ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২১
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২১
খ ম হারূন- শংকিত পদযাত্রা |
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ ম হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-২১]
মনসুরুল আজিজ আমার প্রিয় একজন নাট্যকার। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭২ এর পর চলে আসেন মুক্ত বাংলাদেশে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে যোগদান করেন পুলিশ বাহিনীতে। একজন ভদ্র ও সৎ অফিসার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
১৯৮৮, বিটিভির অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান একদিন আমাকে মনসুরুল আজিজ এর সাথে আলাপ করিয়ে দেন। মনসুর ভাই তখন সচিবালয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে বসতেন। সহকারী আইজি। প্রথম যেদিন তাঁর অফিসে গেলাম, তিনি আমার হাতে একটি ধারাবাহিক নাটকের স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দিলেন। তাঁর ইচ্ছা আমি ধারাবাহিকটি পরিচালনা করি। শুরুতে অন্য একটি নাম ছিলো, যা আমার মনে দাগ কাটতে পারেনি। হঠাৎ এক রাতে নাটকটি পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, এখন এই যান্ত্রিক সভ্যতার বাইরে গিয়ে অরণ্যকে আহবান করা যেতে পারে। সাথে সাথে মনে হয় ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ নামটি হলে কেমন হয়। পরদিন নাটক বিভাগের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ভাইকে আমার এই নাম পরিবর্তনের কথা বললাম। তিনি আমাকে কারণ ব্যাখ্যা করতে বললেন। আমি আমার যুক্তি উপস্থাপন করলাম। তিনি মেনে নিলেন। নাট্যকারও মেনে নিলেন। সেই সাথে তিনি পুলিশ বিভাগ হতে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দিলেন।
মনসুরুল আজিজের অফিস রুমে একটি শহীদ স্মৃতি মিনার এর মডেল দেখলাম যা আমাকে আকৃষ্ট করলো। মডেলটি সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, এটা তিনি বানিয়েছেন পুলিশ বিভাগের জন্য। একটি বড় কাজে তিনি হাত দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সদস্যদের স্মরণ করে। আমরা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে যে উঁচু স্মৃতি মিনারটি দেখি সেটির আর্কিটেক্ট মনসুরুল আজিজ। তখন (১৯৮৮) সেটি নির্মাণাধীন ছিলো। সে সময়ে মনসুর ভাই একদিন আমাকে তখনকার পুলিশের আইজি এ আর খন্দকার সাহেবের সাথে আলাপ করিয়ে দেন। আইজি সাহেবের রুমে তখন ঢাকার পুলিশ কমিশনার নসরুল্লাহ্ খান উপস্থিত ছিলেন। সকলেই এ নাটকটি বিটিভিতে প্রযোজনা করার ব্যপারে আমাকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ ছিলো চার পর্বের মোট চার ঘন্টার একটি ধারাবাহিক। স্ক্রিপ্টটি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছিলো। সব ধরনের বাহুল্য বর্জিত, অত্যন্ত সমসাময়িক। অনেক কিছু করার সুযোগ আছে এ নাটকে। সমাজে মাদকের ব্যবহার থেকে যুব সমাজকে সচেতন করা ছিলো এই নাটকের অন্যতম লক্ষ্য। অতএব কাজে নেমে পরলাম। ধারাবাহিকটির মূল চরিত্রে ছিলো কয়েকজন ড্রাগ এ্যডিক্ট তরুণ। প্রথমেই এই সব চরিত্রের খোঁজ করতে শুরু করলাম। মূল চরিত্রে একটি নতুন মুখ চাই। পেয়ে গেলাম তৌকির আহমেদকে থিয়েটার এর ‘তোমরাই’ নাটক দেখতে গিয়ে। যে রকম একটি চেহারা চেয়েছিলাম, সে রকম। তাছাড়া ‘তোমরাই’ নাটকে সে অনেক ভালো অভিনয় করেছিলো। তৌকির তখন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের ছাত্র। তার কথা শুনে মনসুরুল আজিজ বেশ খুশী হলেন। তিনিও এই ধরনের একটি নতুন মুখ প্রত্যাশা করছিলেন।
এ প্রসঙ্গে তৌকির আহমেদ এর কিছু কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।
প্রযোজক খ ম হারূন 'ফিরিয়ে দাও অরণ্য' নামের একটি ধারাবাহিকের জন্য একজন তরুণ খুঁজছিলেন। চরিত্রটিকে হতে হবে কলেজপড়ূয়া। কিন্তু নামি অভিনেতার মাঝে কলেজ পড়ূয়া চরিত্রের জন্য তেমন কাউকে খুঁজে পাননি। তখন আবদুল্লাহ আল মামুন তাকে বলেছিলেন, 'আমাদের দলে একটি ছেলে আছে, ভালো অভিনয় করে। এই চরিত্রের জন্য মানানসই।' তার কথা শুনে খ ম হারূন আমাকে অডিশনের জন্য ডাকেন। তার আগেও একবার টিভিতে অডিশন দিয়েছিলাম। কিন্তু সেবার অডিশনে টিকতে পারিনি। তারপরও আত্মবিশ্বাস ছিল, এবার কিছু হবে। সেই বিশ্বাস থেকেই আবার বিটিভিতে অডিশন দিই। পাস করি। এরপর প্রথম টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য' নাটকের চার পর্ব প্রচার হওয়ার পর বেশ সাড়া পেতে থাকি। দেখি পথে ঘাটে নানাজন আমার দিকে একটু অন্যভাবে তাকাচ্ছে। যেন আমি তাদের অনেক চেনা। আমিও বুঝতে থাকি, টিভি নাটক আমাকে অনেকের কাছে পরিচিত করে তুলেছে। এরপর অভিনয়ে ভালো কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা বাড়তে থাকে। কাজ করতে থাকি চ্যালেঞ্জ নিয়ে।
----
আসলেই তৌকির অত্যন্ত চ্যালেন্জ নিয়ে চরিত্রটি করেছিলো। সিরিঞ্জ দিয়ে ড্রাগ নেবার দৃশ্যটিও ছিলো বাস্তব। কোনো লুকোচুরি করা হয়নি। সে অনেক কষ্ট করে তার চেহারায় একটা পরিবর্তন আনতে পেরেছিলো। নাটকে তৌকিরের ড্রাগ এডিক্ট বন্ধুদের চরিত্রে ছিলো মুনিরা বেগম মেমি ও আব্দুল বারিক মুকুল। জামালউদ্দিন হুসেন ও নাজমা আনোয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আলোচিত পুলিশ কমিশনারের চরিত্র রূপায়ন করেছিলো কাওসার চৌধুরী। নাটকটি নিয়ে কাওসার এর একটি স্মৃতিচারণ আমার মনোযোগ কেড়েছে। তার কাছ থেকেই শুনি এ সম্পর্কে কিছু কথা।
----
যে নাটকটির বদৌলতে পুলিশের ভূমিকায় আমাকে দেখছেন- তার শিরোনাম ছিল ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’। নাটকটি লিখেছিলেন পুলিশের তখনকার এআইজি (পরবর্তীকালে ডিআইজি) মনসুরুল আজিজ (প্রয়াত)। প্রযোজনা করেছিলেন খ ম হারূন।
নাটকটির বিষয়বস্তু এবং কাহিনী আবর্তিত হয়েছিল তখনকার সময়ে তরুণদের মাঝে ড্রাগের ব্যবহার আর তার প্রতিরোধ নিয়ে। আমার চরিত্রটি ছিল ‘প্রতিরোধকারী দলের’ নেতৃত্ত্ব দেয়া। এই নাটকে আইজিপি’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জহুর ভাই (জহুরুল ইসলাম, ডলি জহুরের প্রয়াত জীবনসঙ্গী)। এছাড়াও জামাল ভাই (জামালউদ্দিন হোসেন) মুনিরা ইউসুফ মেমী, মুকুলসহ আরো বেশ ক’জন অভিনয় করেছিলেন এই নাটকে। টেলিভিশনে তৌকির আহমেদ অভিনীত প্রথম নাটক ছিলো এই ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য‘।
প্রযোজক হারূন ভাই (খ ম হারূন) আমাকে এই নাটকের স্ক্রীপটি দেয়ার পর আমি এই চরিত্রে অভিনয় করবো কী না তা নিয়ে একোটু গড়িমসি করছিলাম। কথায় বলে, ‘মোটেই মা রাঁধে না, তপ্ত আর পান্তা’; আমার অবস্থাও ছিল ওরকম প্রায়। এমনিতেই চান্স জোটেনা, তার ওপরে আবার আলগা ফুটানি! এই নাটকের স্ক্রীপ্ট যখন আমার হাতে আসে, তার আগের সপ্তায় রবিঠাকুরের ‘মধ্যবর্তিনী’ নাটকটি প্রচারিত হয়। আমি ছিলাম সেই নাটকের সুবোধ নায়ক! আমার বিপরীতে ছিলেন শামীম আরা নীপা। তখন আমি বিটিভিতে সবেমাত্র একক-নায়ক আর রোমান্টিক চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছি মাত্র। টার্গেট ছিল টিভিতে ‘রোমান্টিক নায়ক’ হওয়ার! কিন্তু কোথাকার জল কোথায় গিয়ে যে দাঁড়ালো, ভেবে পাই না! ওরকম নায়ক হওয়ার জন্য যে যোগ্যতা থাকা দরকার ছিল, সে রকম কিছু অবশ্য আমার মাঝে তেমন খুব একটা আমি দেখিওনি কোনদিন! যাক গে। ‘মধ্যবর্তিনী’ নাটকে আমার অভিনয় দেখে ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ নাটকের রচয়িতা এআইজি মনসুরুল আজিজ প্রযোজককে বলেছিলেন, এ রকম লাল্টুমার্কা একজনকে দিয়ে পুলিশ কমিশনারের অভিনয় করাবেন কী করে! বলে নেয়া ভালো- আমার সাথে তখনো নাট্যকারের দেখাই হয় নি। পরিচয়ও ছিলনা কোনদিন। কিন্তু হারূন ভাই আমাকে দেখেছেন মঞ্চে অভিনয় করতে। উনি আমার অভিনয় সম্পর্কে আস্থাশীল থাকায় শেষপর্যন্ত ওই নাটকে আমার অভিনয় করা হয়েছিল আর কি!
অবশ্য এই নাটকে অভিনয়ের পেছনে আমার প্রয়াত স্ত্রীর ভূমিকাও যথেষ্ট জোরালো ছিল। একদিন সকাল ১১টার দিকে ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ নাটকের পান্ডুলিপিটা বগলদাবা করে আমি বের হচ্ছিলাম রামপুরায় গিয়ে ওটা হারূন ভাইয়ের কাছে ফেরত দেবো বলে! কিন্তু আমার স্ত্রী বললেন, তুমি কিন্তু চরিত্রটি করবে কীনা তা নিয়ে আর একটু ভেবে দেখতে পারো ! আমি বলি, কেন? স্ত্রী বললো, তুমি সেদিন মহিলা সমিতি থেকে তোমাদের নাটকের পোশাকেই বাসায় ফিরেছিলে। তোমার পরনে আর্মির পোষাক ছিল। তোমাকে পুলিশ কিংবা আর্মির চরিত্রে বোধহয় খারাপ লাগবে না! কথা শুনে আমি একটু থমকে যাই! বলে নেয়া ভালো; আমি ততদিনে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এ কাজ শুরু করেছি। মঞ্চে তখন আমাদের নিয়মিত প্রযোজনা ছিল আইরিন শ-এর লেখা নাটক ‘কবর দিয়ে দাও’। নাটকটি রুপান্তর করেছিলেন জামাল ভাই (জামালউদ্দিন হোসেন) এবং পরিচালনা করেছিলেন আমাদের আতা ভাই (আতাউর রহমান)। ওই নাটকের একটি চরিত্রে ‘অল্টারনেটিভ’ হিসেবে হঠাৎ আমি পরপর তিনটি প্রদর্শনীতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যাই। সেই চরিত্রটি ছিল একজন সেনা সদস্যের। একদিন অভিনয় শেষে খুব তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরেছিলাম, কস্টিউম চেঞ্জ কিংবা মেক-আপ না তুলেই। আর তখনই স্ত্রীর বিবেচনায় পুলিশ কিংবা আর্মি বনে যাই! সার্টিফিকেট পেয়ে যাই পুলিশ সাঁজবার। আমি অবশ্য প্রতিটি স্ক্রীপ্ট নিয়ে প্রথমেই আমার স্ত্রীর সাথেই শেয়ার করতাম। নাটক নিয়ে শুধু আলোচনাই নয়, নাটকে আমার সংলাপ মুখস্ত করাবার ক্ষেত্রেও তার ছিল অনেক বড়ো অবদান। হায়, আমার স্ত্রী অকাল প্রয়াত হলেন কর্কট ব্যাধিতে! প্রার্থনা করি - আমার স্ত্রীর আত্মা যেনো চিরশান্তিতে থাকে।
এরমাঝেই এলো এই চ্যালেঞ্জিং চরিত্রটি। আমার প্রকৃত বয়স তখন তিরিশ কি বত্রিশের কোঠায়! কিন্তু পুলিশের এই চরিত্রটি ছিল পঞ্চাশোর্ধ বয়সের। তারওপরে চরিত্রটি আবার সমাজের বিশেষ ক্যাটাগরির! আমাদের দৈনন্দিন চরিত্রের সাথে যায়না এর ধাঁচটি। ফলে একজন ‘পুলিশ কমিশনারের’ চরিত্রের যে বৈশিষ্ট; তাঁর আচার-আচরণ, চলাফেরা, জেশ্চার-পোশ্চার সবকিছুই নতুনভাবে রপ্ত করতে হয়েছিল আমার!
আজও মনে আছে, সেই চরিত্রটি ধারণ করার জন্য আমি এআইজি মনসুরুল আজিজের অফিসিয়াল চেয়ারের পাশে একটি অতিরিক্ত চেয়ারে বসে প্রায় দিন পনের অফিস করেছিলাম উনারই পরামর্শে! কিভাবে তিনি চেয়ারে বসেই সালাম নেন, ফাইলে স্বাক্ষরশেষে কীভাবে সেটা ফেরৎ দেন, কিংবা কতখানি হাত নেড়ে কথা বলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেককিছুই! তবে শিরদাঁড়া সোজাকরে চেয়ারে বসবার অভ্যেসটি তখোন থেকেই হয়েছিল!
আমার, অর্থাৎ ডিএমপি’র কমিশনারের নিজের কামরায় অভিনয়টুকু আমরা সত্যি সত্যিই বেইলী রোডে ডিএমপি কমিশনারের অফিসেই করতাম। শুটিং হতো রেড-বিল্ডিং-এ ডিএমপি কমিশনারের খাস কামরায়। ওখানেও ঘটতো নানান ঘটনা।
একদিনের কাহিনী বলি। সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমাদের সবাইকে নিয়ে বিটিভি’র একটি গাড়ি (মিনি বাস) এসে থামলো কমিশনার সাহেবের অফিসের গেটে, বেইলী রোডের কোনায়। পুরো শুটিং টিম তখন আমাদের এই গাড়িতে। হারূন ভাই আমাকে জোর করেই গাড়ি থেকে নামালেন সবার আগে। কমিশনারের র্যাংক আর পোশাক পরে আমি গেটের দিকে যাবার সাথে সাথেই গেটের সেন্ট্রি গগনবিদারী চীৎকার ছেড়ে আকাশের দিকে রাইফেল তুলে মাটিতে সজোরে পা-ঠুকে সালাম জানালো। আমিও যথারীতি পুলিশী কায়দায় সালাম গ্রহন করে ঢুকে গেলাম অফিসের ভেতরে।
মনসুর ভাই (এআইজি মনসুরুল আজিজ) আগেই অবশ্য আমাকে এসব বিষয়গুলো সম্পর্কে শিখিয়ে পড়িয়ে ‘কমিশনার’ বানিয়ে রেখেছিলেন। তিনি বলতেন, স্যালুটতো ওরা অভিনেতাকে দেয়না, স্যালুট দেয় ‘ইউনিফরম আর র্যাংক’কে। সুতরাং যতক্ষণ তুমি ওই পোশাক এবং র্যাংক পরে আছো, ততক্ষণ তোমাকে ওই স্যালুটের মর্যাদা নিতে এবং দিতেই হবে। আমি ওই র্যাংকওয়ালা পোষাক পরিধানের সাথে সাথে মনসুর ভাইও কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে সালাম জানাতেন। তখন নিজেকে খুব ক্ষমতাবান মনে হত! বুকের ভেতরে এক ধরণের পুলকিত বাতাস অনুভব করতাম, যার কোন যৌক্তিক পাটাতন ছিল না!
প্রতিটি প্রফেশনের আসলে একেক ধরণের বিশেষত্ব এবং শৃংখলা থাকে। দীর্ঘ চার মাস এই নাটকে অভিনয় করে আমি পুলিশের কিছু কিছু ডিসিপ্লিন খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
একদিন ওই নাটকের জন্য বিটিভি স্টুডিওর রেকর্ডিং সেরে বাসায় ফিরছিলাম রাত প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে। আমি তখোন এলিফ্যান্ট রোডে থাকি। একটি রিকশা নিয়ে একাই ফিরছিলাম। আমার রিকশাটি কাটাবন মসজিদের কাছে আসতেই দুদিক থেকে দু’তিন জন পুলিশ এসে থামালো আমায়। একটু কড়া সুরে জিজ্ঞেস করলো আমার পরিচয়, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাচ্ছি এত রাতে? সাথে এত বড় স্যুটকেসই বা কেন? ওটার ভেতরে আছেটা কি; ইত্যাদি এক গাদা প্রশ্ন। আমি যথারীতি সবগুলো প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাই একে একে। তাতেও তারা সন্তুষ্ট না হয়ে আমাকে স্যুটকেস খুলতে বলেন। আমি স্যুটকেস খুলে দেখাই তাদের। কপাল মন্দ, সেদিন স্টুডিওতে ছিল পারিবারিক সিকোয়েন্সগুলোর অভিনয়। নইলে পুলিশের পোষাক দেখিয়ে ‘বাট’ নিতে পারতাম হয়তো! কিন্তু যা আছে সেটা দেখিয়েই তাদের ক্ষ্যান্ত করি।
এরপরে বিদায়ের পালা। পুলিশ বললো- ঠিক আছে যান আপনি। এটা বলেই তারা চলে যাচ্ছিলেন। আমিই একটু বাহাদুরি দেখাবার জন্য ওদের ডেকে বলি, দেখেন ভাই, আমি কিন্তু টিভির একটি নাটকে পুলিশ কমিশনারের ভূমিকায় অভিনয় করছি। ওটার রেকর্ডিং শেষ করেই আমি ফিরছিলাম। ওই নাটকটি লিখেছেন আপনাদের একজন এআইজি। আপনারা যে এতক্ষণ এখানে আটকে আমাকে হেনস্তা করলেন, তার জন্য আমি কিন্তু এআইজি সাহেবকে বলে আপনাদের পানিশমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারি, কালকেই!
ওরা তিনজনই আবার আমাকে ঘিরে ধরলো দু’দিক থেকে। বললো- অই মিয়া, রাইতের বেলায় হগল বেডায় আইজি সাহেব আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বন্ধু কিংবা আত্মীয় স্বজন হইয়া যায়। ওইগুলা আমাগো দেহা আছে। অহন কি সোজা নিজের বাসায় যাইবেন, নাকি আমগো লগে রমনা থানায় যাইবেন? মিছা কথা কইয়া, পুলিশের নাম ভাঙ্গাইয়া হামকি ধামকি দেওনের লাইগা আমরা আপনেরে কাল সকালেই কোর্টে চালান দিতে পারি। অহন কোনডা করবেন? বাসায় যাইবেন, নাকি চৌদ্দ শিকের ভিতরে? রাতডা কিন্তু ভালই কাটবো কইলাম মশার কামড় খাইয়া! কথা না বাড়িয়ে আমি রিকশাওয়ালাকে আগে বাড়তে বলি।
মনে মনে ভাবি- নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অভিনয় করলেই কি আর ‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার’ মালিক হওয়া যায়!
——-
কাওসার চৌধুরী’র স্মৃতিচারণ থেকে ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য‘র অনেক কথাই বলা হয়ে গেছে। তবে একটা ছোটো ঘটনার কথা না বলে পারছিনা। মাদকের পয়সা জোগার করার জন্য তৌকির, মুকুল ও তার আরেকজন সঙ্গী গুলশান এলাকায় একটি ছিনতাই করে। কিছুক্ষনের মধ্যে টহল পুলিশের গাড়ী এসে তাঁদেরকে গ্রেফতার করে। দৃশ্যটি চমৎকারভাবে ধারন করেন ক্যামেরাম্যান নজরুল ইসলাম। সে রাতে কাজ শেষ হতে হতে বেশ দেরী হয়ে যায়। মাঝরাতে আমি বিটিভির গাড়িতে টিকাটুলির বাসায় চলে আসি। তার আগে নজরুল ভাই নেমে যান মতিঝিল থানার সামনে। কাছেই তার বাসা।
আমি নিজ বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতেই নজরুল ভাই এর টেলিফোন পেলাম। বললেন, “হারূন, আমাকে নামিয়ে তো আপনারা চলে গেলেন। আর এদিকে মাইক্রোবাস থেকে নামার পরপরই সত্যিকারের ছিনতাইকারীরা আমাকে ঘিরে ধরে। তাও মতিঝিল থানার সামনে। মানিব্যাগ, ঘড়ি, আংটি, জামা সব নিয়ে গেছে। এখন গেন্জি পরেই থানায় ঢুকেছি জিডি করতে।”
কি কাকতালীয় ব্যপার।
[চলবে]
আগের পর্ব পড়ুন
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২০
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই