শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কাওয়ালি বিষয়ক আলোচনা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

১৭:১০, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

আপডেট: ১৯:৩৯, ২৬ জানুয়ারি ২০২২

৯৮৫

কাওয়ালি বিষয়ক আলোচনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র – টিএসসির সামনে কাওয়ালি অনুষ্ঠান পণ্ড হওয়ার খবরে দু’জন ব্যক্তিত্বের কথা তাৎক্ষণিকভাবেই মনে পড়েছে। একজন ভারতের ত্রয়োদশ শতাব্দীর দার্শনিক, কবি, সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার আমির খসরু, মৃত্যুর সাতশ’ বছর পরও যিনি উপমহাদেশে সঙ্গীত ও কবিতার জগতে কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃত। যিনি সুফি ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ‘সামা’ বা ঘূর্ণায়মান নৃত্যের সঙ্গে ইশ্বরের স্মরণ বা ‘জিকির’ বা ‘অনুশীলন, যা ওই তাঁর সময়ে ফারসি, আরবি, তুর্কি ও ভারতীয় সুফি চর্চার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, সেগুলোর সমন্বয় সাধন করে ভারতীয় উপমহাদেশে কাওয়ালির বর্তমান রূপ দিয়েছেন বলে আমরা জানি। আরেকজন যাকে মনে পড়েছে, তিনি মহারাষ্ট্র ভিত্তিক চরমপন্থী রাজনৈতিক দল শিব সেনা’র প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘সামনা’ নামে একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক দিলেন। তাঁর দল যা কিছু ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে জড়িত সেগুলোকে ‘জর সে উখাড়’ অর্থ্যাৎ সমূলে উৎপাটন করার জন্য মারাঠিদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর এক দশক অতীত হলেও তাঁর শিব সেনার চ্যাংড়ারা এখনও ভারতে গোলাম আলী ও রাহাত ফতেহ আলী খানের মত গজল ও কাওয়ালি শিল্পীদের কনসার্ট, রেকর্ডিং ইত্যাদির বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নেয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরনের অনুষ্ঠান বানচাল করার মত ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশে কাওয়ালি অনুষ্ঠান বানচাল করার ঘটনা এ কারণে আমার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে যে, শিল্পীরা বাঙালি, পাকিস্তান থেকে আগত নন, বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদের কাওয়ালির ভাষা বাংলা।  

ভারত ও পাকিস্তানের বহু মুভিতে পরিবেশিত কাওয়ালি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ‘মোগল-এ-আজম’ মুভিতে শাকিল বদাউনির লেখা “তেরি মেহফিল মে কিসমত আজমা কর হাম ভি দেখেঙ্গে/ঘড়ি ভর কে তেরে নজদিক আ’কর হাম ভি দেখেঙ্গে -----”( তোমাদের অনুষ্ঠানে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখব যে কী ঘটে/মুহূর্তের জন্য আমরা তোমাদের কাছে এসে দেখব যে কী ঘটে ---) কাওয়ালির জনপ্রিয়তা উপমহাদেশজুড়ে, অথবা এক হিলাল মুভিতে “হামে তো লুট লিয়া মিলকে হুসনে ওয়ালো নে/কালে কালে বালো নে, গোরে গোরে গালো নে,” (সুন্দরীরা এক হয়ে আমাকে লুণ্ঠন করেছে/কালো চুল আর ফরসা গাল দেখিয়ে লুণ্ঠন করেছে) এমন আরও অনেক আছে। নূসরত ফতেহ আলী উর্দু, পাঞ্জাবি ও ফারসি কাওয়ালিকে জনপ্রিয়তার ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। ভারত ও পাকিস্তানজুড়ে আরও অনেক জনপ্রিয় কাওয়ালি সঙ্গীত আছেন। 

আমির খসরুকে উপমহাদেশে আধুনিক কাওয়ালির জনক বিবেচনা করা হয়, যাকে কাওয়ালির জন্য উৎসাহিত করেছিলেন তাঁর ওস্তাদ সুফি সাধক দিল্লির হয়রত নিজানুদ্দিন আওলিয়া। বলা হয়ে থাকে যে নবী মুহাম্মদ সা: এর সময়েও সম্ভবত কাওয়ালির অস্তিত্ব ছিল। ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিদ্বজনেরা সঙ্গীতের আধ্যাত্মিক প্রভাব প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কাওয়ালির অস্তিত্ব ইমাম আল-গাজালির (১০৫৮-১১১১) সময়ে পরিশীলিত ও মার্জিত রূপ দেওয়া ছাড়াও শ্রেনিভূক্ত করা হয়। সুফিবাদের চিশতিয়া তরিকাপন্থীরা কাওয়ালিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেয়। চিশতিয়া তরিকা নিয়ে অবশ্য সামান্য বিভ্রান্তি রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে অধিকাংশ মানুষ মনে করেন যে চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (১১৪৩-১২৩৪), কিন্তু অনেকে বিশ্বাস করেন যে চিশতিয়া তরিকার উৎসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন আবু ইশহাক শামি চিশতি, যিনি ৯৪০ সালে দাশেকে মারা যান। এই বিতর্কে না গিয়ে আমরা বলতে পারি যে, পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসকরা শাসন শুরু করার পর চিশতিয়া তরিকার অনুসারীরা কাওয়ালি চর্চা শুরু করেন। 

সন্দেহ নেই যে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি উপমহাদেশে সুফিবাদের বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর এক অনুসারী ছিলেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া (১২৩৬-১৩২৫), যাকে তিনি দিল্লিতে পাঠান। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার বন্ধু ও ভক্তে পরিণত হন আমির খুসরো (১২৫৪-১৩২৫)। জানা যায় যে, তিনি দিল্লি সালতানাতের ১১ জন শাসকের উপদেষ্টা ছিলেন, বিশেষ করে খিলজি বংশের সুলতানদের। এ সময়ে তিনি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার উৎসাহে কাওয়ালির উন্নয়ন ঘটান। 

মোগল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে কাওয়ালির আরও বিকাশ ঘটে, যা হিন্দুদের ‘ভজন’ এর প্রায় কাছাকাছি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে আমরা অনেক ধরনের সঙ্গীতে কবীরের (১৪৪০-১৫১৮) মত গুণী কবি, শিল্পী ও সাধুসন্তদের অবদানও দেখতে পাই, যাদের হিন্দু ও মুসলিমরা একইভাবে শ্রদ্ধার করে। কাওয়ালির ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন জড়িত। বিশেষ করে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় সুফিদের উদারনৈতিক ঐতিহ্যকেও আওরঙ্গজেব পছন্দ করতে পারেননি। সঙ্গীতে বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল কঠোর। এ সম্পর্কে একটি কাহিনি প্রচলিত ছিল যে, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে একদল সঙ্গীতশিল্পী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভগ্নহৃদয়ে তাদের বাদ্যযন্ত্র কাফনে মৃতদেহ মোড়ানোর মত করে খাটিয়ায় তুলে শোভাযাত্রা সহকারে সড়ক প্রদক্ষিণ করেন, যেভাবে মৃতকে কবরস্থ করার জন্য কবরস্থানে বয়ে নেয়া হয়। এটি ছিল সঙ্গীতশিল্পীদের প্রতিবাদের প্রকাশ। আওরঙ্গজেব শোভাযাত্রা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং ঘোষণা করেন, “ভালো কথা! এসব বাদ্যযন্ত্রকে মাটির এত গভীরে পুঁেত ফেলা হোক, যাতে আর কখনও কোনো বাদ্য শোনা না যায়।”

কিন্তু আওরঙ্গজেবের পর কাওয়ালি এবং অন্যান্য সঙ্গীত পুনরায় বিকশিত হতে থাকে। তা থেকে একটি সত্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে যত ধরনের অবদমন প্রচেষ্টাই চালানো হোক না কেন, কোনো ধরনের শিল্পের অবসান ঘটানো সম্ভব নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদার, রাজা, মহারাজারা সঙ্গীতের যেকোনো ধারার পৃষ্ঠপোষকতা ও বিকাশের ক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শন করেছেন। ভারতে চলচ্চিত্রের যুগ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন মুভিতে কাওয়ালির উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। তবে মুভির কাওয়ালিতে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক চেতনার বিষয় কম স্থান পেয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ আবহ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, ফলে কাওয়ালির পরিসর আরও বিস্তৃত পরিসর লাভ করেছে। ধর্মীয় চেতনা সমৃদ্ধ কাওয়ালিকে মুভিতে একেবারে বর্জন করা হয়নি। এ আর রহমানের পরিচালনা ও সুরারোপে অনেক কাওয়ালি, যেমন কোরআনের আয়াত ‘কুন ফা ইয়া কুন,’ অথবা বোম্বের সুফি দরবেশ হাজি আলীর ওপর ‘পিয়া হাজি আলী’ জনপ্রিয় হয়েছে। কাওয়ালির ধর্মনিরপেক্ষকরণ বেশ মজার বিষয়। কারণ আধাত্মিক কাওয়ালিও যদি কেউ শোনেন, তাহলে তারা কাওয়ালির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ বা সকল ধর্মের একেশ্বরবাদী ধারণাও সুপ্ত দেখতে পাবেন, যদি শ্রোতারা কাওয়ালির কথাগুলোকে রূপক অর্থে গ্রহণ করেন, যা পুরোপুরি শ্রোতাদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। 

কাওয়ালি যে সুফি ঐতিহ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত তা আগেই উল্লেখ করেছি। সুফিবাদ ইসলামের অতীন্দ্রিয়বাদী চিন্তাভাবনা থেকে উৎসারিত, যা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সত্য ও ঐশ্বরিক ভালোবাসা পাওয়ার পথ। আরবিতে অতীন্দ্রিয়বাদকে বলা হয় ‘তাসাওউফ’ অর্থ্যাৎ সুফিবাদ। সুফিবাদ এবং মূলধারার ইসলামের সঙ্গে পার্থক্য খুব সাধারণ Ñ ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ আল্লাহকে পাওয়ার পথ হচ্ছে ‘তরিকা’, এবং আল্লাহর কাছে পৌছা সম্ভব শুধু মৃত্যুর পর শেষ বিচারের দিনে। সুফিবাদ আল্লাহর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলাকে প্রাধান্য দেয়। কোরআনে আল্লাহকে স্মরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এই স্মরণ হচ্ছে ‘জিকির’ বা অনুশীলন বা চর্চা, যা উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত হতে পারে। কাওয়ালিকে আল্লাহর স্মরণের উচ্চারিত ধরন হিসেবে দেখা হয়। ইমাম গাজালি এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, আগ্রহীরা তা দেখতে পারেন। 

কাওয়ালির মধ্যে সুনির্দিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। একজন কাওয়ালি শুরু করেন এবং তাঁর সহশিল্পীরা তাঁর কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন একযোগে এবং এক পর্যায়ে কথার মর্ম হারিয়ে যায় এবং কাওয়াল ও শ্রোতারা ভাবাবেশে আপ্লুত হন এবং সকলে আধ্যাত্মিক আলোকপ্রাপ্তি বা ‘ফানা’র পর্যায়ে উন্নীত হয়, যাকে বলা হয় ‘ফানা ফিল্লাহ’, বা আল্লাহর মাঝে নিজেকে লীন করা। উপমহাদেশে প্রচলিত কাওয়ালির প্রতিপাদ্যে  সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা, আত্মনিবেদিত হওয়া ও স্রষ্টাকে পাওয়ার কথাগুলোই প্রধান। কাওয়ালির সূচনাকাল থেকে কাওয়ালির প্রধান প্রতিপাদ্য হিসেবে আল্লাহর প্রশংসা, নবী মুহাম্মদের প্রশংসা, হযরত আলীর প্রশংসা এবং কারবালায় ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ এর মত শোকাবহ ঘটনা স্থান পেয়েছে। কিন্তু উপমহাদেশে কাওয়ালির গ্রহণযোগ্যতার পরিসর ব্যাপক, শুধু সুফি জলসায় নয়, বরং বিয়ের মত সামাজিক অনুষ্ঠানেও কাওয়ালি পরিবেশন স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু: লেখক ও অনুবাদক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank