দিলওয়ার: যে কবি গণমানুষের
দিলওয়ার: যে কবি গণমানুষের
কবি দিলওয়ার |
সক্রেটিস, বারবার আমি শুনতে চাই
তোমার কালজয়ী মানবীয় উচ্চারণ-
আমি শুধু একজন এথেনসবাসী কিংবা গ্রীক নই
আমি হচ্ছি বিশ্বনাগরিক।
‘পৃথিবীর সক্রেটিসের জন্যে’ কবিতায় কবি নাগরিকতার সংজ্ঞা নিরূপণ করে গেছেন এভাবে। এই সংজ্ঞায়নের কালে সক্রেটিস আছেন বিমূর্ত অথচ সবচেয়ে উজ্জ্বল এক এক অংশ হয়ে আছে স্বয়ং কবি, কবি দিলওয়ার! দেশ কাল আর ভৌগলিক সীমা ভেদ করে একজন কবি নিজেকে এভাবেই প্রকাশ করতে জানেন। তাই কালে বসে মহাকালের পঙক্তি লেখাই শুধু কবিদের কাজ হয়ে থাকে না এর বাইরে কবিতার মত কবির নিজস্বতা প্রকাশের একটা পরিষ্কার ইশতেহার প্রকাশের দায় এসে যায়। কবি এখানে নিজেকে প্রকাশ করে গেছেন অবলীলায়, নিঃসন্দেহে।
কবি দিলওয়ার। পঞ্চাশ দশকের উজ্জ্বল এক কাব্যপ্রতিভা। শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরীর মত কাব্যপ্রতিভার সময়কাল থেকেই তার কাব্যের স্ফুরণ। তিনি নাগরিক কবি ছিলেন না কিন্তু ছিলেন গণমানুষের কবি। তার কাব্য সাধারণ মানুষের আবেগকে ছুঁয়ে ছিল আগাগোড়াই। গাঁয়ের মানুষের শরীরের গন্ধের সাথে তার কবিতা সমানতালে হেঁটে যেত। ফলে খুব সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন কাব্য-ভালোবাসার অনন্য এক নাম।
কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার সব পরিচয় ছাপিয়ে ছিলেন আপাদমস্তক এক কবি। তার কবিতার রাজ্য অন্য সব কবিদের মত নিজস্ব চিন্তা চেতনা দিয়েই সমৃদ্ধ ছিল, সেই স্বাভাবিক। ব্যক্তি জীবন এবং কাব্য জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল আজন্মই। ছিলো নাড়ির টান, তাই এক সময়ের পেশাগত জীবনের স্থানিক অবস্থা পেরিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন শেকড়ের কাছে, নিজের বসতবাড়িতে এবং সেখানেই ছেড়েছেন শেষ নিঃশ্বাস। জীবদ্দশায় যেমন কাব্য আর কবিতার সাথে ছিল নিত্য বাস ঠিক তেমনিভাবে বাড়ির চৌহদ্দিতেও ছিল সে ছোঁয়া। খান মঞ্জিলের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে মিশে ছিল কবি আর তার কবিতার স্বাক্ষর। কবিতার কবি সাজিয়েছেন এভাবে নিজের ব্যক্তিগত জীবনও। তাই কবির জন্মভূমি কেমন হওয়া উচিত ছিলো, সে সম্পর্কে কবি বলছেন-“কবির রাজ্যে রাজা-বাদশার কিংবা রাজ্যসাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের বুকফাটা হাহাকার অথবা উল্লাসের অট্টহাস্য নেই। এই রাজ্যে রয়েছে এক অখণ্ড- জীবনবোধ, যার প্রেম-প্রীতি, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না দক্ষিণমেরু থেকে উত্তরমেরু অবধি বিস্মৃত! কালের শুভেচ্ছায় কবি ও কবিতার জগত্ চিরসবুজ, অবিনাশী যৌবনের প্রতীক!” (এককথা, ‘দিলওয়ার’, ১ জানুয়ারি ২০০৫)
সিলেট-ঢাকা-সিলেট। তার সময়কালে মফস্বলে থেকে নামডাক করা রীতিমত কঠিনই এক কাজ ছিল। কিন্তু তিনি তার কবিতার মাধ্যমে উচ্চারিত হয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে। সিলেটের মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে সিলেটে বসে ছড়িয়েছেন তার কাব্যদ্যুতি। একটা মফস্বল শহরে বসে লিখেন তিনি “পৃথিবী স্বদেশ যার আমি তার সঙ্গী চিরদিন” অমর এমন কোন লাইন। তার বাড়ির পাশ দিয়ে কলকল রবে বয়ে যাওয়া সুরমা আর ইতিহাসের সাক্ষী কিনব্রিজ। এই কিনব্রিজ কবিকে আন্দোলিত করেছে। ফলে তিনি ‘কীনব্রিজে সূর্যোদয়’ কবিতায় লিখেন- “নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার/ কানপেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা/ গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা/ সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।”
দীর্ঘ ষাট বছরের সাহিত্যজীবনে কবি দিলওয়ার শুধুমাত্র তার কাব্যপ্রতিভা দিয়েই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেননি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর সিলেট শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। ছিলেন সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বাস্তবায়ন কমিটির মুখ্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকের মতিয়া চৌধুরীকে নিবেদিত একটি কবিতায় তিনি তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। এবং এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই নামেই অদ্য সমধিক সুবিদিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখেছিলেন- ‘আয়রে চাষী মজুর কুলি মেথর কুমার কামার/ বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছে বাংলা তোমার-আমার।’ দেশ আর স্বাধীনতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন বলে নাগরিকদের উদ্দেশে ‘যতদিন বেঁচে আছো’ কবিতায় লিখেন- “যতদিন বেঁচে আছো ততোদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো/ আকাশ মাটির কণ্ঠে শুনি যেন তুমি বেঁচে আছো”।
আগাগোড়া দেশপ্রেমিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের কবি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা তুমুল সাড়া জাগানো গণজাগরণ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। বয়সের চাপ ও ছাপ তাকে ঘরের চার সীমানার মধ্যে আটকে রেখেছিলো কিন্তু সময়ে সময়ে তিনি তার লেখনিতে উচ্চারণ করেছেন রাজাকারদের বিচারের দাবিতে তার অভিমত। শাহবাগ চত্বরকে তিনি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনাকে সমর্থন জানিয়েছেন অকপটে। এ সম্পর্কিত দুইটি লেখার একটিতে তিনি শাহবাগ চত্বরকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ‘লাল সংকেত’ এবং অন্য একটি লেখায় তিনি ‘সবুজ সংকেত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘শাহবাগ চত্বর: দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের লাল সংকেত’ লেখায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- “মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়েছিলো। সেখান থেকে একচুলও নড়ার অবকাশ নেই। এই সত্যকে যে বা যারা ছাই চাপা দিতে চাইবে, তাদেরকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে” (দৈনিক যুগভেরী: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)।
কবিতার কবি দিলওয়ারের পুরো নাম দিলওয়ার খান। আটপৌরে জীবনের পারিবারিক তকমা তিনি ছেঁটে ফেলে দিয়ে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন শুধুমাত্র দিলওয়ার নামেই। কারণ তিনি মনে করতেন যে নামে তাকে পরিবার আর স্বজন জানে সেটাই তার প্রকৃত পরিচয় আর পরিচিতি। জন্মেছিলেন ১৯৩৭ সালের ১ জানুয়ারি। সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা গ্রামে। পিতা মৌলভী মোহাম্মদ হাসান খান এবং মাতা রহিমুন্নেসা। ছিলেন চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সপ্তম।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও মাত্র দু’মাস পর তিনি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেন। নিজেকে জড়িয়ে নেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৭ সালে দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি সিলেটে ফিরে আসেন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সিলেটের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের নিয়ে গঠন করেন ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’ এবং উনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সমস্বর’-কে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে কাজে লাগান। ১৯৭৩-৭৪ সালে অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকন্ঠের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকাস্থ রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক উদয়ন পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক হিসেবে দুই মাসের মতো কাজ করেন। ১৯৬০ সালে এই কবি’র একটি গান দিয়ে সিলেট রেডিও স্টেশনের উদ্বোধন করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড কবি’র চারটি গান দিয়ে একটি ডিস্ক বাজারে ছাড়ে। গানগুলো হলো- মুর্শিদ আমি খুঁজবো না গো; তুমি রহমতের নদীয়া; মন আমার কেমন করে; নদীর ঘাটে জল আনিতে গিয়া।
গণমানুষের কবি দিলওয়ারের মুল লেখালেখির ক্ষেত্র ছিল কবিতা। তার লিখিত সবগুলো লেখা গ্রন্থভুক্ত হয়নি। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে- জিজ্ঞাসা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৫৩), ঐক্যতান (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৪), পুবাল হাওয়া (গানের বই, ১৯৬৫), উদ্ভিন্ন উল্লাস (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৬৯), বাংলা তোমার আমার (গানের বই, ১৯৭২), ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৫), স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৭৭), রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮১), বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (প্রবন্ধগ্রন্থ, ১৯৮৫), নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৮৭), দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই, ১৯৮৯), দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ১৯৯৩), ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই, ১৯৯৪), দিলওয়ারের রচনাসমগ্র ১ম খণ্ড (১৯৯৯), দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র ২য় খণ্ড (২০০০), ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ, ২০০১) ৷
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি ১৯৮০ সালে কবি দিলওয়ারকে সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করে এবং পরে ১৯৮১ সালে ফেলোশিপ প্রদান করে। এছাড়াও লাভ করেন ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ কর্তৃক ১৯৮৬ সালের আবুল মনসুর সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯১ সালে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক ও সম্মাননা, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি পদক ও পুরস্কার। ২০০১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ সংবর্ধনা প্রদান করে।
সিলেটে বাস করা কবি দিলওয়ারের অনেকেই প্রশ্ন করতো কেন তিনি মফস্বলে পড়ে আছেন? অকালপ্রয়াত কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার একবার কবিকে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি এভাবে মফস্বলে পড়ে আছেন কেন? মফস্বলে থাকলে তো মূল্যায়ন পাবেন না। উত্তরে কবি বলেছিলেন- ‘যদি লিখতে পারি কবিতাই আমাকে স্বীকৃতি দেবে। গ্রামে বসে, মফস্বলে বসে আমি গণমানসিকতার কবিতা উপস্থাপন করতে পারব। আমার স্বীকৃতি হবে গণমানুষের স্বীকৃতি’। হ্যাঁ, কবি গণমানুষেরই স্বীকৃতি আর ভালোবাসা পেয়েছেন।
১০ অক্টোবর ২০১৩ দিনটি বাংলা সাহিত্যের জন্যে একটা বিয়োগান্ত দিন। এই দিনে কবি দিলওয়ারের কলম থেমে গেছে সারা জীবনের জন্যে। তার শরীর নিথর আর চোখ বুজার সাথে সাথেই বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে খসে গেছে একটা নক্ষত্র। জীবন প্রদীপ নিভে যাবার ক্ষণে যে অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো সেই একই অধ্যায় হয়তো মূল্যায়ন কালেরও, কে জানে! তার মৃত্যুর অব্যবহিত পর মনে হয়েছিল এই সময়ে সিলেটে কোন কবি আর বেঁচে নেই! এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখ করার মত খুব বেশি কবি আর বেঁচে নেই!
‘‘চিরায়ত পথ ধরে যারা যায় আর যারা আসে
মুদ্রার দুপিঠ তারা, প্রেম নিয়ে মাটিতে আকাশে- দিলওয়ার।’’
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই