শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি ২]

কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক

১৯:৩২, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৭:৩৬, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

১৭১২

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি ২]

গিরিপথ

প্রথম বসন্তের চমৎকার এক দিন। আকাশের নীল গম্বুজের নিচে ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। খোরাসান মানে হল সূর্যের দেশ। এ দেশে মাত্র কয়েক প্রজন্ম আগেই আগুনের স্তম্ভ জ্বেলে সূর্যের পূজা করা হতো। সূর্য মনে হয় সেটা জানে, আর তা জেনেই যেন সে নিচের এ দেশটার ওপর উদার হস্তে তার দীপ্তির পূর্ণ আশির্বাদ ঢেলে দিয়েছে।

মার্ভ* থেকে যে কষ্টসাধ্য গিরিপথটা নিশাপুরের উপত্যকার দিকে গেছে, জমকালো একটা কাফেলা সেই পথের একটা পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়াল। একনজর দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে এটা সাধারণ বণিকদের কাফেলা নয়। খাঁটি আরবি জাতের ঘোড়াগুলোর সৌন্দর্য, কর্মচারীদের দামী অঙ্গসজ্জা, চাকরদের সংখ্যা, উটের পিঠে নানা ধরনের তাঁবু খাটানোর মাল-মসলা, অসাধারণ মনোহারিত্বে সাজানো পালকি, এসব দেখে যে কেউই ভাববে যে এই পাহাড়ি পথ বেয়ে কোনো অভিজাত বহর যাচ্ছে। এমনকি এটা কোনো রাজকীয় কাফেলাও হতে পারে।

সত্যি সত্যি এটা একটা রাজকীয় কাফেলা। সেলযুক সুলতান মালিক শাহ তার সমস্ত সভাসদ নিয়ে নিশাপুর** যাচ্ছিলেন। কাফেলা যখন পাহাড়চূড়ায় পৌঁছুল, হঠাৎ করেই তাদের সামনে প্রশান্ত উপত্যকা তার অবগুণ্ঠন খুলে দিল। কাফেলাকে থামার আদেশ দেয়া হল যাতে সবাই এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। শীতে জমা বরফ তখনও না গলায় ডানে-বাঁয়ের উত্তুঙ্গ পাহাড়চূড়াগুলো যেন শ্বেতশুভ্র চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। অনেক নিচে, তাদের পাদদেশে হাতের তালুর মত বিস্তৃত সমতলভূমি, যেখানে নীলাভ জলের হালকা দীপ্তি নিয়ে ফুল আর ফলের কুঞ্জঘেরা অনেক অনেক গ্রাম গড়ে উঠেছে। ডানদিকে ‘পূবের প্রবেশদ্বার’ সেই নিশাপুর। চারদিকে প্রতিরক্ষা-দেয়াল দিয়ে ঘেরা শহরটির মাঝখানে মসজিদের গম্বুজগুলো সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। যতদূর চোখ যায় উর্বর অঞ্চলে নিজ সমৃদ্ধির আনন্দে উদ্বেল বর্ধিষ্ণু জনপদের সাক্ষ্য ছড়িয়ে রয়েছে।

মালিকশাহের ভ্রাতুষ্পুত্র ইবরাহিম নিয়াল খোরাসানের শাসনকর্তা। তিনি আগে থেকেই জানতেন সুলতান আসছেন। তাঁর অভ্যর্থনার সকল ব্যবস্থা করে নিশাপুর থেকে তিনি আগের দিনই চলে এসেছেন যেন পথেই সুলতানকে স্বাগত জানাতে পারেন। তিনি এমনসময়ে যাত্রা করেছেন যেন সুলতানের কাফেলা ওই চুড়ায় পৌঁছুনোর পরপরই তার সুসজ্জিত দলকে দেখতে পান। তিনি ইস্তিকবাল প্রথা পালন করতে এসেছেন। দুদলের সম্মিলনে এক দারুন সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা হল। ইব্রাহিম নিয়াল অসাধারণ একদল অশ্বারোহী নিয়ে এসেছেন। ছবির মত ঝলমলে পোষাক পরে তিনি এমন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এসেছেন যেগুলোর নামই তাদের জাতের পরিচয় দেয়। ইবরাহিম নিয়াল ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে জিনটা একজন ঘোড়া-দেখভালকারীকে দিলেন। তারপর সুলতানের দিকে এগিয়ে মাথা নিচু করলেন, আরও নিচু হয়ে মাটিতে চুমু খেলেন, এবং সুলতানকে অভিবাদন জানালেন। 

সুলতান মালিক শাহ সালামের জবাব দিলেন আর নিজ ভাস্তেকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়ে গালে চুমু খেলেন। এরপর তারা তুর্কি ভাষায় প্রাণবন্ত কথাবার্তায় মেতে উঠলেন। মনে হচ্ছিল কোনো কিছুই এ দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের আলাপচারিতায় বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। মালিকশাহ’র ভ্রুুযুগল প্রশান্তির বার্তা দিচ্ছিল, আর ইব্রাহিম নিয়ালের মুখে ছিল সন্তুুষ্টির আভা। সুলতান তখন যৌবনের মধ্যগগণে। একটু মোটাসোটা হলেও শরীরের গাঁথুনি মজবুত আর চালচলনে অত্যন্ত ক্ষিপ্র। কালো চোখ দুটিতে ঔৎসুক্য আর গোঁফ সরু কিন্তু লম্বা। মুখ নিষ্ঠুরও নয় আবার সংবেদনশীলও নয়। পুরো ব্যক্তিত্ব জুড়ে এমন একটা পরিশীলিত ভঙ্গী যা প্রাচ্যের অসীম ক্ষমতার তলোয়ারধারী রাজন্যবর্গের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। 

ভাস্তের চেহারাও অনেকটা সুলতানের মতই, কিন্তু অতটা বুদ্ধিদীপ্ত নয়। বরং কাঠিন্যের ছাপ আছে, আর চঞ্চল ও নিষ্ঠুর চোখ দুটিতে অহংকারী দৃষ্টি। ক্ষমতা পেলে তিনি মর্জিমাফিক এবং অত্যন্ত রুঢ়ভাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। ভদ্রতাসূচক বাক্য বিনিময় এবং দিনের চমৎকার আবহাওয়া নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সুলতানকে স্বাগত জানানো এবং বিনোদনের জন্য কী কী ব্যবস্থা করা হয়েছে, তিনি সেগুলো মালিকশাহকে জানাচ্ছিলেন। 

তারা দুজন যখন আলাপে মশগুল, অদূরেই তখন আর দুজনের দেখা হল। সুলতানের সঙ্গে তার পারিষদদের সবাই আর অনেক চাকর-বাকর এসেছে। যিনি সমস্ত ব্যবস্থাপনা করেছেন, এবং সবকিছু সুচারুভাবে সম্পন্ন হবার কৃতিত্ব যাঁর, তিনি উজির নিজামুল মুলক। মালিক শাহের পিতা আলপ আরসালানেরও তিনি উজির ছিলেন। নিজ কর্মদক্ষতা আর ব্যবস্থাপনার গুণে তিনি প্রয়াত সুলতানের নিকট অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলেন। নতুন সুলতানের সময়ে তার কদর বেড়েছে বই কমেনি। পদের তুলনায় বয়স একটু কম, কিন্তু তার উপর অর্পিত প্রতিটি দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত সক্ষম এমন সুদক্ষ ব্যক্তি এক শতাব্দীতে একজনই দেখা যায়। তাকে একনজর দেখলেই তার দক্ষতা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার শান্ত কিন্তু উজ্জ্বল চোখে প্রখর চাহনি, প্রসারিত ভ্রুযুগল, দৃষ্টিনন্দন দীর্ঘ নাক, সুন্দর কিন্তু দৃঢ় মুখাবয়ব, শুভ্রতম দাঁতের সারির এমন সমাবেশ সচরাচর চোখে পড়ে না। খাঁটি পারস্য-বংশোদ্ভূত এই রাজপুরুষের গাঁয়ের রঙ কালো হলেও তার দেহের গঠন সাক্ষ্য দেয় যে তিনি আর্য রক্তের উত্তরাধিকারী। 

ইব্রাহিম নিয়ালের তাঁবুতে এমন একজন এসেছেন যিনি নিশাপুরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তাঁর নামের সঙ্গে অনেক উপাধি যুক্ত যেগুলো তাঁর যোগ্যতা ও গৌরব প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু তিনি ‘ওমর আল খৈয়াম’ বা ‘তাঁবু নির্মাতা খৈয়াম’ হিসেবে বেশি পরিচিত। খৈয়াম বা তাঁবু নির্মাতা তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম, ফার্সিতে যাকে বলে তাখাল্লুস। পিতার নামের সঙ্গে খৈয়াম পদবি থাকায় তিনি এটাকেই তার ছদ্মনাম হিসেবে বেছে নেন, যদিও তিনি বা তাঁর পিতা কেউই তাঁবু নির্মাণ করতেন না। একটা রুবাইয়ে তিনি তার এই উপাধি নিয়ে শব্দের খেলা করেছেন:
            “খৈয়াম কে খেইমেহায়ে হিকমাত মিদুখত,
            দার কুরেইয়ে ঘাম ফেতাদ ও নাগাহ বেসুখত,
            মেগরায-এ আজাল তানাবে উমরাশ বেবুরিদ,
            ফাররাশে গাজা বে রায়ে গানাশ বেফুরুখত।”

            “দিন গেল যার জ্ঞানের তাঁবু সেলাই করে,
            চুলার পেটে সেই খৈয়াম আজ পুড়ে মরে,
            জীবন-সুতো কাটল হঠাৎ মরণ-কাঁচি
            ভাগ্যের দাস বেচল তাকে বিনা দরে।”***

‘জ্ঞানের তাঁবু’ শব্দ দুটিতে বিজ্ঞানে বিশেষত জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর আগ্রহের কথা ফুটে উঠেছে। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি রসকষহীন প-িত ছিলেন না। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই লোকে তাঁর গুণাবলি টের পেত। কালচে-বাদামী চোখদুটি ধ্যানমগ্ন, কিন্তু তাঁরা যেন সবসময়ই হাসছে। ভ্রু মসৃণ ও প্রশান্ত। তিনি কখনোই মেজাজ খারাপ করতেন না, কিন্তু প্রকৃতিগত মিশুকে রসবোধের কারণে ভৎর্সণা করতেও অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল সুষম আর পরিশীলিত। শারীরিক দিক থেকে লম্বা এবং খেলোয়াড়দের মত গড়ন। কিন্তু চলাফেরা দেখে স্পষ্ট বোঝা যেত যে আয়েশ ও আলস্যে তাঁর আপত্তি নেই। আরও স্পষ্ট বোঝা যেত যে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বা নৈতিক অবস্থানে গোঁড়ামির কোনো ঠাঁই নেই। আগে বেড়ে নিজেকে উপস্থাপন করা তাঁর অপছন্দের, কিন্তু আজ তিনি নিজ থেকেই ইবরাহিম নিয়ালের তাঁবুতে এসেছেন। অবশ্যি সেটার কারণও আছে - কদিন আগে বিশেষ বার্তাবাহক দিয়ে নিজাম-উল-মুলক তাঁকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন যে সুলতানের সঙ্গে তিনিও আসছেন। পুরনো সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি যে কত খুশি হবেন সেটাও নিজাম লিখতে ভুলেননি। 

দুজনের দেখা হলো। নিজাম-উল-মুলক এমন ভাব করছেন না যে তিনি বন্ধুর প্রতি প্রসন্নতা দেখাচ্ছেন, অন্যদিকে নিরহংকার প-িতের আচরণেও অতিরিক্ত বিনয়ের চিহ্ন অনুপস্থিত। বহুবছর আগে থেকেই তাঁরা বন্ধু, আর প্রকৃত বন্ধুত্বের ধর্মই হলো যে বিচ্ছেদের কারণে বা সময়ের ব্যবধানে তাতে বদল ঘটে না। তাঁরা দুজনে অন্যদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে একটা বড় লালচে পাথরের উপর বসলেন এবং গল্পে মশগুল হলেন। 

“আমি খুশি যে তুমি নিজের জ্ঞানচর্চা রেখে এখানে আসার সৌজন্য দেখিয়েছো,” নিজাম-উল-মুলক বললেন, “বিশেষত পাহাড় চড়ে এতদূর উঠে আসা তো সহজ কথা নয়। আমি ভেবেছিলাম যে আমরা শহরে পৌঁছে গুছগাছ শেষ করার পরই হয়তো তোমার সৌম্য মুখের দর্শন পাব। আমার জন্য যে তুমি এখানে এই পাহাড় চূড়া পর্যন্ত আসবে, এতটা ভাবিনি।”

“চিঠিতে তুমি যে সৌজন্য দেখিয়েছো তাতে আরও দশগুণ কষ্ট হলেও তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসতাম,” ওমর জবাব দিলেন। “সারা জগৎব্যাপী তোমার খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে। আজকের এই সকালের সোনালী রোদের মতই তা আমাদের উপত্যকাকেও পূর্ণ করে দিয়েছে। যে সূর্য দেশ-বিদেশে দীপ্তি ছড়াচ্ছে তাকে স্বাগত না জানানোর উপায় আছে?”

প্রাচ্যের লোকজন অতিরঞ্জনে আসক্ত এবং অবাস্তব দৃশ্যকল্প ও অতিশয়োক্তিতে আমোদ লাভ করে। তবে এর একশ’ বছর পর থেকে যেরকম দেখা গেছে সে তুলনায় এ দুজনের ভাষার আতিশয্য কমই ছিল। ওমরের স্বভাবের তুলনায় তিনি একটু বেশি আলঙ্কারিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নিজাম-উল-মুলক বুঝতে পেরেছিলেন এর মধ্যে একটুও ভণ্ডামি নেই। কিন্তু একটু শ্লেষ বা পরিহাসের আমেজ ছিল কি? কিন্তু ওমরকে তো তিনি আজ নতুন চিনেন না। সেই পুরনো ওমর, যে কোনোরুপ ভান বা ভণিতার ধার ধারে না, তাঁর কথায় বিরক্ত হবার বদলে উজির বরং আমোদই পেলেন। 

ওমর কিন্তু থামলেন না। মূহূর্ত পরেই বললেন,

“আমার মত একজন শ্রমবিমুখ মানুষ যে আলস্য জয় করে উপত্যকার তলদেশ থেকে এই চূড়ায় উঠেছি, আর কিছু না হোক চারপাশের এই মনোহর দৃশ্যাবলী দেখার আনন্দ তো আমার পাওয়ারই কথা। এর বাইরে, গত বিশ বছর যে বন্ধুকে দেখিনি, এবং যে তার হাজারো দায়িত্ব ও ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে মনে রেখেছে, তার দেখা পাওয়া সত্যিই সম্মান ও আনন্দের।”

ওমরের কণ্ঠে যে আন্তরিকতার সুর ছিল এবং বলবার সময় তাঁর মুখে যে আনন্দ ফুটে উঠেছিল তা বুঝতে কেউই ভুল করবে না। নিজাম-উল-মুলকও করলেন না।

“বন্ধু,” তিনি বললেন,“কত কথা যে তোমাকে বলার আছে, অতীতের কত স্মৃতি যে আবার জীবন্ত করে তোলার আছে! আমাকে কিন্তু অনেক সময় দিতে হবে। তোমাকে এখন সুলতানের কাছে নিয়ে যাব, কিন্তু তার আগে তোমার নিজের কথা কিছু শুনি। চাচা-চাচি কি বেঁচে আছেন?”

“বাবা বছর পাঁচেক আগে মারা গেছেন, মা এখনও বেঁচে। তিনি প্রায়ই তোমার কথা বলেন,” ওমর জবাব দিলেন। 

“আর তুমি? তুমি কি এই অবস্থানেই সন্তুষ্ট থাকবে? আরও উচ্চতায় পৌছুনোর আশা কি তোমাকে তাড়িত করে না?” নিজাম-উল-মুলক জিজ্ঞেস করলেন।

ওমরের গাল একটু আরক্ত হল। মূহূর্তের জন্য যেন তাঁর চোখে একটা স্ফুলিঙ্গ জ¦লে উঠল। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে নিজামকে পাহাড়ের পাদদেশে নিচের শহরটা দেখিয়ে বললেন,

“বন্ধু, ওই যে রুপার ফিতের মত ওটা দেখছো - গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে নিশাপুর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ওই ঝর্ণাটার নাম সেঘাব। ওটার স্বচ্ছ জলের পাশে বসে আমি স্বপ্ন দেখি। এরকম নদীতটে বসে স্বপ্ন দেখে দেখে গ্রীষ্মের দুপুর কাটানোর সাথে কোন উচ্চাশার তুলনা মেলে?”

“একথা বলছি বলে কিছু মনে করো না,” নিজাম-উল-মূলক বললেন, “ওরকম স্বপ্ন দেখে কাল কাটানোর জন্য তোমার কি যথেষ্ট জাগতিক সমৃদ্ধি দরকার নেই? সঙ্গতি না থাকলে গ্রীষ্মের খরতাপে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মত স্বপ্নও যে মিলিয়ে যাবে! তোমার কি আমাদের প্রতিজ্ঞার কথা মনে আছে? সেই যে ওস্তাদ মুবাফফাক*** এর কাছে পড়ালেখা করার সময় আমরা তিন বন্ধু কী প্রতিজ্ঞা করেছিলাম? এখন তোমার চাইবার পালা, আর আমার দেওয়ার।”

বিজয়ীর হাসি হেসে ওমর জবাব দিলেন, “এখনি ওসব নিয়ে আলাপের দরকার নেই। আগে তো আমার কী প্রয়োজন সেটা দ্যাখো।”

“সুলতান এদিকে তাকিয়ে আছেন,” উজির বললেন, “তোমাকে বোধহয় এখনি তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। চল যাই।”

সুলতানের তাকানো আদেশের মতই। নিজাম-উল-মুলক বন্ধুকে সুলতানের নিকট নিয়ে গেলেন। মালিক শাহ আবার যাত্রা শুরু করতে চাইছিলেন। কিন্তু ওমর ইবনে ইবরাহিম আল খৈয়ামকে স্বাগত জানানোর জন্য যতক্ষণ সময় দেয়া দরকার, সেটা দিলেন। নিজাম-উল-মুলক ওমরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন খোরাসানের ইমাম, বিজ্ঞানের আলো এবং ইবনে সিনার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। জানালেন, তিনি শুধু কবিই নন, গণিতশাস্ত্রেরও রাজপুত্র।

“বহু দিনের ইচ্ছে ছিল আপনার সাথে পরিচিত হবার, আজ সেটা পূরণ হল,” মালিক শাহ বললেন। তারপর নিজাম-উল-মূলককে দেখিয়ে বলে চললেন, “আপনার এই খাঁটি বন্ধু বহুদিন ধরেই আমার কানে আপনার বিষয়ে মধুবর্ষণ করছিল। এই যে নিশাপুর আসছি, এর একটা কারণ ছিল আপনাকে দেখা, এবং আপনার প্রসন্নতা লাভ করা।”

সুলতানের কাছ থেকে এরুপ স্তুতিবাক্য মধুর মতই মিষ্টি ছিল, কিন্তুু ওমরের মত একজন জ্ঞানী ব্যক্তির তাতে মাথা ঘুরে যাওয়ার কথা নয়। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, তাতে তাঁকে দেখলে যে চমৎকার ধারণা জাগে সেটা আরও পাকাপোক্ত হল। সেই মূহূর্ত থেকেই মালিক শাহ ওমরের বন্ধু এবং পৃষ্ঠপোষক বনে গেলেন। 

সুলতানের ইঙ্গিত পেয়ে কাফেলা আবার নিশাপুরের দিকে যাত্রা শুরু করল। (ক্রমশঃ)

----------------------------------------

* মার্ভ - প্রাচীন সিল্করোডের অন্যতম শহর। এটি বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের মারে শহরের কাছাকাছি অবস্থিত ছিল। খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর থেকে এখানে মানব বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। শহরটি এর সমৃদ্ধির শিখরে উঠেছিল দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। ১২৮১ সালে মোঙ্গলরা এ শহর দখল করে এবং সমস্ত শহরবাসীকে (পাঁচ থেকে দশ লক্ষ হতে পারে বলে অনুমান করা হয়) হত্যা করে। পরে আবার গড়ে তোলা হলেও এটি আর কখনও পূর্বের গৌরব ফিরে পায়নি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে শহরটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

** নিশাপুর - ইরানি উচ্চারণে নিশাবুর। বর্তমান ইরানের উত্তর-পূর্ব কোণে মাশাদ শহর থেকে একশত ত্রিশ কিলোমিটার দূরে এ শহরটি অবস্থিত। খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে শাপুর এটি প্রতিষ্ঠা করেন বিধায় তার নাম অনুসারে এর নাম হয়েছে নিশাপুর (শাপুরের নতুন শহর)। মধ্যযুগে মার্ভ, হেরাত, বলখ আর নিশাপুর ছিল খোরাসানের চারটি বড় শহর। মার্ভের মত নিশাপুরও সিল্ক রোডে অবস্থিত ছিল এবং ১২৮১ সালেই মোঙ্গলদের আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। 

*** ওস্তাদ মুবাফফাক -  নিশাপুরের প্রসিদ্ধ শিক্ষক। তাঁর কাছে যে শিক্ষালাভ করবে সে উচ্চপদে আরোহণ করতে পারবে বলে লোকে বিশ^াস করত। ওমর খৈয়াম, নিজাম-উল-মুলক আর গুপ্তঘাতকদলের প্রতিষ্ঠাতা হাসান সাব্বাহ তার ছাত্র ছিলেন এবং সে সময় তারা পরষ্পরকে সাহায্য করার অঙ্গীকার করেছিলেন বলে কথিত আছে।

**** মূল উপন্যাসে রুবাইটির কেবল প্রথম লাইন দেয়া আছে, পাঠকদের সুবিধার্থে পুরো রুবাইটির বাংলা উচ্চারণ এবং কবির চান্দ কৃত এর অনুবাদ তুলে ধরা হলো।

[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা]
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank