান্দার চাকরি হয়ে যাবে। ক্যামনে কী? তো গেলাম জয়েন করতে। গিয়ে দেখি অনেকজন। কাউকে কাউকে লিখিত পরীক্ষার দিন দেখেছি। একটা মিটিং রুমে বসানো হয়েছে সবাইকে। দু-একজন বাদে সবাই বেশ জড়সড়। চুপচাপ। অফিসের পিয়ন এসে রোল কল করছে। সবাই হাত তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কেউ কাউ বলেছে ‘ইয়েস স্যার’। রোল কল করে পিয়ন সাহেব চলে গেলেন। মোটা ফাইলপত্র হাতে মোটা ফ্রেমের চশমাপরা সিনিয়র একজন এলেন। নিশ্চয়ই বড় স্যার। সিনিয়রের গাম্ভীর্য দেখে আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম। বসতে বললে, বসলাম। এবার তিনি কুশলাদি জানতে চেয়ে এটা ওটা প্রশ্ন করছেন। আমরা সকলেই স্যার স্যার বলে ওনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমাদের কেউ কেউ বাড়াবাড়ি রকমের স্যার স্যার বলছেন। হয়তো পারিবারিক সূত্রে ওটা পেয়েছেন।
স্যার এবার দাঁড়ালেন এবং সকলের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন, এই অফিসে আপনাদের সকলকে স্বাগত। আজ থেকে আপনারা এই অফিসের কর্মী। এখন আমি প্রত্যেকের কাগজপত্র দেখব এবং আপনার কর্মস্থল বলে দেব। সেই সাথে একটা কথা, এই যে আপনারা স্যার স্যার বলছেন এটা করবেন না প্লিজ। ভাই বলবেন, ‘ভাই’। আমরা এই অফিসে সবাই ভাই-ভাই। এ কথা শুনে কার কী হয়েছে জানি না, আমার তো আক্কেলগুড়ুম। কী বলে! স্যার না, ভাই? ক্যামনে কী? এটা তো অফিস না, রীতিমত ঘরবাড়ি মনে হচ্ছে। শুরু হয়ে গেল, অমুক ভাই, তমুক ভাই। জয়েন করার পরপরই, প্রশিক্ষণে পাঠানো হলো। এলাহি কারবার। আলীশান প্রশিক্ষন কেন্দ্র। শত শত মানুষ এসেছেন আমাদের মত প্রশিক্ষণে। ওখানেও ভাই আর ভাই। এত চাকরি না রে ভাই! কই আইলাম! আশেপাশে স্যার নাই, ভাই শুধু ভাই।
প্রশিক্ষণ শেষে যে যার কর্মস্থলে। কুদ্দুস ভাই এখানকার ম্যানেজার। তিনি ছাড়া আমরা ১০-১২ জন স্টাফ। সকালে ম্যানেজার ভাইয়ের অফিসে মিটিং। আমি নতুন, আমি ছাড়া সবাই হাজির। বুঝলাম না। মিটিং তো শুরু হওয়ার কথা ৮ টায়, তার আগেই সবাই হাজির। সে যাকগে। সালাম দিলাম, স্লামুআলাইকুম কুদ্দুস ভাই। অলাইকুম বলে বসতে বললেন। বসলাম। কুদ্দুস ভাই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, কামাল সাহেব, ওনাকে অফিসের নিয়মকানুম বুঝিয়ে দিবেন। মিটিং শেষ হয়ে কামাল ভাই আমাকে নিয়মকানুন শেখাতে বসলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বললেন তা হলো, কুদ্দুস ভাইকে ‘কুদ্দুস ভাই’ বলা যাবে না। শুধু ‘ভাই’ বলতে হবে, বুঝলেন! তবে একই লেভেলের সহকর্মীদের নামের সাথে ভাই বলা যাবে, যেমন কামাল ভাই।
ব্যাস, বোঝা শুরু হয়ে গেল, কে বড় স্যার, কে ছোট স্যার। কাকে অমুক ভাই ডাকতে হবে, কাকে শুধু ভাই ডাকতে হবে, কাকে তমিজের সাথে ডাকতে হবে এবং কাকে আরও তমিজের সাথে ডাকতে হবে। এ যেন তমিজ তমিজ খেলা, কে কত বেশি তমিজ দেখাতে পারে। অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে অফিস জুড়ে। সোশ্যাল-মিডিয়াতেও এই তমিজের কমতি নেই। ওখানেও গলগল তমিজ গড়িয়ে পড়ে – ভাই, আপনাকে অনেক অনেক সুন্দর লাগছে। একদিন তো একজনের একটা পোস্ট দেখে প্রশ্নই করে বসলাম, উনি রাজনৈতিক কোন ভাই? মানে যিনি পোস্ট করেছেন, তিনি তার চেয়ে অর্ধেক বয়সের একজনের ছবি দিয়ে লিখেছেন। ভাই করোনায় আক্রান্ত। ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। এখানেও ভাইয়ের নাম নেয়া নাজায়েজ। শুধু ভাই। পরে জেনেছি তরুণটি তাঁর বস।
প্রধান কার্যালয় থেকে যখন অফিসারগণ আসেন তখন তমিজের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। বাবার বয়সী অফিসারগণ তাদের ছেলের বয়সীদের বলতে শোনা যায়, ভাই, কেমন আছেন? নাম বলা যাবে না। শুধু ভাই। তারপরও কী যে ভাল্লাগে, আমাদের অফিসে স্যার নেই, আছে শুধু ‘ভাই’। আমরা সবাই ভাই ভাই।
এই ‘ভাই’ বিষয়টা যে মিটিং অব্দি গড়াবে সেটা কিন্তু কখনই কারো মাথায় আসেনি। অফিসের এক মান্থলি মিটিংয়ে এক কোণায় বসে বসে কিছু একটা আঁকিবুঁকি করছি। আমার ধারণা সব মিটিংয়ে অনেকেই এ কাণ্ডটা করেন। কোন কোন মিটিং এতটাই বোরিং হয় যে এসব আলতু ফালতু কাজ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। তো এমন একটা বোরিং মিটিং-এর শেষদিকে সবাই দেখি নড়েচড়ে বসছেন। আমিও তাই করলাম। ম্যানেজার ভাই, ঘোষণা দিলেন, এখন আমরা ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে আলাপ করব। বিষয়টি এজেন্ডা হিসেবে তুলেছেন আমাদের নাহার। বিষয়টি হলো ‘ভাই’। নাহার, বলুন প্লিজ। নাহার বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নাহার আমাদের অফিসে যোগ দিয়েছেন বছর দুয়েক হলো। মেধাবি, করিৎকর্মা। অফিসের জেন্ডার বিষয়ক ফোকাল পারসন। কয়েকজন নারী কর্মীর মধ্য থেকে তাকেই এই কাজের জন্য যোগ্য মনে করেছে কর্তৃপক্ষ। যদিও এই বাড়তি দায়িত্বের জন্য কোনো আর্থিক সুবিধা নেই তবুও নাহার খুশি। জেন্ডার বিষয়ে দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শোনার জন্য সবাই নাহারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কী এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়!
নাহার একটু গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, ভাই বিষয়টা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনার কথার সুত্র ধরেই বলি। এই যে আমরা প্রায় চার ঘণ্টা বসে বসে নানান বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম, আপনি পুরুষ সহকর্মীদের ডাকার সময় তাদের নাম বলেছেন এবং সাথে সাহেব বা সাব বা বাবু শব্দটি বলেছেন। যেমন, সাইফুল সাহেব, আলম সাহেব, সুকুমার বাবু, করিম সাব ইত্যাদি কিন্তু নারী সহকর্মীদের নাম বলার সময় তো কিছু বলেননি বা বলেন না। শুধু বলেন নাহার, সুফিয়া, দীপ্তি। আমার প্রস্তাব পুরুষ সহকর্মীদের মত নারীদের বেলায়ও কিছু একটা বলা হোক।
ম্যানেজার ভাই কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকলেন। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে এমন একটা বিষয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। শেষে শুধু এটুকু বললেন, ঠিক আছে নাহার। আমরা সিনিয়রদের বেলায় ভাই, আপা, দাদা, দিদি বলি। জুনিয়র পুরুষ সহকর্মীদের বেলায় সাহেব, সাব বা বাবু বলি। এখন আপনিই বলুন আমরা জুনিয়র নারী সহকর্মীদের বেলায় কী বলতে পারি?
নাহার ভাবতে থাকুক। আমরা আপাতত ভাই নিয়েই থাকি। কী বলেন?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখায় ব্যবহার করা নাম কাল্পনিক। কারো নামের সাথে মিলে গেলে তার জন্য দুঃখিত।
আগের লেখা পড়ুন:
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই