শামসুজ্জামান খান: ফোকলোর বিষয়ক আলাপচারিতা
শামসুজ্জামান খান: ফোকলোর বিষয়ক আলাপচারিতা
বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহকরূপে যারা প্রাতস্মরণীয়, শামসুজ্জামান খান তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরী। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর মতো ত্রিকালদর্শী সংস্কৃতিকর্মী বিরল। তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও সমন্বয়বাদী ভাবাদর্শের ধারাবাহিক অনুশীলনে পরিব্যাপ্ত মননের ধারক ও বাহক। তাঁর আচারে, ব্যবহারে, কথাবার্তায় এমন কিছু ছিল যা প্রকৃতই আন্তরিকতাপূর্ণ।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির কোন অনুষ্ঠানে তাকে ডাকলেই পাওয়া যেতো। দরদভরা কণ্ঠে তিনি অভ্যাগতদের সামনে নির্মেদ বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। পূর্বের বক্তারা কোন ভুল বললে তা শুধরে দিতেন। বিরক্তির উদ্রেক ঘটে এমন কিছু উচ্চারণ করতেন না। একজন ধ্যানরসিকের আবহ ফুটে ওঠতো তার সমস্ত অবয়বে। যারা জ্ঞানপিপাসু তারাই অনুভব করতে পারতেন তার পাণ্ডিত্য।
সৌভাগ্যক্রমে এই মনীষার সঙ্গে আমার দুবার সরাসরি কথা হয়েছিল। একবার জাতীয় জাদুঘরে 'জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক গুণীজন বক্তৃতামালা'র অনুষ্ঠানে। সেদিন বক্তৃতা ছিল 'বাঙালি মুসলমানের পরিচয়-বৈচিত্র' বিষয়ে; বক্তা ছিলেন প্রয়াত আনিসুজ্জামান। অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে তার কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—স্যার, আপনার একটা অটোগ্রাফ যদি দিতেন।
স্যার স্মিতহাস্যে বললেন, 'আমার অটোগ্রাফ? আমি কি এমন তারকা?'
তারপর অটোগ্রাফের কলম চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলেন—'কী কর?'
আমি বললাম—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
আমার কথা শুনে তিনি যেন উদ্বেলিত হয়ে ওঠলেন। বললেন, 'বাহ! আমি নিজেও এখন অ্যানথ্রোপলজি চর্চা করছি৷ তুমি আমার সাথে পরে অফিসে একবার দেখা করো।'
আমি স্যারের কথাসূত্রে পরের সপ্তাহেই বাংলা একাডেমিতে যাই দ্বিতীয়বার দেখা করতে। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও দেখা পাওয়া গেলনা। দুপুর ভোজনের বিরতিতে যাওয়ার পূর্বে কাঙ্ক্ষিত সাক্ষাত মিলল। আমি তাকে পূর্বসূত্র মনে করিয়ে দিতেই বললেন—' অ্যানথ্রোপলজি খুব মজার বিষয়। বলতো ফোকলোর অ্যানথ্রোপলজি সম্পর্কে?'
আমি বললাম, 'স্যার, আমাদের বিভাগে ফোকলোর বিষয়ক কোন কোর্স রাখা হয়নি। তাই এ বিষয়ক জ্ঞান আমার নেই। তবে ব্যক্তিগত উৎসাহে যতটা জানি তার ওপর ভর করে বলা যায়, নৃবিজ্ঞানী ই বি টাইলর ফোকলোর বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করেছিলেন। সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে ফোকলোর পড়ানো হয়।'
তিনি আমার কথার ওপর বললেন—'না না, ফোকলোর অ্যানথ্রোপলজির অনেক আগেই চর্চিত হতো। তখন অ্যানথ্রোপলজির জন্মই হয়নি।'
তারপর বিষয় বদলে জিজ্ঞেস করলেন—'বাংলা ভাষায় ফোকলোর চর্চা করেছেন এমন কজনের নাম বলতে পারো?'
আমি চট করে বললাম—'রবীন্দ্রনাথ, জসীম উদ্ দীন, দীনেশচন্দ্র সেন, মুহম্মদ মনসূর উদ্দিন, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, মযহারুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান ও আবুল আহসান চৌধুরী।'
তিনি বললেন—'রবীন্দ্রনাথের কোন উপন্যাসে লালনের গান ব্যবহৃত হয়েছে জান?'
আমি বললাম—'গোরা উপন্যাসে।'
জিজ্ঞেস করলেন—'মুহম্মদ মনসূর উদ্দিন সম্পর্কে বলো।'
বললাম—'মুহম্মদ মনসূর উদ্দিন ১১ খণ্ডের 'হারামনি' লোকসংগীত সংগ্রাহক। এই সংকলনের ভূমিকা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন।'
জিজ্ঞেস করলেন—'বাংলার লোক-সংস্কৃতির চিরায়ত কিছু বৈশিষ্ট্য বলতে পারো?'
আমি বললাম—'সমন্বয়ধর্মিতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা।'
তিনি বললেন—'আরও একটা আছে, বলতে পারবে?'
আমি বললাম—' ঠিক মনে পড়ছে না।'
তিনি বললেন—'মানবধর্মিতা।'
কথা আরও বাড়ানোর ইচ্ছা ছিলো আমার। কিন্তু তিনি ঘোর ভেঙে দিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে, দেখি তোমাকে কোন কাজে লাগানো যায় কিনা। তুমি যোগাযোগ রেখো। আর পড়াশোনা কিন্তু ছেড়োনা।'
এরপর আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন গবেষণা ও পরে চাকরির প্রস্তুতির নেশায় বুঁদ হওয়ায় স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এখন বুঝতে পারি, স্যারের পেছনে লেগে থাকলে হয়তো আমার পথটা ভিন্ন হতো!
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই