ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ ম হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-১৭]
বিটিভিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত আবার প্রাণ ফিরে পেলো। কিন্তু সমস্যা হলো আরেক জায়গায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভালো কোনো অনুষ্ঠান হলে বা রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে কোনো নাটক প্রযোজনা করলেই দু'ডজন চিঠি আসতো বিটিভিতে সংশ্লিষ্ট প্রযোজককে উদ্দেশ্য করে। পোস্ট কার্ডে লেখা সেই চিঠির ভাষা ছিলো এক। হাতের লেখাও প্রায় কাছাকাছি। বুঝতে অসুবিধা হতো না যে একজন ব্যক্তি নিজে এবং তার অনুসারিদের নিয়ে এই চিঠিগুলো লেখেন। চিঠির ভাষা মোটামুটি এরকম “হে জানোয়ার রবীন্দ্রনাথের জারজ সন্তান, তোদের একটুও লজ্জা করেনা একটা স্বাধীন মুসলিম দেশে বসে হিন্দুয়ানী গান আর তাদের দেবদেবীর কথা প্রচার করতে?” এরপর থাকতো নানা ধরনের গালিগালাজ। চিঠির শেষভাগে থাকতো সাবধানবাণী। আমরা এটা নিয়ে বেশ মজা করতাম।
সে সময়ে আমাদের নামে আসা সব চিঠি এসে জমা হতো জিএম সাহেবের পিএ’র রূমে। সেখান থেকে সবাইকে চিঠিগুলো বিলি করা হতো। ঐ পোস্টকার্ডগুলো পেয়েছিলাম প্রায় দশ বছর ধরে। তারপর হঠাৎ করে তা বন্ধ হয়ে যায়। মনে হয় চিঠি লিখতে লিখতে একসময় ভদ্রলোক ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন অথবা অভিমান করে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন।
আমার বিটিভিতে যোগদান করার পর আমার এক দূর সম্পর্কের নানা মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। একবার দেখা হলে তিনি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আন্তরিকতার সাথে বলেন টিভির চাকুরী ছেড়ে দিতে। এইসব কাজে নাকি ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। দুঃখের কথা ঐ নানার এক পুত্র জাতীয় যাদুঘরে চাকুরী পেয়েছিলেন। তিনি মাঝে মাঝে রামপুরা টিভি ভবনে জাতীয় যাদুঘরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেবার জন্য আসতেন। দেখা হলেই আমার কাছে টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য তার আগ্রহের কথা জানাতেন।
যেকোনো ভালো কাজের পর তার সমালোচনা করার জন্য কিছু মানুষ সব সময় প্রস্তুত হয়েই থাকে। আমার ক্ষেত্রেও সেটা অনেকবার ঘটেছে। একবার মনে আছে মহররম দিবসের একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। ড. রাজীব হুমায়ূন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে কিভাবে মহররম স্থান পেয়েছে তার উপর ভিত্তি করে। অন্য সময় হলে সাধারণত একটা মিলাদ পরানো হয়, কিছু হুজুর তাতে অংশগ্রহন করেন। কিছু সম্মানী পান। আর এবার মহররমের উপর রচিত কবিতা ও গদ্য পাঠের আয়োজনে অনেকে অখুশি হন তবে অনুষ্ঠানটি খুব প্রশংসিত হয়।
কিছুদিন পরের কথা। হঠাৎ এক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আমার নামে চিঠি আসে। কি আর করা। মহররমের অনুষ্ঠানে অমুসলিম দুজনের অংশগ্রহণ নিয়ে আপত্তি। আমাকে দেখা করার জন্য বলা হয়। একজন পরিচালক ও আরেকজন সরকারি পরিচালক আমার সাথে কথা বলেন। তারা আমার অনুষ্ঠানের ধারনকৃত অংশ দেখেছেন। এ প্রসঙ্গ নিয়ে তারা তেমন কোনো কথা বলেন না। শুধু বলেন আপনাদের ওখানে অনেক বাজে মানসিকতার লোক আছে। ভদ্রলোকদের সাথে গল্প করে চা খেয়ে চলে আসি।
এভাবে নানা বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা সময়ে। এখন সম্ভবত পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
১৯৯৯ সালের জুন মাস থেকে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমি বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটি’র (বাউবি) মিডিয়া বিভাগের পরিচালক পদে ছিলাম। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে লিয়েনে পাঠানো হয়েছিলো। তখন উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। অসাধারন একজন মানুষ, একইসাথে পন্ডিত ও ভদ্রলোক। তার ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। আরেকটি আকর্ষণ ছিলো সদ্য প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া সেন্টার, যেখান থেকে অনেক ভালো ভালো শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যাবে। রেডিও এবং টেলিভিশন উভয় মাধ্যমের জন্যই এখান থেকে অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হতো। বাউবি থেকে সরাসরি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার ব্যবস্থা ছিলো, যা কাজে লাগানো হয়নি।
বাউবিতে যোগদান করার পর প্রথমেই দেখলাম মিডিয়া সেন্টারে সদ্য কেনা অধিকাংশ ক্যামেরা এবং এডিটিং প্যানেল অকার্যকর। সেগুলো ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নেই। সে সময়ে সদ্য একুশে টেলিভিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নানা ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। বন্ধু ফুয়াদ চৌধুরী ইটিভিতে যোগদান করেছে। ফুয়াদের মাধ্যমে সায়মন ড্রিংক, ফরহাদ মাহমুদ এবং শ্রদ্ধেয় এ এস মাহমুদ এর সাথে যোগাযোগ হলো। সবাই একসাথে একদিন তাদের সম্প্রচার প্রধানসহ বাউবিতে আসলেন। সায়মন ড্রিং তো মিডিয়া সেন্টার দেখে দারুন আনন্দিত। তিনি বাউবির সাথে যৌথভাবে কিছু কাজের পরিকল্পনার কথা বললেন। যেমন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, বাউবির শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ইটিভিতে সম্প্রচার করা ইত্যাদি। আমি সে সময় বাউবির অকার্যকর ক্যামেরা ও এডিটিং প্যানেলের কথা বললাম। সায়মন নিজ দায়িত্বে তাদের প্রকৌশলীদের দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে সেগুলো সারানোর ব্যবস্থা করলেন।
একুশে টিভি ও বাউবি’র যৌথ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হলো বাউবির মিডিয়া সেন্টারে। সেখানে সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সুপন রায়, জ ই মামুন, মুন্নী সাহা, শাহনাজ মুন্নী, মোস্তফা ফিরোজ, আমিনুর রশীদ, ভানু রন্জন চক্রবর্তী, রুমি নোমান, ইব্রাহিম আজাদ, তুষার আবদুল্লাহ, শাকিল আহমেদ, হাসনাইন খোরশেদ, সোহেল মাহমুদ, নিয়াজ মোর্শেদ, মোর্শেদুর রহমান, সেলিনা আখতার জাহান সহ ২৩ জন টেলিভিশন রিপোর্টিং এর উপর তিনমাসের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশগ্রহন করেন। বিবিসির দুজন প্রশিক্ষক এসেছিলেন লন্ডন থেকে। সায়মন ড্রিং এবং আামি যৌথভাবে কোর্সটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলাম। আবেদ খান, মিশুক মুনীর, শান্তিময় চাকমা, কেরামত আলী এই কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন।
একুশে টেলিভিশন অত্যন্ত আশা জাগিয়ে ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিনে সম্প্রচার জগতে প্রবেশ করলো। একইসাথে টেরিস্টরিয়াল ও স্যাটেলাইট সম্প্রচার। বাউবি নানা বাঁধা ও ষড়যন্ত্রের কারণে আর এই সম্প্রচারের সাথে যুক্ত হতে পারলো না।
বাউবিতে একদিন আমার কাছে এক গোয়েন্দা সংস্থার দুজন কর্মকর্তা আসলেন। অভিযোগ আমি নাকি বাউবি’র এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা নিজের একাউন্টে স্থানান্তর করেছি। আমারতো চোখে সর্ষে ফুল দেখার অবস্থা। জিজ্ঞাসা করলাম অভিযোগ সম্পর্কে আপনারা কতটুকু নিশ্চিত হয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন? আমি ফাইল থেকে একটা চিঠি বের করে তাদেরকে দিলাম। প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিলো সেটা হলো, মিডিয়া সেন্টারে যেসব শিল্পী বা শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগণ অনুষ্ঠান করতে আসেন তাদের শিল্পী সম্মানী প্রদানের জন্য একদিন উপাচার্য মহোদয় আমার নামে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি চেক পাঠান। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চেকটি গ্রহন করতে অসম্মতি জানিয়ে উপাচার্য মহোদয়কে একটি চিঠি সহ চেকটি ফেরত পাঠাই। আমি লিখেছিলাম ব্যক্তিগতভাবে নয়, হিসাব শাখার মাধ্যমে শিল্পী সম্মানী প্রদানের ব্যবস্থা করার জন্য। এখনে যিনি বা যারা অভিযোগ করেছেন তারা চেক ইস্যু হওয়া পর্যন্ত জানেন, পরেরটুকু জানতেন না। কর্মকর্তাদ্বয় দুঃখপ্রকাশ করে বিদায় নেন, যাবার আগে আমাকে ওইসব লোক থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে যান।
এরপর আমি সিদ্ধান্ত নেই বাউবিতে আর নয়, অতএব ঘরের ছেলে ঘরে (বিটিভি) ফিরে যাই।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই