জন্মদিনে লেখককে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা
শুভ জন্মদিন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
জন্মদিনে লেখককে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা
শুভ জন্মদিন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
‘মাটি থেকে ইট হয়, ইট থেকে বাসা-বাসা পুরতন হয়ে ভেঙে যায়’
পার্থিব উপন্যাসে এ কথাই লিখেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এই বাংলা থেকে বাসাবাড়ি গুটিয়ে একদিন শীর্ষেন্দুদের পরিবার চলে গিয়েছিল কলকাতায়। তারপর সেখানেই তার লেখক হয়ে ওঠা। সেখান থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন পারাপার, মানবজমিন, দুরবিন, যাও পাখি, পার্থিব এমন পাঠকনন্দিত উপন্যাসের লেখক।
‘শীর্ষেন্দুর কোনো নতুন নভেলে
হঠাৎ পড়তে বসা আবোল তাবোল’
কবীর সুমনের গানের এই লিরিক শুনে হাতে শীর্ষেন্দুর কোনো বই নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে মন আনচান করে ওঠে। মনে হয়, ডুবে যাই বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতীম এই সাহিত্যিকের লেখায়। সব্যসাচী এই লেখকের গল্প, উপন্যাস, কিশোরসাহিত্য ভুলিয়ে দেয় সময়, কাল। আজ তার জন্মদিন।
লেখকের মূল বাড়ি বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বাইনখানা গ্রামে। জন্ম ১৯৩৫সাল, ময়মনসিংহে, দাদুবাড়িতে এক বিশাল পারিবারিক দঙ্গলে। সেখানে তার জীবনের প্রথম ১১ বছর কাটে। দেশভাগের সময় তিনি ক্লাস সিক্স পড়তেন। এরপর পরিবারের সাথে চলে যান পশ্চিমবঙ্গে।
দেশভাগ তাকে প্রচণ্ড পীড়া দিয়েছে, হারিয়েছেন অনেক আত্মীয়-শুভাকাঙ্ক্ষীকে। নিজেকে আজও উদ্বাস্তু বলে দাবি করেন তিনি। তার ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসে দেশভাগের বেশ কিছু ব্যাপার উঠে এসেছে, যা তার নিজের অভিজ্ঞতার আদলেই গড়া। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে তাকে।
শীর্ষেন্দুর লেখায় নকশাল আন্দোলনের কথাও এসেছে কিছুটা। তবে এই আন্দোলনকে আগাগোড়া ভুল বলেই মনে করেন তিনি। তার মতে গোটা পৃথিবীতেই মার্কসিজম পরিত্যক্ত। সমসাময়িক শক্তি বা সুনীলের মতো বোহেমিয়ান ভাব নেই এই লেখকের মধ্যে, বেশ ঘরমুখো বলে তিনি নিজেই স্বীকার করেন।
শীর্ষেন্দু বলেন, পাঠকের মনোরঞ্জনের চাইতে নিজের তৃপ্তিকে তিনি লেখার ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেন, তার কাছে লেখাটা একটা ‘মিশনারি ওয়ার্ক’। লিখবার সময় নিজেকে ভুলে যান, তাই তার লেখায় তাকে ঠিক স্পষ্ট করে খুঁজে পাওয়া যায় না। এই লেখকের মতে, তার জীবনটা অতোটা ঘটনাবহুল নয় এবং এজন্য তিনি সচেতনভাবেই নিজেকে অনেকটা এড়িয়ে যান লিখবার সময়।
তার ছোট উপন্যাসগুলোর চাইতে বিশাল পরিসরে লেখা উপন্যাসগুলো পাঠকের কাছে বেশি আবেদন রাখে, কারণ তিনি একটা বিস্তৃত সীমার মধ্যে চরিত্রগুলোকে বেশি বাঙ্ময় করে তোলেন।
কিন্তু তাও হয়তো সবসময় এড়ানো যায় না। কোথাও না কোথাও তিনি এসেই পড়েন। যেমন ‘উজান’, এটি তার অসাধারণ একটি শৈশবস্মৃতি। যেখানে সে সময়ের ময়মনসিংহকে দারুণভাবে পাওয়া যায়। রেললাইন, ব্রহ্মপুত্র, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ- সব যেন স্পষ্ট এবং স্পর্শকাতর করে পাঠককে।
কলকাতার স্বাধারণ মানুষের যাপিত জীবনকে তিনি তুলে ধরেছেন ‘পারাপার’-এ, এসেছে মনস্তকত্ত্বিক লড়াই ও দর্শন । ‘দূরবীন’ তার তিন প্রজন্মকে ধারণ করে এগিয়ে চলা এক তুলনাহীন উপন্যাস। হোমকান্ত-কৃষ্ণকান্ত-ধ্রুবের মধ্যে বিবর্তনশীল সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তিন প্রজন্মের কাহিনী। এখানে উঠে এসেছে জমিদারী প্রথা, স্বদেশী আন্দোলন ও আন্দোলন পরবর্তী প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট যন্ত্রণা, দেশভাগের উত্তাল দিনরাত্রির ইতিহাস।
শীর্ষেন্দুর লেখার উপজীব্য মানুষের জীবনযাপন, শ্রেণিভেদের সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম আর আধ্যাত্মিক চেতনা। কিশোর উপন্যাসকে অত্যন্ত উঁচুদরে পৌঁছে দিয়েছেন এই লেখক। তার কিশোর উপন্যাসে অবধারিতভাবে দেখা যায় গ্রামের সিঁধকাটা চোর, ডাকাত, পেটমোটা দারোগা, কাপালিক এবং সব হারানো জমিদারকে।
তার তিন বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস গোঁসাইবাগানের ভূত, ছায়াময় ও মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি নিয়ে বানানো হয়েছে তিনটি সিনেমা এবং তিনটিই বক্স অফিস মাত করেছে।
তার সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শবর দাশগুপ্ত। ‘শবর সিরিজ’–এর প্রথম বই ঋণ। শবর চরিত্র নিয়ে পরিচালক অরিন্দম শীল বানিয়েছেন এবার শবর, ঈগলের চোখ ও আসছে আবার শবর নামে একে একে তিনটি সিনেমা।
দেশ পত্রিকার সাথে শীর্ষেন্দুর সম্পর্ক বেশ পুরনো। তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ ১৯৫৯ সালে এই পত্রিকায় প্রকাশ পায়, এই পত্রিকাতে আরো সাত বছর পর প্রকাশ পায় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। পরে তিনি দেশ পত্রিকার সাথে কর্মজীবনেও যুক্ত ছিলেন।
যৌবনে ভয়ানকভাবে বিষন্নতায় আক্রান্ত হন শীর্ষেন্দু , জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং একসময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত মা–বাবা তাকে পাবনার শ্রীশ্রী অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের কাছে নিয়ে যান। ঠাকুরের সান্নিধ্যে জীবন বদলে যায় তার।
তাই তার লেখায় পাবনার ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের প্রভাব সবচেয়ে গভীর ও ব্যাপক। বহু সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তার জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছেন ঠাকুর এবং জীবনের প্রধানতম উপকরণ।
প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে ১৯৮৫ সালে পাওয়া বিদ্যাসাগর , আনন্দ, সাহিত্য আকাদেমি এবং বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই