ভার্চুয়াল ডায়রি- পর্ব ৬
অপরাহ্নের সামগীতি: ক্যাটসকিলে খুঁজে পাই বিভূতির চাঁদের পাহাড়
রিফাত ফাতিমা, জার্মান টাউন, নিউিইয়র্ক আপস্টেট থেকে
২৩:৪৮, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১
আপডেট: ২৩:৫২, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১
১০৭৭
ভার্চুয়াল ডায়রি- পর্ব ৬
অপরাহ্নের সামগীতি: ক্যাটসকিলে খুঁজে পাই বিভূতির চাঁদের পাহাড়
আজ দু’সপ্তাহ হল আপস্টেট নিউইয়র্কে এসেছি। পেছনে ফেলে এসেছি প্রিয় ইন্ডিয়ানা, নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয়তর ছোট ভাইবোন ও ভাবীদের সাথে অজস্র সুখদুঃখের স্মৃতি। সবাইকে বলেও আসতে পারিনি। ফেরার পথে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখে এলাম। খুব ভালো লেগেছে, বাচ্চাদের খুব মিস করছিলাম, বারবার আমার শাশুড়ি ও আম্মার কথা মনে পড়ছিল। যদি তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে পারতাম।
নতুন বাসা এরইমধ্যে তাহিয়া, মন্ময় আর ফাহমিদ মিলে গুছিয়ে রেখেছে। আমাদের বর্তমান বাসস্থানের চারপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট শহর। পাহাড়ি এলাকা, বেশ সরু রাস্তা, দু’ধারের হেমন্তের রঙীন বনভৃমি কোন এক অজানা শিল্পী যেন সাজিয়ে রেখেছে।
বিকেলে হাঁটতে বের হলাম। কাছেই ক্যাটসকিল পর্বতমালা, তার পাদদেশে কিংসটন শহর। আমাদের সেখানে যেতে হয় গ্রসারি ও ব্যাংকের কাজ সারতে। ল্যান্ডলেডি মেরি জানাল, কিংসটনে বার্নস এ্যান্ড নোবেল বুক শপ আছে। শুনে মন ভালো হয়ে গেল।
আব্বুর সাথে আর শাশুড়ি মায়ের সাথে প্রায় একমাস পর কথা বললাম। এত ব্যস্ত ছিলাম যে তাদের খোঁজ নিতে পারিনি। আব্বু শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছেন। গত দু’বছরে এত বুড়িয়ে গেছেন, আমার প্রিয় কাজিন আদিতের বিয়ের ছবিতে দেখলাম পরনের স্যুটটা গায়ে ঢলঢল করছে। বড় মামাও খুব বুড়িয়ে গেছেন। আমার জগত সংসার ভালো লাগেনা, সাজানো বসার ঘর, গৃহস্থালী ভালো লাগে না, নিজেকে স্বার্থপর মনে হয়। যাদের স্নেহে, ত্যাগে লালিত তাদের ফেলে এসেছি। কবে দেশে যেতে পারব ঠিক নেই। আমাকে পাশের বনের হরিণ টানে না, আকাশের উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক দেখে হিংসে হয়। হাঁটতে গিয়ে আমার স্কুলের বাচ্চাদের নাম ধরে ডাকতে থাকি, ‘‘জ্যাক জ্যাক, আই মিস ইউ,’’ গ্র্যান্ট, ডু ইউ ওয়ান্ট এ হাগ ফ্রম মি? ‘‘লিটল বেনেট, ডোন্ট লাফ দ্যাট ওয়ে। মাই হার্ট ইজ মেল্টিং।’’ এজেলির জন্য, জর্ডানের জন্য মন কেমন করে।
সকালে ঘুম ভেঙে মনে হয়, আমি কোথায়? আমার তো স্কুলে থাকার কথা। আবার মনে পড়ে, বস নতুন শিক্ষকের ইন্টারভিউ শেষে বলছেন, ‘‘আই এ্যাম এক্সাইটেড,’’ শিক্ষকও পাল্টা বলছেন,‘‘ আই এ্যাম অলসো এক্সাইটেড।’’ আর এসব আলাপ শুনে হতভম্ব আমি ভাবতাম, ও আল্লাহ, এরা সবাই এত এক্সাইটেড! স্কুলের কাজকর্ম কিভাবে চলবে?
তাহিয়া মন্ময় বড় হয়ে গেছে। মন্ময় বলে, ‘‘আম্মু তুমি আমার কিচেন এলোমেলো করে রাখ’’। বকতে বকতে সে প্রতিদিন রাতে আধাঘন্টা ধরে কিচেন গোছায়।
তাপমাত্রা এখানে মাইনাসের নীচে নেমে যাচ্ছে রাতে। বনের হলুদ কমলা ও লাল পাতারা ঝরে যাচ্ছে। ব্যাক ইয়ার্ডে সাত আটটা সুগার পাইন একসারিতে দাঁড়িয়ে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি মনে মনে। বরফ পড়া দিনগুলোতে অন্তত একটু সবুজের দেখা মিলবে। ব্লু জে পাখিরা দল বেধে হুটোপুটি খায়। শীতের বাতাসে ঝরা পাতারা পাক খেতে খেতে ঝরে পড়ে। হঠাৎ জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসে। কোভিড থেকে বেঁচে ফেরার ঠিক একবছর হল। পরদিন ফাহমিদের ৫0 বছর হল, মন্ময় কেক বেক করল। আমরা গান গাইতে গাইতে বার্থডে ম্যানকে অভিনন্দন জানালাম।
এখানে আরো এক সপ্তাহ পর সব ঠিক থাকলে আবার জবে ঢৃকব। এরমধ্যে থ্যাংকস গিভিং ডে এল। ডিনারের দাওয়াত পেলাম বার্ড কলেজের আইনের প্রফেসর জ্যাকির বাসায়, কোপেক হিলে ছোট্ট লেকের ধারে জ্যাকির কাজিনেরা সব মিলে উৎসবের আয়োজন করেছে। দূর দূরান্ত থেকে তার আত্মীয় স্বজন এসেছে, সাথে তাদের অনেক কুকুর। আমি হাসি হাসি মুখ করে কুকুরদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তারা বেশ ভদ্র, কোন শব্দ না করে ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এ প্রসংগে মনে পড়ল, আমার নটরডেমের ফ্রেন্ড কারেন স্মার্ক রেসের ঘোড়া দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল কলোরাডো রোডে তার আত্মীয়ের বাসায়। ওই বাসায় ঢোকার সাথে সাথে তাদের তিনটা কুকুর উত্তেজনার আতিশয্যে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন ঘাড়ের উপর, আরেকজন আমার হাত চাটছে তো আরেকজন চেঁচাচ্ছে। গৃহকর্ত্রী এহেন অনাচার সহ্য করলেন না, অতিথিকে ঘাবড়ে দেওয়ার অপরাধে তিনজনকেই শাস্তি স্বরূপ বের করে দেওয়া হল। বেচারারা দরজার বাইরে থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। পরে অবশ্য একজনকে ঘরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
যাহোক এখানে ডিনারের জন্য কি সুন্দর বাড়ির কর্তা রান্না করছে, আর আমাদের ঈদে চাঁদে বাড়ির গিন্নী, মেয়ে বউদের রাঁধতে রাঁধতে প্রাণ যায়।
খাবার টেবিলে আলাপ হল অবসরপ্রাপ্ত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথের সাথে। তার বয়স কেবল চুরাশি। গালে গোলাপী আভা, ‘‘ওয়াও!এই বয়সেও এত সুন্দর রোজি চিক তোমার।’’ হাতের ওয়াইনের গ্লাস দেখিয়ে দুষ্টু হেসে সে বলল,‘‘ সবই এর প্রভাব।’’
তুমুল আড্ডা, ভোজ ও ফটোসেশনের পর বিদায় নেবার পালা। জ্যাকি একগাদা হাতে বানানো চকলেট কুকি ও নাম না জানা খাবার দিয়েছে, আগেকার দিনে বামুন ঠাকুরদের যেমন নিমন্ত্রণ খাওয়ানোর পর আবার ছাদা বেঁধে দেওয়া হত, অনেকটা তেমন। কেবল তফাতটা হল এই অধুনা বামনি নিজেই ছাদা বেঁধেছে জ্যাকির অনুরোধে।
এলিজাবেথ বলল ‘‘আই উইশ আই উইল মিট ইউ নেক্সট ইয়ার’’, আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘‘নিশ্চয় দেখা হবে, মনে রেখ তোমার বয়স মাত্র তের।’’
গাঢ় অন্ধকারে পাহাড়ী পথ ধরে বাসায় ফিরি, রাস্তায় কোন আলো নেই, গাড়ির সামনে যে কোন সময় হরিন এসে পড়লে সামাল দেওয়া মুশকিল হবে এই ভয়ে খুব ধীর গতিতে ফাহমিদ ড্রাইভ করে।
এখানে কেবল দু’দিন হালকা তুষারপাত হয়েছে। রোদ উঠলে ঘন্টা খানেক রোদে হাঁটি। পাশেই হাডসনের শাখা নদী বয়ে চলছে, খুবই নিরিবিলি পরিবেশ। দুপুরে হাঁটতে গেলে শুকনো পাতার সরসর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আর মাথার উপর উদাত্ত আকাশ। পাশের আপেল বাগান, ঘোড়ার আস্তাবল, দূরের ফার্ম সব মিলিয়ে অন্যরকম এক দৃশ্যকল্প।
বার্ড কলেজের পার্লামেন্ট অব রিয়েলিটি নামক স্থাপত্য দেখতে গিয়েছিলাম। কি অপরূপ, ছিমছাম, লেক ঘিরে এলোমেলো পাথরের স্থাপনা, তার চারপাশে উঁচু ঘাসের দেওয়াল, তাদের রঙ গেরুয়া ঠিক পাকা গমের শীষের মত। আসন্ন ক্রিসমাস ঘিরে অনেক অনুষ্ঠান চলছে, অতিথিরা এক ফাঁকে লেকে এসে দু’দন্ড কমলা মাছেদের ধীরলয়ের সাঁতার দেখে যাচ্ছেন।
এক ভদ্রলোক নিপাট ভালোমানুষের মত মুখ করে আমাকে বললেন,‘‘ তুমি যেন ওই ঠান্ডা পানিতে ঝাঁপ দিও না।’’ মাথা নাড়লাম, আবার জানতে চাইলেন,‘‘এখানে যে একটা সাদা বড় মাছ ছিল সে কোথায়?’’ আমি হাত দিয়ে ওপাশটা দেখালাম। তিনি এবার হেসে বললেন, ‘‘দেখেছ, সে আমাকে বলেনি সে যে লেকের ওইপাশে থাকবে।’’
বাতাসে হেমন্ত ও শীতের মাখামাখি কি অপরূপ এক সুগন্ধ, আমি খেজুরের গুড়ের, কাটা ঘাসের, সীম ফুল, লাল হলুদে মিলানো কাশি গাঁদা ফুলের কল্পিত ঘ্রান পাই। লেকে মাছের সাঁতার দেখতে দেখতে পুকুরের খলবলানো কই মাছ, শিংমাগুর আর রুই কাতলার লাফালাফি মনে পড়ে।
আরো মনে পড়ে রাজশাহীতে যখন থাকতে গিয়েছিলাম, অফিস থেকে ফেরার সময় এক ঘন্টার রিকশা যাত্রায় তিনটা পুকুর দেখতাম আকুল হয়ে। ধীরে ধীরে সে পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যায় চোখের সামনে। আব্বু দেশের বাড়ির পুকুর সংস্কার করেছেন বছর তিনেক আগে, যা অনেককাল পরিচিত ছিল রিপাদের পুকুর নামে। বেড়াতে গিয়ে দেখে এসেছি তার টলটলে রূপ।
জীবন তোমার কাছ থেকে যা কেড়ে নেয়, তা আবার ভিন্ন চেহারায় তোমাকে ফিরিয়ে দেয়। হোক সে মানুষ, বা ছেড়ে আসা সর্ম্পক কিংবা প্রকৃতি। এখানকার নদী, লেক, বড় বড় গাছ, মানুষেরা আমাকে কেবল সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। আমার ছোট্ট কাজিন আদিত যেন বলে উঠে, ‘‘রিপা আপু, ভয় পেয়ো না। আমি আছি, বড়মামা আছে। হর্স লাইট আছেনা ‘’ ও টর্চ লাইট বলতে পারত না।
ক্যাটসকিল পাহাড়কে বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় বলে ভ্রম হয়, আর আমি যেন সেই শংকর। পাহাড় আমাকে ডেকে বলে, ‘‘যাও রিফাত, যাও। এখন আর পিছু ফিরে তাকানোর সময় নেই তোমার।’’ আপেল বাগানের উপরের রোদমাখা কনকনে শীতল বাতাস মায়ের মমতায় বলে, ‘‘কোন ভয় নেই, এ যাত্রায় তুই নিজেই তোর সঙ্গী।’’
সমাপ্ত। ১৪ ডিসেম্বর, ২0২১
রিফাত ফাতিমা
জার্মানটাউন, নিউ ইয়র্ক’
যুক্তরাষ্ট্র।
আগের পর্ব:
অপরাহ্নের সামগীতি পর্ব-৫
ডিগজিয়ানির পুতুল, কার্বন ফুটপ্রিন্ট, সবুজ কুমড়ো আর দেয়ালে পেরেকের দাগগুলো
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই