শুভ জন্মদিন সব্যসাচী সৈয়দ হক
‘আমি একটুখানি দাঁড়িয়েই এখান থেকে চলে যাবো’
শুভ জন্মদিন সব্যসাচী সৈয়দ হক
‘আমি একটুখানি দাঁড়িয়েই এখান থেকে চলে যাবো’
তোমাদের ভেতর দিয়েই তো সর্বকাল চলে গেছে আমার পথ
এবং সর্বকাল আমি দাঁড়িয়েছি আমি আবার নিয়েছি পথ।
‘এখনো অপেক্ষায় কত কবিতা, কত নাটক, কত গল্প। করোটির ভেতরে শব্দের কি অবিরাম গুঞ্জন। কলমের গর্ভে এখনো তো আমার রক্ত অফুরান। দৃষ্টিভূমিতে এই দেশ ও এই মানুষেরই দীর্ঘ ছায়া লয়ে আমি আমার লেখার টেবিলে।’ কথাগুলো সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। সবকিছু তারই অপেক্ষায়, শুধু তিনি নেই সশরীরে। কিন্তু আছেন সবটাজুড়ে। আজ ২৭ ডিসেম্বর, সব্যসাচীর পৃথিবীতে আসার দিন। শুভ জন্মদিন সৈয়দ শামসুল হক।
১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলে হবে ডাক্তার। বাবার ইচ্ছেমতোই ছেলে এগুচ্ছিল। ১৯৫০ সালে কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুল থেকে অংকে লেটার মার্কনিয়ে ম্যাট্রিক পাস।
কিন্তু পরীক্ষার পরপর সবাই যেখানে পরবর্তী পড়াশোনা নিয়ে ধীরে ধীরে মেতে ওঠে, সেখানে তিনি তার ব্যক্তিগত খাতায় ভরিয়ে ফেললেন কবিতায়, প্রায় শদুয়েক কবিতা লিখে ফেলেন সেই কৈশরেই। তবে প্রথম লেখা আরো আগে, ১১/১২ বছর বয়সে।
এই সময়েই ফজলে লোহানি সম্পাদিত ‘অগত্যা’ নামের একটা ম্যাগাজিনে ‘উদয়াস্ত’ নামে একটা ছোট গল্প প্রকাশিত হয়। হয়তো তিনি বুঝতে পারেন যে সাহিত্য চর্চাটাই তার ভালো লাগার জায়গা। ম্যাট্রিক পাশের পরের বছরই ১৯৫১ সালে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বোম্বে চলে যান তিনি। সেখানে একটা চলচ্চিত্র প্রোডাকশন হাউজে সহকারী হিসেবে চাকরি করেন বছরখানেক।
কিন্তু প্রতিভাবানদের কি আর ছকে বাঁধা একটা কাজে মন বসে? ১৯৫২ সালে আবার ফিরে আসা দেশে। এসে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেন মানবিক শাখায়। সেখান থেকে পাশ করে ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ইংরেজি বিভাগে। এই সময়েই শুরু হয় তার লেখালেখি। প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এর মাঝে তিনি পড়াশোনাটাও ছেড়ে দেন।
এরমাঝে বাবা মারা যান সৈয়দ হকের। সংসারে টানাটানি, কিছুতো করতে হবে। শুরু করেন চিত্রনাট্য লেখার কাজ। ১৯৫৯ সালে ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য দিয়ে শুরু, এরপর কালে কালে লিখে ফেলেন ‘তোমার আমার’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘পুরস্কার’ সহ আরো কয়েকটি সিনেমার চিত্রনাট্য। মজার বিষয় হচ্ছে, এর মাঝে তিনি কিছু কিছু সিনেমার শুধু চিত্রনাট্যই লেখেননি, একইসাথে কাহিনীকার ও সংলাপ রচয়িতাও ছিলেন। ‘বড় ভালো লোক ছিলেন’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে এবং ‘পুরস্কার’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন।
তবে এত ব্যস্ততার মাঝেও তার উপন্যাস লেখা থেমে থাকেনি। ষাটের দশকে 'পূর্বাণী' ঈদ সংখ্যায় তার উপন্যাস প্রকাশিত হতো। এই সময়ে তার রচিত ‘এক মহিলার ছবি’, ‘অনুপম দিন’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ উপন্যাসগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৬৬ সালে তিনি পান বাংলা একাডেমি পুরস্কার। মাত্র ২৯ বছর বয়সেই তিনি এই পুরস্কারটি পান, যা কি না এই পুরস্কার পাওয়া সব সাহিত্যিকের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ।
ধীরে ধীরে লিখে যান ‘খেলারাম খেলে যা’, ‘আয়না বিবির পালা’, ‘কালধর্ম’, ‘দূরত্ব’, ‘না যেয়ো না’, ‘এক মুঠো জন্মভূমি’, ‘নারীরা’, ‘গল্প কারো নয়’, ‘ক্ষুধাবৃত্তান্ত’ ইত্যাদি।
তার উপন্যাস সংখ্যা ৩৮টি। তবে প্রথাগত জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটেননি তিনি। নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করতে চেয়েছেন হয়তো।
সৈয়দ শামসুল হক তার অনেক উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, ‘নীল দংশন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘দ্বিতীয় দিনের কাহিনী’– প্রতিটি উপন্যাসেই মুক্তিযুদ্ধের এক একটি দিক ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছুদিন আগে (২০১১ সাল) তার রচিত উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ‘গেরিলা’ সিনেমা নির্মিত হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে, সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন এবং শক্তিশালী মাধ্যম নাকি কবিতা। এই কবিতার ক্ষেত্রেও সৈয়দ শামসুল হক তার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একদা এক রাজা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে। কালক্রমে প্রকাশিত হয় 'বিরতিহীন উৎসব' (১৯৬৯), 'বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা' (১৯৭০), 'প্রতিধ্বনিগণ' (১৯৭৩), 'অপর পুরুষ' (১৯৭৮), 'পরাণের গহীন ভিতর' (১৯৮০), 'রজ্জুপথে চলেছি' (১৯৮৮), 'বেজান শহরের জন্য কোরাস' (১৯৮৯), 'এক আশ্চর্য সংগমের স্মৃতি' (১৯৮৯), 'অগ্নি ও জলের কবিতা' (১৯৮৯), 'কাননে কাননে তোমারই সন্ধানে' (১৯৯০), 'আমি জন্মগ্রহণ করিনি' (১৯৯০), 'তোরাপের ভাই' (১৯৯০), 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৯০), 'নাভিমূলে ভস্মাধার' (১৯৯০) ইত্যাদি। তার কবিতায় ফুটে উঠে বাকপ্রতিমা নির্মাণ ও বাকপটুতা।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা’র জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। আরেক বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'পরানের গহীন ভিতর' দিয়ে তিনি তাঁর কবিতায় আঞ্চলিক ভাষাকে উপস্থাপন করেছেন।
কবিতায় তার ধারাবাহিকভাবে যে অবদান, তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সৈয়দ হককে অনুসরণ করে আমাদের কালের কবিরা বা তার পরবর্তী কালের কবিরা আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা লেখার চেষ্টা করেছেন।
তার সর্বশেষ কবিতার নাম, ‘আহা, আজ কী অপার আনন্দ’, যা রচিত হিয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে।
খুব বেশি গান লেখেননি, তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যতগুলো লিখেছেন, তার মাঝে অনেকগুলোই শ্রুতিমধুর হয়েছে এবং কালের বিচারে টিকেও গিয়েছে। ‘বড় ভালো লোক ছিলো’ সিনেমায় অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুড়াইলে ঠুস’ গানটা এতটাই জনপ্রিয় যে বাংলাদেশের কোনো যুগের কোনো মানুষেরই গানটি না শোনার কথা নয়।
নাট্যকার হিসেবেও শামসুল হক ছিলেন অনবদ্য। দেশের মঞ্চনাটক সমৃদ্ধ হয়েছে তার হাত ধরে। নাটক লেখা শুরু করেছিলেন লন্ডনের বিবিসি বাংলায়, সেখানে প্রায় সাত বছর কাজ করেন। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘নূরলদিনের সারাজীবন’ নাটক দুটি বাংলা নাটকে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকে ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের অজ্ঞতা এবং কুসংস্কারকে তুলে ধরেছেন।
এতগুলো অঙ্গনে পদচারণা থাকলেও শামসুল হক তার স্মরণীয় কাজ হিসেবে উল্লেখ করেন বিবিসি বাংলার খবর পাঠকের ভূমিকাটাকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটা পাঠ করেছিলেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেছিলেন প্রথিতযশা লেখিকা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সৈয়দা আনোয়ারা হককে। এই দম্পত্তির এক ছেলে এবং এক মেয়ে।
২০১৬ সালের ১৫ এপ্রিল ফুসফুসের সমস্যার কারণে তাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপি নেওয়ার পর ২ সেপ্টেম্বর তাকে দেশে নিয়ে আসা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে কবি মারা যান।
৮১ বছরের জীবনে লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন ৬২ বছর। সেটির পুরস্কারও অবশ্য পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক পান ১৯৮৪ সালে এবং স্বাধীনতা পুরস্কার পান ২০০০ সালে।
জিজ্ঞাসা হলো যে লেখকের পদচারণা শিল্প সাহিত্যের এতগুলো অঙ্গনে, তাকে কি মৃত্যুর পর পাঠকসমাজ ভুলে যেতে পারে? না, কোনোভাবেই নয়। কবি ও কবিসৃষ্টি বেঁচে রইবে আরও শতসহস্রবছর।
আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব;
শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;
না, আমি থেকে যেতে আসিনি;
এ আমার গন্তব্য নয়;
আমি এই একটুখানি দাঁড়িয়েই
এখান থেকে
চলে যাব।
আমি চলে যাব...
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই