ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ ম হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-১৬]
সঙ্গীতের প্রতি আমার আকর্ষণ সেই ছোটোবেলা থেকে। বাসায় কলের গান (গ্রামোফোন) ছিলো না, তাই রেডিওর গান শুনে শুনে বড় হয়েছি। আকাশবাণী কলকাতা, রেডিও সিলন এবং ঢাকা বেতার এইসব কেন্দ্রের গান শোনা সম্ভব ছিলো যখন আব্বা বাসায় থাকতেন না সেই সময়। একটি গ্রুনডিক রেডিও সেট ছিলো, যা আব্বার ঘরে থাকতো, পরে আর কোনো সেট কেনা হয়েছে বলে মনে পরে না। আব্বা ওই রেডিওতে মূলত খবর আর সাপ্তাহিক নাটক শুনতেন। সে সময় আমরা সবাই রেডিওর চারপাশে বসার সুযোগ পেতাম।
ছোটোবেলা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর কলকাতার আধুনিক গানগুলি মনে দাগ কাটতো। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কখনো গান শেখা হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণসঙ্গীত এবং রণসঙ্গীত আমার কাছে জীবনের অপর নাম মনে হতো। আমার অনেক বন্ধু রণক্ষেত্রে নিজের কাছে একটি ছোটো ট্রানজিস্টার রাখতো, গান শুনে নিজেকে চাঙা রাখার জন্য। সাহস সঞ্চয় করে নতুন উদ্যমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরার জন্য।
যুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যখন ক্লাস শুরু হলো তখন আমি কিছু বন্ধু পেলাম যারা অনেক ভালো গান করতো। ভারত থেকেও অনেক শিল্পী আসতেন। কলাভবন প্রাঙ্গণে বা টিএসসিতে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকতো। এভাবেই গানের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে। মনে আছে ১৯৭২ সালে 'কলকাতা ইয়োথ কয়ারে'র অনুষ্ঠানের কথা, যেখানে রূমা গুহ ঠাকুরতা ও তার ছেলে অমিত কুমারসহ তার দলের অসাধারন একটি পারফরমেন্সের কথা। এরপর পূর্ণদাস বাউলের বেশ ক'টি অনুষ্ঠানের কথাও মনে পরছে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্রসহ তাদের সমসাময়িক প্রায় সকল শিল্পী ভারত থেকে মুক্ত বাংলাদেশে চলে আসতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সঙ্গীত পরিবেশন করার জন্য। একবার এসেছিলেন নজরুল পুত্র কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। কলা ভবনের সামনে মঞ্চ তৈরী করা হয়েছিলো। সেকি অসাধারন কবিতার নাটকীয় উপস্থাপনা, মনে পরলে আজও গা শিউরে ওঠে। কবিতার সাথে গিটার আর তবলার মেলবন্ধন, না দেখলে ঠিক উপলব্ধি করা যাবে না।
আমাদের ক্লাসেই কয়েকজন শিল্পী ছিলো। জহীর, সেন্টু, শাহীন, মনি, কানিজ, কামরুল, মালেকা, মতিউর, মনসুর, আশরাফ সবাই ছিলো গুণী শিল্পী বা সংগঠক। জহীর আহমেদ ও শাহীন মাহমুদ ছিলো জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী। শাহীন যুদ্ধক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিবেশন করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো। জহীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাথে যুক্ত ছিলো এবং একই সাথে সে উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গীত বিভাগের দায়িত্বে ছিলো। সে সময় উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক ছিলো সেন্টু রায় আর সভাপতি ছিলেন সত্যেন সেন। সেন্টু আমার সহপাঠি। ক্লাসে ছিলো অনিয়মিত। অনার্স পরীক্ষার আগে জহীর ও সেন্টু সূর্যসেন হলে আমার ৪৩৩ নাম্বার রুমে থেকে পড়াশুনা করতো। আমার সব নোট তৈরী করা ছিলো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেন্টু টেবিলে তবলা বাজাতো আর জহীর গান ধরতো। এইভাবে সারারাত চলতো। একবার হলো কি, পরীক্ষার আগের রাতে আমি ও জহীর পড়াশুনা শেষ করে শুয়ে পরেছি। সেন্টুর দেখা নেই। ভোর রাতে সে এসে হাজির। সারারাত সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে (রেসকোর্স) যাত্রা দেখেছে, সকালে যে পরীক্ষা সেটা নাকি তখন তার মনে ছিলো না। এসেই হাত-মুখ ধুঁয়ে আমার নোটগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে পরীক্ষা দিতে চলে গেলো। সেন্টু যে অনার্স পরীক্ষায় পাস করে যাবে, তা ভাবতেও পারিনি তখন।
এমএ পরীক্ষার পর দিল্লি চলে যাই। এনএসডি’র সহপাঠিদের মধ্যে প্রায় সকলেই গান জানতো। প্রথম বর্ষে আমরা যারা ভর্তি হয়েছি সকলেই সিনিয়রদের সাথে একই হোস্টেলে থাকি। প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ আবাসিক।
সবে দুদিন হলো এসেছি আমি, তারিক আনাম ও সালেক খান। আমাদের কিছু কেনাকাটা করা দরকার। আন্নু কাপুর সময় অসময়ে গান করে সবাইকে মাতিয়ে রাখে। তাকে বললাম। সে সাথে সাথে রাজি। দিল্লি তার পরিচিত শহর। কেনাকাটা করে ফিরলাম। রাতে ক্যাফেটেরিয়ায় খাবার খেয়ে সিনিয়রদের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। আন্নু কাপুর, যুবরাজ শর্মা, ভিকে শর্মা- আমাদের অন্য সকল সহপাঠিদের এনে জড়ো করেছে। এরমধ্যে আমাদের সিনিয়র মহাবীর সিং, আনং দেশাই, সতীশ কৌশিক, অনুপম খের, জিনাত খান- এদের নেতৃত্বে শুরু হয়ে গেলো র্যাগিং। প্রথম শর্ত গান গাইতে হবে। যে গান জানেনা তাকে নাচ দেখাতে হবে। তাও না পারলে করতে হবে বুকডন বা শীর্ষাসন। আন্নুকে দিয়ে শুরু। সে গান গাইতে গাইতে নানা ধরনের কৌতুক দেখাতে লাগলো। সবাই মুগ্ধ। ভিকে এসেই প্রথমে বুকডন দেয়া শুরু করলো। যুবরাজ গানের সাথে সাথে পাঞ্জাবি ফোকড্যান্স দেখালো। এরপর নুতন, অমরদ্বীপ, গোপী দেশাই, নন্দিতা, ওম শিবপুরি সবাই যার যার মতো পারফরম্যান্স দেখালো। মহাবীর সিং, অনুপম খের আর সতীশ কৌশিকের ধারাবর্ণনার কথা এখনো মনে আছে। ডলি আলুওয়ালিয়া, অমীতাভ শ্রিবাস্তব, অশোক সাগর ভগত- এরা কোনো রকমে ম্যানেজ করলো। সালেক খান একটা ইংরেজী গান পরিবেশন করলো সাথে জীবনানন্দ দাশের কবিতা। তার ফিউশন দেখে সকলে মুগ্ধ। আমার আর তারিক আনামের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো। না জানি গান, না নাচ। আমি কোনরকমে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গাইলাম। এরপর তারিক আনামের পালা। সে এসেই এমন নাচা শুরু করলো যে তাকে আর থামানো যায়না। কারো মুখে তখন আর কথা নেই। শুরু হলো তালে বেতালে সম্মিলিত নাচ।
এনএসডিতে নাচ আর গানের ক্লাস ছিলো বাধ্যতামূলক। কিভাবে যে পাশ করেছিলাম জানিনা। তবে আমি ডিজাইনে খুব ভালো ছিলাম আর তারিক ও সালেক অভিনয়ে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করার পর নাটকের পাশাপাশি আমি গানের অনুষ্ঠান নির্মাণে মনোযোগী ছিলাম। আমার প্রথম টিভি নাটকের কথা বলেছি। রাহাত খানের লেখা ‘শহর’। এই নাটকে আমি বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলাম। বিটিভিতে আমরা তখন কোনো স্টক মিউজিক ব্যবহার করতাম না। সব রেকর্ড করতাম বিটিভি অডিটরিয়ামে।
সে সময় আমাদের সব প্রযোজকদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহের প্রথম দিন অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ আতিকুল হক চৌধুরীর কক্ষে সাপ্তাহিক মিটিং হতো। বিগত এক সপ্তাহে প্রচারিত সকল নাটক ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের উপর মুক্ত আলোচনা। ‘শহর’ প্রচারিত হবার পরও সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। অনেকে প্রশংসা করেন। কিছু কিছু দৃশ্যের সমালোচনাও করেন। কেউ কেউ বলেন বেশী সিনেম্যাটিক হয়ে গেছে। আতিকুল হক চৌধুরী সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন- হারূন, আপনি কেনো এই নাটকে রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহার করেছেন? এই আকস্মিক প্রশ্নে সকলেই চুপ। আমিও বিব্রত। তিনি বললেন- আপনি কি জানেন না এখন টেলিভিশনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের ব্যবহার অনেক সীমিত? নাটকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা যাবে না।
মিটিং থেকে বের হয়ে এসেছি। মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ। এমন সময় প্রযোজক ফরিদুর রহমান বললো, আমার কাছে সেই বিবৃতির কপি আছে যেখানে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানের সংহতির পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। সেই সময় ঢাকা টেলিভিশনের একজন সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন যিনি আজ রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহারের বিরোধিতা করলেন।
কি আর করা। সরাসরি দেখা করলাম মহাপরিচালক এম এ সাঈদ এর সাথে। তার কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহারের সীমাবদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলাম। তিনি সাথে সাথে ইন্টারকমে আতিকুল হক চৌধুরীকে এই বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। কোনো সদুত্তর পেলেন না। বুঝলাম তিনি প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এক ঘন্টার মধ্যে মহাপরিচালক অফিস আদেশ জারি করলেন- রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যবহারে বিটিভিতে কোনো বাধা নিষেধ নেই।
অবশেষে বিটিভিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত আবার প্রাণ ফিরে পেলো।
চলবে...
আরও পড়ুন
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই