বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে, আসুন পড়ি ধীরে
বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে, আসুন পড়ি ধীরে
কিযী তাহনিনের বই `বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে` |
'বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে' হাতে আসে গেলো সপ্তায়। নতুন কোনো বই পেলেই একবার হাতে তুলে পাতা খুলে, অর্থাৎ দৈবচয়ন পদ্ধতি, যে পাতাটি সামনে আসে সেটি পড়ে ফেলাই অভ্যাস। বুধগ্রহে চাঁদ উঠেছে খুলতে গিয়ে মাঝ বরাবর নয়, কেনো যেনো মলাটটাই উল্টালাম। সূচিপত্রটাই প্রথম পড়লাম। সেখানে মন আটকালো প্রথম গল্পের নামে- 'বিন্যাকুড়ির আকাশ পাতাল'।
বিন্যাকুড়ি নামটাতে খটকা লাগলো। এটা কি কোনো জায়গার নাম? মনের প্রশ্ন- তাই তালিকায় মন না দিয়ে দ্রুত পাতা উল্টে পড়তে শুরু করলাম- বিন্যাকুড়ির আকাশে আজ মেঘ জমেছে... ও আচ্ছা, কোনো স্থানই হবে- বোধ বুঝে নেয় নিজের মতো করে। কিন্তু পরের লাইনেই ফের খটকা- 'ওই যে তোতা মিয়ার গা-ঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা বিন্যাকুড়ি।' মানে কি- কোথা নয় কেউ?
থমকালাম। মানে থামলাম। 'কিযীপাঠ'-এর অভ্যাস আছে। গেলো দুই তিন বছরের অভ্যাস। কিযী মানে- কিযী তাহনিন। তার লেখার ঢঙটা নিজস্ব বলে অন্যপাঠে এর মিল পাওয়া যায় না। তাই, অন্তত আমার কাছে 'কিযীপাঠ' একটি পৃথক বিষয়। বোধ করি আরও কিছু পাঠক কিযী তাহনীনকে এ কথা বলেছেন। নাই বলুক- তাতে কি? বস্তুত কিযী তাহনীনের লেখা একটি ভিন্নমাত্রা হয়েই ধরা দেয়।
সেবার ২০১৯ এ বই মেলায় যখন কিযীর প্রথম গল্পের বই বেরুলো- ইচ্ছের মানচিত্র, সেই বই দিয়ে কিযী তার গল্পের ঝাঁপি খোলেন মাত্র। সেই বইয়েরই পেছন প্রচ্ছদে বরেণ্য লেখক সাহিত্যিক শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন- ...কিযীর সৃষ্টিশীলতা যেন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছে, যে উচ্চতায় ওঠার অর্থ হচ্ছে একটা সময় আকাশটা ছোঁয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হওয়া।”
কিযী কি সেই আকাশটাই ছুঁইছেন- তার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ দিয়ে? গল্প পাঠ এগিয়ে না নিয়ে সেসবই খুব মনে হতে লাগলো। আর দৃঢ়ভাবে একটা কথা মনে হলো- এই বিন্যাকুড়ির আকাশ-পাতাল কোনো হটকেক গল্প নয়, যে এখনই এক নিঃশ্বাসে পড়ে তার সবটুকু রসাস্বাদন করে নেবো। এটি ধীরপাঠের গল্প। পাতা বন্ধ করে। সেটাই সাব্যস্ত হলো। সুবিধা মতো গল্পগুলো পড়ে নিতে হবে।
বস্তুত লেখালেখি নিয়ে প্রকাশ্য হওয়া কিযীর তিন বছরেরই ইতিহাস। কিন্তু সৃজনশীল পরিবারে জন্ম নেয়া কিযী তাহনীনের সৃজনশীলতার চর্চা ছোটবেলা থেকেই। ইদানিং সময়ে সামাজিক মিডিয়ার কল্যাণে, বিশেষ করে অ্যালগরিদমের কল্যাণে তো যখন যে যা কিছু দিচ্ছে, জানা-দেখা কিংবা পড়া হয়ে যাচ্ছে। গত দুই-তিন বছরই কিযীকে পাঠের সুযোগ মিলেছে। প্রথম দুটি বই- ইচ্ছের মানচিত্র (বইমেলা ২০১৯) আর আছে এবং নেই (বই মেলা ২০২০) এর গল্পগুলোতেও এই হটকেক ব্যাপারটা ছিলো না। সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ছিলো ভীষণরকম। কিন্তু কেনো যেনো এখন বোধ হচ্ছে- সেগল্পগুলো ঠিক দ্রুত পড়ে ফেলা গিয়েছিলো। এবারের মতো আটকে যেতে হয় নি। এতে অবশ্য পাঠকের যোগ্যতাও একটি বিবেচ্য বিষয়। পড়ে পড়ে পাঠক নিজেও তো তৈরি হয়। ফলে না পড়ার অভ্যাস আমাদের খুব অতৈরিই করে রাখে।
সে যাক বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে'র কথায় আসি। এতে কিযীর ১০টি গল্প স্থান পেয়েছে। ১০ গল্পে শত পৃষ্ঠা পার। সে দিক থেকে গল্পগুলো বড়ই বটে। যদ্দুর মনে পড়ে আগের বই দুটোতেই গল্পগুলোর দৈর্ঘ এর চেয়ে কিঞ্চিৎ ছোটই ছিলো। এ গল্পগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। কেনো বড়? কারণ বড়ই দরকার। একটাকার ঈদ আনন্দকে ঘিরে বিন্যাকুড়ির আকাশ পাতাল কোনো গল্প নয়, বাস্তবতাই ধরা দেয় সে কাহিনীতে।
গল্প মানে যে অতিকল্পনার রাজ্যে ডুবে গিয়ে কল্পকাহিনী নয়, গল্প যে স্রেফ প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলীর মাঝে আবেগঘন কোনো বিষয়ের বর্ণনাবিস্তার তা কিযীর 'বিলম্বি টান' বুঝিয়ে দেবে। এভাবেই তার গল্পগুলো- 'মধ্য দিনের গান', 'মনোভূমির জল', 'আষাঢ়ে' কিংবা 'হলেও হতে পারে প্রেম' সবই আশেপাশের মানুষের কাহিনী। জীবনের সাথে জড়িত সব বিষয়ের বিন্যাস। তবে 'একটি সম্পূর্ণ রঙিন সিনেমা'য় কিযী অতি পারঙ্গমতায় যে অন্ধ মানুষটিকে নিয়ে তার গল্পের জমিন সাজিয়েছেন আর গল্পের পরতে পরতে যে গ্রামবাংলার প্রকৃতির বিন্যাস দেখিয়েছেন তা পাঠককে কেবল গল্পই পড়াবে না, প্রকৃতিকেও চেনাবে। দারুণভাবেই চেনাবে। কিন্তু আবার কিযী'র অপর চরিত্র ফিওনাকে দেখুন। শহুরে, আধুনিক, সফল এক ফ্যাশনিস্তার গল্প- 'ফিওনা ফ্যাশনিস্তার মুখোশ বিলাস'। পাঁচতারা হোটেলের ইকেবানার রঙ আর গায়ে মেখে আসা সৌরভ যাতে দারুণভাবে উঠে এসেছে। সারাদিনের ক্লান্তির পরেও মুখের রঙ, চোখের ভাষা একদম সতেজ। কিন্তু সে যে কেবলই মুখোশ তা গল্পের গভীরে ভীষণভাবে প্রোথিত।
এ জন্যই বলেছি, গল্পগুলোকে পুরোপুরি বুঝতে ধীরে পড়তে হবে।
কারণ বুধ গ্রহের চাঁদে কেউ কি ভাবতেও পারছেন জয়নুল বলে চরিত্র তৈরি করে তাতে সেঁধিয়ে দেওয়া যেতে পারে স্বয়ং শিল্পাচার্যকে। কিযী তাই করেছেন, দারুণ পারঙ্গমতায় করেছেন। ব্রহ্মপুত্রের ধারে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা এক তরুণীর ছবি, জয়নুলের আঁকা। আর তাতে পাবলো নেরুদার লিখে রাখা- তুমি খুব তোমার মতন অন্যরকম, আমার ভালোবাসায়। কী খটকা লাখছে। কোথা থেকে কোথায়! পড়েই দেখুন সবটা বুঝতে পারবেন।
আর কেবল গল্প বলেই তো কথা নয়। কিযীর লেখার ধার তার শব্দের ব্যবহারে, ছোট ছোট বাক্যের বিন্যাসে আর অতি সাধারণ কথাটিকে অন্যন্য সাধারণ করে বলার ভঙ্গিমাতেও। হলফ করে বলতে পারি কিযীর লেখাকে ভালোবাসবেন।
এই তথ্যটিও গুরুত্বপূর্ণ- বইটি প্রকাশ করেছে সমাবেশ। পাওয়া যাচ্ছে : বইমেলায় ( পাঠকসমাবেশ, প্যাভিলিয়ন ১২)
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই