শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পরবাসী মন [প্রথম পর্ব]

হাডসন উপত্যকার বাদামী হরিণ

রিফাত ফাতিমা

১১:৫২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৩:৩৯, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

১০১৯

পরবাসী মন [প্রথম পর্ব]

হাডসন উপত্যকার বাদামী হরিণ

রিফাত ফাতিমা, জার্মানটাউন, নিউইয়র্ক
রিফাত ফাতিমা, জার্মানটাউন, নিউইয়র্ক

[প্রথম পর্ব]


বাচ্চারা কখন আজ স্কুলে চলে গেছে একেবারও টের পাইনি। ডাইনিং টেবিলে দেখি উলের টুপিটা পড়ে আছে, তাহিয়ার কাণ্ড। ঠিকই সন্ধ্যায় শুকনো মুখে বলল, ক্লাসে আজ এত ঠাণ্ডা লেগেছে! আসলেই সেদিন ঝকঝকে রোদের সাথে গত তিনবছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা পড়েছিলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের আপার মিডওয়েষ্ট, দ্য গ্রেট লেকস ও নর্থওয়েষ্ট অঞ্চলে। 

সকাল দশটায় তাপমাত্রা দেখলাম মাইনাস ১৪ ডিগ্রি। দুপুরে হাঁটতে যেতে চাইলাম। ফাহমিদ বলল, রোদ দেখে ভুল করে বসো না! এনবিসি নিউজের ক্যাথরিন প্রোচিভের রিপোর্টে দেখলাম বাতাস এত ঠাণ্ডা ছিল যে, মহাশূন্য থেকে ইনফ্রারেড স্যাটেলাইট ছবিতে তা দেখা গেছে। পরশু তাহিয়াকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। বরফে ঢাকা উপত্যকা, সারিবদ্ধ আপেল বাগান, গাছেদের কঙ্কালেরাও যে এত সুন্দর হয়, না দেখলে জানতাম না। আর গতকাল রিপ ভ্যান উইঙ্কল ব্রিজের উপর দিয়ে ক্যাটসকিলে যাবার সময় দেখি পাহাড়শ্রেণি বরফের কম্বল মুড়িয়ে আছে। নদীর পানি ও আশেপাশের ছোট ছোট লেকে খুব পাতলা বরফের আস্তরণ। 

ফেরার পথে পাহাড়ের উপরে একটা দূর্গের মতো বাড়ি, কেন জানি যতবার এই পথ দিয়ে ফিরি মনে হয় কোন এক রাপুনজেল ওখানে বন্দী নেইতো? রেডহুকের সেলুনে ফাহমিদ ঢুকলে আমি বাইরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াই, একটা দোকানের ভেতরে দেখলাম লেবু গাছ, ফুটে আছে অজস্র গোলাপী জবা, এমনকি একটা জলজ্যান্ত কলা গাছ! কবে সামার আসবে, আমি গাছ লাগাব। কলাগাছ দেখে মনে পড়ে গেল আমার বাচ্চারা জীবনে প্রথম কাছে থেকে কলাগাছ দেখেছিল লঙ্কাউয়িতে, কলার মোচা দেখে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে দুজনের কি চিৎকার, ব্যানানা ফ্লাওয়ার!!! অথচ এই আমি শৈশবে সকাল হলেই পড়া ফাঁকি দিয়ে বাগানে ঘুরে বেড়াতাম, কলার পাতার আগায় যে নরম সূঁচালো অংশ থাকে তা দিয়ে মালা বানাতাম। আর আম্মার হাতের কলাপাতায় মোড়ানো ইলিশ পাতুড়ি আর কাচকি মাছ পাতুড়ির কথা এখন আর মনে করতে চাইনা।
 
আমরা কাজিনেরা নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি, শচি নরওয়ে থেকে বলে, ‘এখানে তিনটায় সন্ধ্যা হয়। বাচ্চাকে ডে কেয়ারে যখন নিয়ে যাই তখনও অন্ধকার, ফিরি যখন তখনও অন্ধকার। বরফ পড়ছে তো পড়ছেই।’ পারমিতা ভ্যাঙ্কুভার থেকে বলে ‘আপু, এত ঠাণ্ডা, আমি বাস মিস করে আছাড় খেয়ে একাকার।’ কেয়া লুসার্ন  থেকে অনেককাল পর যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু আমার সুইস শীতের গল্প  শুনতে ইচ্ছে করে না। নিজে আমি সবাইকে সাহস দেই। শচিকে বলি, ‘‘তুই ভাববি বরফ নয়, বেলিফুল পড়ছে সারাদিন।’’

পরবাসী জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। দু'চারবার আছাড় খাওয়া কোন ব্যাপারই নয়। এখানকার হাসপাতালে চাকরিতে যোগ দিয়েছি দু’ সপ্তাহ হল। ঠান্ডা পড়ছে ভীষণ, আজ সকালে মাইনাস আঠারো, কিন্তু রোদ বড় ঝকঝকে। 

একা একা বল খেললাম বরফে। একাই ছুড়ে দেই একাই তুলে আনি। বেশিক্ষণ বাইরে টেকা যায় না। গ্রসারি সেরে লিভিংস্টোনের ভেতরের উঁচু নীচু পথ ধরে  বাসায় ফিরছিলাম, পুরো উপত্যকা জুড়ে বরফের পাতলা চাদর, বনের ভেতর দিয়ে রাস্তাগুলো কোথায় যে গেছে। 

শীত ছাড়া এখানে অনেক বাদামী হরিণ চোখে পড়ে। আমার প্রিয় বাদামী হরিণেরাও কোথাও আশ্রয় নিয়েছে, তাদের দেখা আজকাল পাই না। গত সপ্তাহে যখন প্রায় দশইঞ্চি পুরো বরফে আশপাশ ঢাকা পড়েছিল, পাশের ফার্মের উল্টোদিকে হাঁটতে গিয়ে দেখি একটি বাদে আস্তাবলের সব ঘোড়ারা ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে, আকাশ নিকষ কালো অন্ধকার। দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে ফিরছি, দেখি এক বাড়ির সামনের বারান্দায় আধোআলো ছায়ায় এক নারীমূর্তি দাড়িয়ে। কে জানে বাবা পান্তুভূত না জ্যান্ত ভূত! আমি দে দৌড়। 

ক্রিসমাসের দু’দিন আগে এই রাস্তায় আরেক প্রতিবেশীর সাথে আলাপ হয়েছিল, ভেবেছিলাম এই ঘোর দুর্দিনে তার একটু খোঁজ নেব।তিনি আবার আশি পেরুনো, একাই বাস করেন। ‘‘ভ্যকসিন নিয়েছ? তাহলে ভাল থাকবে।অমিক্রন তো ঘাঁটি গেড়ে বসেছে,’’ আমি বলছিলাম। 

তিনি একগাল হেসে বললেন, ‘‘আমি ফ্লু শট নিয়েছি কেবল। সিরিঞ্জ ভয় পাই।’’ 

- ‘‘তাহলে তোমার সাথে গল্প করব কেমন করে, আমি তিনটাই নিয়েছি।’’ 

ওমা এই শুনে তিনি আমার সাথে এমন ভঙ্গীতে বিদায়ী হ্যান্ডশেক করলেন যেন আমি অচ্ছ্যুত। কে জানে বেচারি এখন কেমন আছে!

বাংলাদেশে দেখলাম, সরস্বতী পূজার ৩৫ টি মূর্তি ভাঙচূর হয়েছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। মনে মনে ক্ষমা প্রার্থনা করি সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী বন্ধুবান্ধবের কাছে। কবে মানুষ হব আমরা? এই আমিও তো যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যালঘু। কবে নিজেদের সেরা মনে করার এই রোগ আমাদের ঘুচবে? কে জানে! শান্তনুদা, জয়ন্ত, সুস্মিতা, স্বপ্না, সোনম আর আমার শৈশবের হারিয়ে হাওয়া বন্ধু কনক, উৎপল আমার মায়ের সহকর্মী নিভামাসী, আমার গৃহশিক্ষক প্রদ্যোৎমামা সবার কাছে একজন মানুষ হিসেবে ক্ষমা চাইছি। বহু সংস্কৃতি ও ধর্মের মিলন মেলা এই দেশ তার অসাম্প্রদায়িক রূপ কবেই হারিয়েছে! লুটেরারা মিলে চেতনা ধুয়ে পানি খাবার যে অনন্ত উৎসব শুরু করেছে কবে তার শেষ হবে কে জানে!

আর ওই যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মগজ কেনার কারবারীরাতো ছাত্রছাত্রীদের মান সম্মত খাবারের দাবিও মেটাতেই অক্ষম। আপনি নিম্নমানের খাবার দেবেন, বাজেটে শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দ করবেন জিডিপি হিসেবে কেবল দুই দশমিক শূন্য আট, আর নিজেদের ঢোল নিজেরা পেটাতে থাকবেন। উন্নয়ন অবশ্যই হয়েছে দেশের কিন্তু দেশের ভবিষ্যত যাদের হাতে, তাদের স্বাস্থ্যের ও মগজের উন্নয়নের জন্য যথাযথ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করার দায়ও কিন্তু আপনাদের। তা নয় আপনারা ঢাল তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামলেন। কিসের এত ভয় আপনাদের? নিজেদের মগজ তো বহু আগে বিকিয়ে রেখেছেন।

চলবে...
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank