‘একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না’
‘একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় [ছবি রোর বাংলার সৌজন্যে] |
সুনীলের প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ', বলাই বাহুল্য সে সময়ের তরুণ কবি তাতেই নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন যথার্থভাবে। তারও আগে কবিতাপ্রেমিকদের বছরের পর বছর কথা না রাখার আর্তি-আক্ষেপে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নীরার এই প্রেমিক। তিনি দুই বাংলায় তুমুল জনপ্রিয় ও সফল কবি ও ঔপনাস্যিক হলেও, জীবনভর শুধুমাত্র কবি পরিচয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন। তবুও কবি পরিচয়কে উজ্জ্বল রেখেই পাঠককে ডুবিয়ে রেখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধে। সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্টের লেখনিতেও ক্ষুরধার চরিত্র। ২০১২ সালের এইদিনটিতে তার প্রয়ান ঘটে। তাই শ্রদ্ধা অতল।
১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ফরিদপুরে এই সাহিত্যিকের জন্ম। পরিবারের সঙ্গে কলকাতা চলে যান মাত্র চার বছর বয়সেই। ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার ঠিক আগের বছর তিনি কবিতার পত্রিকা কৃত্তিবাসের সম্পাদনা শুরু করেন, যা পরে পরিণত হয় তখনকার তরুণ লেখকদের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে।
‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এই হাতে কোনো পাপ করতে পারি’
সুনীল বহুবার বলেছেন, কবিতাই ছিল তার প্রথম প্রেম। কবিতায় ভাঙতে চাইতেন সমাজ শ্রেণিবদ্ধতা, বিভাজন, ক্লেদ। আবার কবিতাতেই ছড়াতেন প্রেম আনন্দ।
তার প্রিয় বিষয়গুলোর একটি ইতিহাস। ঊনবিংশ শতকের পুনর্জাগরণে সময়টাকে নিয়ে সুনীল ইতিহাসের গৎবাঁধা কিছু লেখেননি। বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথের মতো কালজয়ী মানুষগুলোকে নিয়ে লিখেছে ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস। বিশেষ করে তার বিখ্যাত ত্রয়ী, সেইসময়-প্রথম আলো-পূর্বপশ্চিম জুড়ে বাংলার ইতিহাস উঠে এসেছে জীবন্ত হয়ে। অদেখা সময়কে পাঠক ছুঁতে পারেন এই ত্রয়ীতে। এই তিন উপন্যাস পরে ইংরেজি ভাষাতেও অনুদিত হয়।
‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ
তোর সঙ্গে জীবনবদল করে কোনো লাভ হবে না আমার’
লিখেছেন নীললোহিত, নীল উপাধ্যায় আর সনাতন পাঠক ছদ্মনামেও। এর মধ্যে নীললোহিতের জনপ্রিয়তা ঈর্ষনীয়। নিজের সমস্ত না বলা কথা তিনি বলে দিয়েছেন নীললোহিতকে দিয়ে। বেকার যে তরুণ ঘুরে বেড়ায় কলকাতার অলিতে গলিতে, যখন খুশি চলে যায় পাহাড়ে বা দিকশূণ্যপুড়ে। সর্বত্র যে বিলিয়ে যায় সহজ জীবন যাপনের মন্ত্র।
বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল সত্যজিৎ রায় সুনীলের লেখনি থেকে নিয়েছিলেন তার ছবির পটভূমি। মানিকবাবুর ত্রয়ী সিনেমার একটি 'প্রতিদ্বন্দ্বী'। সত্যজিতের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’- এটিও সূনীলের একটি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। সুনীলের জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ 'কাকাবাবু' জয় করে কিশোর পাঠকদের। এই সিরিজ থেকেও সুনীলের চলে যাবার পর সিনেমা তৈরি করেন প্রখ্যাত সিনেমা নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি। আর লালনকে নিয়ে লেখা সুনীলের ‘মনের মানুষ’ এর চলচ্চিত্রায়ন করেছেন গৌতম ঘোষ।
তার আত্মজীবনীমূলক লেখা 'অর্ধেক জীবন'। তার জীবনের তিনটি দশকের বহু ঘটনা এতে আছে। এই লেখা নিয়ে লেখকের নিজস্ব কথা হলো- 'নিজের সব কথা তো আর মানুষকে বলা যায় না। এ জন্যই আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলাম অর্ধেক জীবন। এর মানে এটা নয় যে আমি আমার অর্ধেক জীবনের গল্প বলেছি সেখানে। আমার জীবনের যেসব গল্প মানুষকে বলা যায়, সেগুলোই আমি বলার চেষ্টা করেছি।'
দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা সুনীল ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন স্বাতী বন্দোপাধ্যায়কে। জীবিকার জন্য সুনীল পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। ভারতের সর্বাধিক পঠিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতের জাতীয় সাহিত্যপ্রতিষ্ঠান সাহিত্য আকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসেবেও। বরেণ্য এই কথা সাহিত্যিককে ২০০২ সালে সাম্মানিক পদ ‘কলকাতার শেরিফ’ হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল তরুণ সুনীলকে। ১৯৭১ সালের সেই দিনগুলোয় বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে তিনি কলম চালিয়েছেন জন্মস্থানের মানুষের পক্ষে। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে দুই দফা আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, ২০১১ সালে দ্য হিন্দু লিটারেরি পুরস্কারসহ জীবনভার বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন।
জীবনকে নানা দিক দিয়ে নানাভাবে উল্টেপাল্টে দেখেছেন সাহিত্যিক সুনীল। চাইতেন জীবন আর সাহিত্যকে প্রচণ্ডভাবে উপভোগ করতে। কিন্তু চলে যেতে হয়.. তাই জীবন মৃত্যুর মাঝে অচ্ছেদ্য রেখাটি বিলীন করে চলে যান ২০১২ সালের আজকের দিনে।
‘নিজের কানে কানে’ কবিতায় তিনি বলেছেন-
এক এক সময় মনে হয়, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।
এক এক সময় মনে হয়,
পৃথিবীটাকে দেখে যাবো শেষ পর্যন্ত!
লিখেছেন-
সন্ধের আকাশ কী অকপট, বাতাসে কোনো মিথ্যে নেই,
তখন খুব আস্তে, ফিসফিস করে, প্রায়
নিজেরই কানে-কানে বলি,
একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না!
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই