ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ ম হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-৮]
আমার নাম নিয়ে বিভ্রাট প্রায়ই ঘটতো। আমার পিতার নাম যেহেতু আলী আহমেদ খান চৌধুরী, পিতামহের নাম আমীর আলী খান চৌধুরী, সেহেতু আমার নাম খান চৌধুরী মোহাম্মদ হারূন আল রশীদ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। এবং স্কুলে ভর্তি হবার সময় সেরকমই ছিলো। কিন্তু স্কুল জীবনে আমার কাছে এই বংশপদবি ব্যবহার করাটা ভালো লাগতো না। মনে হতো বংশপদবী অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করার একটা প্রচেষ্টা মাত্র। সুতরাং এসএসসির রেজিস্ট্রেশন ফর্ম ফিলাপ করার সময় আমি নিজে নিজেই আমার বংশপদবি সংক্ষিপ্ত করে নাম লিখলাম কে এম হারূন আল রশীদ। যেহেতু তখন ফর্ম শুধুমাত্র ইংরেজীতেই ফিলাপ করতে হতো সেহেতু এই নামটিই সার্টিফিকেটে থেকে যায়। আমি চেয়েছিলাম ‘কে এম’ এর বাংলা করতে কিন্তু তা সে সময়ে সম্ভব না হলেও পরবর্তিতে হয়েছিলো।
১৯৬৮ সালে এসএসসি সম্পন্ন করার পর যখন পিরোজপুর কলেজে ভর্তি হই, তখন সেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পরি। আমার ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে ছিলো আমার সহপাঠি মুরশিদ কুলী খান এবং এক বছরের সিনিয়র অমর সাহা ও গৌরাঙ্গ লাল আইচ। এই গৌরাঙ্গ লাল আইচ-ই তার নাম সংক্ষিপ্ত করে জুয়েল আইচ হয়, পরবর্তি সময়ে বিশ্বনন্দিত যাদুকর।
পিরোজপুরে থাকতেই অমর সাহা নাটক লিখতো। আমি, জুয়েল আইচ সহ অনেকেই সে নাটকে অভিনয় করতাম। জুয়েল আইচ সাধারণত মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতো। মহিলা শিল্পী হিসেবে অমর সাহাদের সহপাঠি ক্ষমা দাশগুপ্তও অভিনয় করতো। সে ভালো গানও করতো। অসাধারন বাঁশি বাজাতো জুয়েল আইচ। আরেকজন খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করতো, নাম জিয়াউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তিতে বীর মুক্তিযাদ্ধা মেজর জিয়া)। একবার কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় জিয়া প্রথম হয় এবং আমি দ্বিতীয়। পিরোজপুর কলেজের অধ্যক্ষ দরবেশ আলী খান এর হাত থেকে আমরা পুরস্কার গ্রহন করি। দরবেশ আলী খান স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হন, পরবর্তিতে তার মেয়ে বিপাশার সাথে বিয়ে হয় জুয়েল আইচের।
১৯৬৯ সালে অমর সাহা এইচএসসি সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান আর্মিতে যোগদান করে। জুয়েল আইচ পড়াশুনার পাশাপাশি একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতে থাকে। আমি এবং মুরশিদ কুলী খান ১৯৭০ সালে এইচএসসি শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।
১৯৭০ সালে সাধারন নির্বাচনের আগে পিরোজপুর আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সে সময়ে পিরোজপুর মহাকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এ্যাডভোকেট এনায়েত খান। তখন এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের উপর একটি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আমি এবং অমর সাহা এই রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাই। যা আমাদেরকে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী মঞ্চ থেকে। আমার সৌভাগ্য হয় বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে প্রথম দেখার এবং একই মঞ্চে বসে তাঁর বক্তৃতা শোনার।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে আমার প্রিয় ছাত্রনেতা কাজী আকরাম হুসেন এবং সিরাজুল ইসলাম এর পরামর্শে আমার নামটা স্থায়ীভাবে খ ম হারূন হয়ে যায়। সে সময়ে যে কজন ছাত্র বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পোস্টার লেখার জন্য মনোনীত হয় তার মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। সুতরাং নাটকের রিহার্সেল থেকে ফিরে কিছুটা পড়াশুনা করে তারপর রাত জেগে পোস্টার লেখা ছিলো অন্যতম কাজ। একদিন খবর আসে টিটো ভাই আমাকে এখনই দেখা করতে বলেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে তিনি ভিপি পদে ইলেকশন করছেন। মুক্তিযাদ্ধা টিটো ভাই তখন ইংরেজি বিতর্কের জন্য খুব জনপ্রিয়, সেই সাথে মহসিন হল ছাত্র সংসদের ভিপি। দেখা করলাম। তিনি আমাকে প্রথমে সিঙ্গারা খাওয়ালেন তারপর এক বান্ডিল পোস্টার পেপার ও কয়েকটি লাল নীল সবুজ পোস্টার পেন ধরিয়ে দিলেন। একদিনের মধ্যেই লিখে দিতে হবে। দায়িত্ব নিলাম টিটো ভাই এর পোস্টার লেখার যিনি এখন প্রখ্যাত সাংবাদিক মাহফুজ আনাম।
সূর্যসেন হলেই থাকতেন রাজীব হুমায়ূন ভাই। তিনিও ইলেকশন করবেন বাংলা বিভাগ থেকে। বেবী মওদুদ ভিপি এবং তিনি জিএস পদে। অতএব সেখানেও পোস্টার লেখার অনুরোধ।
স্বাধীনতার পর স্কুলগুলোতে বই পেতে দেরী হচ্ছে। ছাপাখানার অবস্থাও ভালো না। এক রাতে আকরাম ভাই, সিরাজ ভাই, জাহিদুল বারী, আওলাদ সহ আমরা গেলাম সচিবালয়ের সামনে। সাথে আলকাতরা, রং আর ব্রাশ। সচিবালয়ের দেয়ালে মই লাগিয়ে উপরে উঠে বিশাল বিশাল অক্ষরে লিখলাম- বই চাই, বই চাই। আরো লিখলাম- লাখো শহীদের আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ, এসো দেশ গড়ি। সেদিন আলকাতরার টিনে অসাবধানতার ফলে আমার আঙুল কিছুটা কেটে যায়। গভীর রাতে টিকাটুলির রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে এটিএস ইন্জেকসন দিয়ে আসি।
এই যে পড়াশুনার পাশাপাশি এতো যে কর্মকান্ডের সাথে জড়িত হয়ে যাই, বিনিময় কি পাই? এখনকার শিক্ষার্থীদের মনে এ ধরনের প্রশ্ন আসতেই পারে। আসলে দেশপ্রেম থেকে বড়তো কিছু নেই। তাই যেটা পেয়েছি সেটা হলো মানুষ হবার শিক্ষা ও দেশপ্রেম। তবে বাবার পাঠানো দেড়শত টাকা থেকে প্রতি মাসে দশ টাকা দিতে হতে ছাত্র ইউনিয়নের ফান্ডে। এটাও এক ধরনের শিক্ষা যা দায়িত্ববোধ থেকে করতে হতো।
নাম নিয়ে কথা বলছিলাম। বিটিভিতে একই সাথে থাকায় অনেকেই আমাকে ম হামিদ বা হামিদ ভাইকে খ ম হারূন ভাবতেন। একবার হামিদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনি কিভাবে ম হামিদ হলেন। তিনি জানান, তার প্রকৃত নাম কাজী মোহাম্মদ হামিদ। পরে নাম সংক্ষিপ্ত করার সময় দেখেন ক ম হামিদ ভালো লাগছে না। পরে ক ফেলে দিয়ে ম হামিদ হয়ে যান। তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকটা নামের একটা ছন্দ আছে, তোমার ক্ষেত্রে যেমন খ ম হারূন বেশ মানিয়ে গেছে আর আমার ক্ষেত্রে ম হামিদ।
একবার একটা গানের চিত্রায়ণ করতে টঙ্গী গেছি। সুন্দর লোকেশন। ফকির আলমগীর, সাদী মহম্মদ, শাকিলা জাফর সহ বেশ কজন শিল্পী আছেন সেখানে। হঠাৎ দেখি ফকির আলমগীরের সাথে আরেকজন শিল্পীর তর্ক লেগেছে। ফকির আলমগীর অন্যজনকে চ্যালেঞ্জ করে বলছেন, তিনি খ ম হারূন এবং ম হামিদকে অনেক আগে থেকেই চেনেন। তারা দুই ভাই। তাদের বাসাতেও তার যাতায়াত আছে। অন্যজন বলছেন, তিনিও চ্যালেঞ্জ গ্রহন করছেন তারা দুই ভাই না। তুমুল তর্ক-বিতর্ক। এমনিতেই ফকির আলমগীর বেশ উচ্চকন্ঠে কথা বলেন। অতএব আমার ডাক পরলো। আমি ফকির আলমগীরকে সমর্থন করলাম। তিনি মহাখুশী। চ্যালেঞ্জ জিতে তিনি সবাইকে টঙ্গীর বিখ্যাত চমচম খাওয়ালেন। অবশ্য ফকির আলমগীরের এই ভুল ভাংগতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিলো।
[চলবে]
আগের পর্ব পড়ুন
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই