বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ || ১১ পৌষ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩৩

খ ম হারূন

১৩:৫৪, ১৫ জুলাই ২০২১

আপডেট: ১৮:০৪, ১৫ জুলাই ২০২১

১৭৯৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩৩

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।

[পর্ব-৩৩]


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যখন থেকে শুরু (১৯৭০) তখন থেকে আমার যে দু-চারজন সহপাঠির সাথে গভীর বন্ধুত্ব ছিলো এবং যাদের সাথে কখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি তাদের অন্যতম বন্ধু জহির আহমেদ। প্রথমেই সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণ উৎসবে টিএসসিতে হেমন্ত মুখাপাধ্যায়ের গান পরিবেশন করে। সে সময়ে বটতলা, টিএসসি বা কার্জন হলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে পরিবেশন করতো গণসঙ্গীত। আমাদের ক্লাসে বেশ ক’জন সঙ্গীত শিল্পী ছিলো। আমাদের বিভাগের শিক্ষক ড. রব একদিন আমাদের কয়েকজনকে তার রুমে ডেকে বললেন, ‘আগামীকাল সকালে তোমাদেরকে নিয়ে আমি মৌচাক যাবো পিকনিকে। ভোর সাতটার মধ্যে তোমরা কলাভবনের সামনে বটতলায় চলে আসবে।’ একজন শিক্ষক আমাদের নিয়ে পিকনিকে যাবেন, আমাদেরতো আনন্দের সীমা নেই। সময়টা ছিলো শীতকাল। সম্ভবত ১৯৭১ এর জানুয়ারি। ঐ শীতের মাঝেই ভোরবেলা কলাভবনে চলে এলাম সবাই। জহির পাজামা-পাঞ্জাবীর ওপর একটা সোয়েটার পরে এসেছিলো, সাথে ঘিয়ে রঙের চাদর। আমার একটা ডোরাকাটা সোয়েটার। সেই পিকনিকে জহির ও বন্ধুরা পরিবেশন করেছিলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালেবাসি’ গানটি। তখনো জানতাম না এই গানটিই হতে যাচ্ছে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। 

সঙ্গীতের ভুবন থেকে একসময় জহিরকে আবিষ্কার করলাম রাজপথে। মিছিলে। স্বাধীনতার জন্য উত্তাল ছিলো সে সব মিছিল। তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময় সাময়িকভাবে আমাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিলোনা। 

জানুয়ারি ১৯৭২, আবার যখন ফিরে এলাম প্রিয় ক্যাম্পাসে জহিরকে খুঁজে পেলাম ক্লাসে। সবার মাঝে কতো পরিবর্তন। এই দশ মাসে এক একজন অন্য মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নতুন মানুষ। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। আমি তখন সূর্যসেন হলের ৪৩৩ নাম্বার রুমে থাকি। জহির থাকতো নিজেদের বাড়িতে পুরোনো ঢাকায়। দুপুরে ক্লাস শেষে সে আমার রুমে চলে আসতো। বিকেলে প্রায়ই তার রিহার্সেল থাকতো টিএসসিতে। রিহার্সেল শেষ করে সে চলে যেতো তোপখানা রোডে উদীচী’র কেন্দ্রিয় কার্যালয়ে। নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে তার ব্যস্ত সময় কাটতো।

১৯৭২ এ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র প্রতিষ্ঠিত হয় ডাকসুর উদ্যোগে, আমি তখন নাট্যচক্রের সাথে যুক্ত হলাম। নাট্যচক্রের অফিস ছিলো কলাভবনের নীচ তলায়, ডাকসু কার্যালয়ে। নাট্যচক্রের বিভিন্ন প্রযোজনা, আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন সবকিছুর সাথে আমি যুক্ত, তাই কাজের প্রয়োজনে ডাকসু কার্যালয়েই বসতাম। কাছাকাছি সময়ে উদীচী’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হলেন সাহিত্যিক কমরেড সত্যেন সেন, সেন্টু রায় সাধারন সম্পাদক। জহির আহমেদ ওই কমিটির সঙ্গীত সম্পাদক এবং ছড়াকার আখতার হুসেন সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ওই কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন রনেশ দাশগুপ্ত, হায়াৎ মামুদ, গোলাম মুহাম্মদ ইদু, পান্না কায়সার। আমিও মাঝে মধ্যে চলে যেতাম উদীচী কার্যালয়ে। সাহিত্যিক সোমেন চন্দ-এর একটি গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন আখতার হুসেন। আমি সেখানে অভিনয় করি। ঐ অভিনয়ের সূত্রে কমরেড সত্যেন সেন এর সাথে পরিচয়। তাঁর বাসাতেও গিয়েছিলাম। টোস্ট বিস্কুট আর লাল চায়ের কথা এখনো মনে আছে। সত্যেনদা নিজ হাতে চা বানিয়েছিলেন।

একদিন দুপুরে হলে নিজ রুমে বসে পড়াশুনা করছি। নানা ধরনের কাজের সাথে জড়িত হবার কারনে পড়াশুনার সময় বের করা বেশ মুশকিল ছিলো। যদিও সংগঠনের নির্দেশ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে হবে। টিএসসিতে যেতে হবে। বিকেলে নাটকের মহড়া আছে। এমন সময় রুমে প্রবেশ করলো আমার ক্লাসের তিন বন্ধু। জহিরের সাথে এসেছে উদীচী’র সেন্টু রায় ও ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল ইসলাম। মতিউলের পিতা তখন রাজবাড়ী থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য। পিতা আওয়ামী লীগ করলেও মতিউল ছাত্র ইউনিয়নের একজন প্রথম সারির নেতা। আমি, জহির, সেন্টু ও মতিউল একই আদর্শের ছাত্র রাজনীতি করি। আমাদের টিউটোরিয়াল ক্লাসও একইসাথে। ক্লাসে সবাই আসলেও সেন্টু রায় প্রায়ই অনুপস্থিত থাকতো। সে সাংগঠনিক কাজে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতো। 

১৯৭৩ এর ১ জানুয়ারি। ভিয়েতনাম সংহতি দিবস। এই দিনে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মসূচি দিয়েছে। বিকেলে সবাই হাজির থাকবে কলাভবনে প্রাঙ্গণে। সেখান থেকে মিছিল যাবে মতিঝিল আমেরিকান দূতাবাস অভিমুখে। মিছিলের মূল দাবি ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর বোমাবর্ষণ বন্ধ করতে হবে। সেদিনের কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। সামনের সারিতে ছিলেন মাহবুব জামান, কাজী আকরম হোসেন, অজয় দাশ গুপ্ত, কামরুল আহসান খান। আমি কলাভবন থেকে সেদিনের মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম বন্ধু মতিউল ইসলাম ও জহির আহমেদকে সাথে নিয়ে।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তার লেখায় সেদিন মিছিলের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এখানে উল্লেখ করছি। 

“আমার সভাপতিত্বেই সেদিন বটতলার সভা অনুষ্ঠিত হয়। বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও বক্তৃতা শেষে মিছিল রওনা হয় মতিঝিলের আদমজী কোর্টস্থ আমেরিকান দূতাবাস অভিমুখে। দোয়েল চত্বর, শিক্ষা ভবন, হাইকোর্ট মোড়, কদম ফোয়ারা পার হয়ে মিছিল ডানদিকে মোড় নেয়। সেসময় দেখা গেল ইউএসআইএস বিল্ডিংয়ের সামনে (বর্তমানে প্রেসক্লাবের ঠিক উল্টো দিকের ভবনটি) বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন হয়ে আছে। ওদের হাতে হাতে রাইফেল, এলএমজি, স্টেনগান। পুলিশ দেখে মিছিলের শ্লোগান আরো উচ্চকিত হল। মিছিল এগিয়ে যেতে থাকল সামনের দিকে। পুলিশ তাদের জায়গা থেকে নড়চড় করল না। মিছিলের অগ্রভাগ তখনো ইউএসআইএস-এর রাস্তার মুখ অতিক্রম করেনি। এমন সময়ই অতর্কিতে শুরু হয়ে গেল পুলিশের গুলিবর্ষণ। এর আগে মিছিল থেকে একটা ঢিলও পড়েনি। উচ্চ-শ্লোগান দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল এগিয়ে যাচ্ছিল। কোথাও ১৪৪ ধারা জারি নেই, কোনো সতর্কবাণী নেই, কোনো লাঠিচার্জ নেই, কোনো টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ নেই। একেবারে শুরু থেকেই গুলিবর্ষণ। শত শত রাউন্ড গুলি। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। কেউ কেউ দৌড়ে প্রেসক্লাবের ভিতরে ঢুকে যায়। অন্যরা বর্তমান কদম ফোয়ারার চত্বরের দিকে, সচিবালয় সহ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। খই ফোটার মতো মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে সবাই বিস্মিত, আতঙ্কিত। কি হয়েছে জানার জন্য সবাই তখন উদগ্রীব। ইতোমধ্যে গুলিবর্ষণ শেষ হয়েছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা অবশিষ্ট নেতাকর্মীদের উপর রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে তাদেরকেও সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। আমার কাঁধেও রাইফেলের আঘাত লেগেছিল। তার দাগ এখনো আছে। কিন্তু পুলিশের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েই হাজার কণ্ঠে শ্লোগান উঠলো- ছাত্র হত্যার বিচার চাই। পরিস্থিতি একটু স্থিত হলে দেখা গেল রাস্তায় লুটিয়ে আছে আট-দশজন ছাত্র। পুলিশ ইউএসআইএস এর গেইটে শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা এগিয়ে গেলাম পড়ে থাকা ছাত্রদের দ্রুত উদ্ধার করতে। আহত দশ-বারো জনকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘটনাস্থলেই দু’জন মৃত্যুবরণ করেন। হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার দু’জনকেই মৃত ঘোষণা করলেন। এরা হলেন জহুরুল হক হলের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মীর্জা কাদেরুল ইসলাম। আহতদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল পরাগ মাহবুব। বুলেটের আঘাতে তাঁর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আবুল কাসেমের হাতের তালু ও বাহু ভেদ করে চলে যায় বুলেট। এরকম আরো আহত হয়েছিলেন ফরিদ হোসেন, আমিরুল ইসলাম, সুলতান আহমেদসহ অনেকেই। পুলিশের বর্বর গুলিবর্ষণে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে শহীদদের লাশ কাঁধে নিয়ে শুরু হলো মিছিল। সেই মিছিলে সোচ্চার প্রতিবাদে যোগ দিল ঢাকার বীর জনতা। বেরিয়ে পড়ল সাংবাদিকরা। বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল প্রেসক্লাবও। আহত হয়েছিল বাংলার বাণীর ফটোসংবাদিক রফিকুর রহমান।’’

ঐ মিছিলেই আমি হারালাম আমার বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউলকে। আমরা কলাভবন প্রাঙ্গনে মতিউল ও মীর্জা কাদের এর লাশ নিয়ে আসলাম। রাতেই মতিউলের বাবা ঢাকায় পৌঁছালেন ছেলের লাশ নিতে। একজন সংসদ সদস্য হবার পরও সেদিন দেখেছিলাম পিতার অসহায় চেহারা। পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ।

জহির আহমেদ, সেন্টু রায় ও আমি- একজন বন্ধু হারালাম। ঐ মিছিলে আমার পাশেই ছিলো মতিউল, গুলি শুরু হবার পর আমি ক্রলিং করে প্রেস ক্লাব চত্বরে ঢুকে যাই। একটা গাছের আড়ালে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করি। এই গুলির মাঝেই দেখতে পাই মতিউল দু হাত বাড়িয়ে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভাইকে আঘাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে নিজে বাঁচতে পারিনি।

আমি মনে করি সেদিনকার সেই ঘটনা ছিলো একটি ষড়যন্ত্র। খন্দকার মোশতাক আহমেদ তখন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার একজন ক্ষমতাবান মন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করছিলেন তিনি। একই সাথে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধেও তার ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই আমি ও জহির সিদ্ধান্ত নেই এলএলবি পরীক্ষা দেবার। সূর্যসেন হলে আমাদের প্রভোস্ট ছিলেন প্রফেসর এল কবির। তিনি আইন অনুষদেরও ডিন। তাঁকে গিয়ে বলি ‘স্যার আমরা ল তে ভর্তি হতে চাই।’ তিনি খুশী মনে আমাকে একটা চিঠি লিখে দিলেন সেন্ট্রাল ল কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর। ভর্তি হয়ে যাই। অনার্স পরীক্ষার পরপরই ১৯৭৫ এর শেষ দিকে এলএলবি প্রথম পর্বের পরীক্ষা দেই এবং ভালো রেজাল্ট করি। কিন্তু ১৯৭৬ এ ফাইনাল পর্বের পরীক্ষার আগেই আমি দিল্লি চলে যাই। এমএ পরীক্ষা দিতে পারলেও এলএলবি আর সম্পন্ন করা হয়নি। কথা ছিলো তিন বছর পর ফিরে এসে ফাইনাল পরীক্ষা দেবো। কিন্তু বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করার কারনে তা আর সম্ভব হয়নি। তবে বন্ধু জহির এর মধ্যে ল ডিগ্রী অর্জন করেছে। আমি যখন বিটিভিতে অনুষ্ঠান প্রযোজনা করি সে আমার অনেক অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলো। প্রায়ই আমার বাসায় আসতো। এসেই জেবুর হারমনিয়াম নিয়ে গান শোনাতে বসতো। গণসঙ্গীতের পাশাপাশি হেমন্ত, শ্যামল, সতীনাথ-এর গান তার মুখস্তই থাকতো। 

১৯৮২ সালে জহির বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে যোগদান করে। তারপর ঢাকার বাইরে। একবার আমি খুলনায় গেছি ছুটিতে। একদিন দেখি জহির আমাদের বাড়ীতে এসেছে আব্বা-আম্মার সাথে দেখা করতে। আমিও যে সে সময় খুলনাতে, জহির জানতো না। ওর তখন পোস্টিং যশোরে। সারাদিন একসাথে কাটিয়ে জহির বিকেলে যশোর চলে গেলো। ও যখনই ঢাকায় আসতো যোগাযোগ করতো। ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করার আগে সে কুমিল্লার জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তখন আমাদের বন্ধুদের সে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তাঁর কুমিল্লার বাসায় একটি গেট টুগেদার করার। শেষ পর্যন্ত আর সেখানে যাওয়া হয়নি।

১৯৯৯ সালের জুনে আমি এক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাই। আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে। ডালাসে তিন দিনের সম্মেলন। ঢাকা থেকে আমি ছাড়াও গিয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ ও সাহিত্যিক মাহবুব তালুকদার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে নাট্যকার বাদল সরকার ও লেখক সমরেশ মজুমদার। যুক্তরাজ্য থেকে সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ও সাহিত্যিক কেতকী কুশারী ডাইসন সহ অনেকেই ছিলেন। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন থেকেও অনেকেই এসেছিলেন। তার মধ্যে বন্ধু সাংবাদিক আব্দুল মালেক ও ইকবাল বাহার চৌধুরী ছিলেন। অনেক সঙ্গীত ও নৃত্য শিল্পীদের অংশগ্রহণ ছিলো। জুয়েল আইচ তখন যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছিলো। আব্দুল মালেক আমাকে এমনভাবে এয়ার টিকিট স্পনসর করে দেন যাতে আমি যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু শহর ঘুরে দেখতে পারি। ডালাসের সম্মেলনটি আমার কাছে ছিলো অত্যন্ত গৌরবময়। বিশ্বনন্দিত বাংলা সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয় সে সময়। 

ডালাস থেকে আমি একা যাই লস এঞ্জেলসে। এয়ারপোর্টে জুয়েল আইচের ছোটো ভাই শংকু আইচ এসেছিলো আমাকে নিতে। তার বাসাতেই কয়েকদিন ছিলাম। অভিনেতা ও মাইমশিল্পী কাজী মশহুরুল হুদা সহ অনেকের সান্নিধ্য পাই সেখানে। শংকুর সাথে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে বেশ কটি শো দেখি। তার গাড়ি নিয়ে আমরা যাই লাস ভেগাস। নেভাডা মরুভূমির মধ্য দিয়ে এলএ থেকে লাস ভেগাস ভ্রমণ ছিলো অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা। 

লস এঞ্জেলস থেকে চলে আসি নিউ ইয়র্ক। বিমান বন্দরে আব্দুল মালেক ছিলেন। সেখানে যে ক’দিন ছিলাম, তার বাসাতেই ছিলাম। নিউ ইয়র্কে ঠিকানা পত্রিকা থেকে আমাদের সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। অনেক পরিচিত মুখের উপস্থিতি, অনেক সুন্দর মুহুর্ত। 

বন্ধু সেন্টু রায় ও তার স্ত্রী জেসমিন সেসময় ওয়াশিংটনে ছিলো। আমি নিউইয়র্ক এসেছি শুনে সে আমাকে জানায় কোনোভাবেই আমি তার বাসায় দুদিন না থেকে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে পারবোনা। প্রয়োজনে সে নিজে এসে আমাকে ওয়াশিংটন নিয়ে যাবে। অতঃপর আমি নিজেই চলে গেলাম। তার সাথে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেছি। ওয়াশিংটন আসার পর একদিন সরকার কবিরউদ্দিনকে ফোন করি। সরকার ফিরোজউদ্দিনের বড় ভাই। সেই সূত্রে পরিচয় ছিলো। সরকার ফিরোজ বিটিভিতে আমার সহকর্মী, ধানমন্ডি ৭ নং রোড়ের সরকারি বাসভবন ‘কোনার্ক’ এ আমি ছিলাম নীচতলায় আর ফিরোজ ভাই দোতলায়। আমেরিকা থেকে দেশে আসলে সরকার কবির ‘কোনার্ক’এ নিজ ভাইয়ের বাসাতেই উঠতেন। কবির ভাই ভয়েস অব আমেরিকা’র কার্যালয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানান। একটি সাক্ষাৎকারও নেন। ওয়াশিংটন থেকে এরপর আমি যাই রিচমন্ড, আমার এক বোনের বাসায়। তারপর সেখান থেকে ফিরে আসি নিউ ইয়র্ক।

২০০৯ সালে জহির আহমেদ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। একবার আমি ও সেন্টু রায় গিয়েছিলাম হাইকোর্টের পুরাতন ভবনে তার সাথে দেখা করতে। বছর তিনেক ওখানে দায়িত্ব পালনের পর সে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে আমাদের আরেক বন্ধু ও সহপাঠি কানিজ খান ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। সে বিভিন্ন দেশে ঐ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেছে। কানিজের স্বামী আলোক ভাই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক বছরের সিনিয়র। ঢাকায় একা থাকতেন তিনি। গুলশানে বাসা। কোনো সন্তান নেই। কানিজ চেয়েছিলো অবসরের পর তারা দুজন দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে। আমাদের একটা ছোটো গ্রুপ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সাত আটজন বন্ধুর। আমরা প্রতিমাসেই কারো না কারে বাসায় একত্রিত হতাম। হঠাৎ শুনলাম কানিজ ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে তার মনোবল ছিলো প্রচণ্ড। সে শ্রীলংকা এবং  আফিকার বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাধারন মানুষদের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করেছে। সে যখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তখন তাকে দেখতে গিয়েছি। কেমন আছো প্রশ্ন করলে বলতো ভালো আছি, তোমরা ভালো থেকো।

৩ জানুয়ারি ২০১৮, সকালে আলোক ভাইয়ের ফোন। একটাই কথা বললেন, তোমাদের বন্ধুতো নেই। আলোক ভাই একা হয়ে পরলেন। কিন্ত খুব বেশীদিন তাকে একা থাকতে হয়নি। ২০২১ এর ২৩ এপ্রিল আলোক ভাই  করোনায় আক্রান্ত হয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে যান।

আবার আসি জহির আহমেদ এর কথায়। করোনাকালে প্রায়ই সে কথা বলতো, সবার খোঁজ খবর নিতো মোবাইলে বা ম্যাসেঞ্জারে। এই সময় নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতো। তার আক্ষেপ, কারো সাথে দেখা হচ্ছে না। আড্ডা হচ্ছে না। প্রায়ই আপনজনদের কেউ না কেউ চলে যাচ্ছে আমাদের ছেড়ে। এর মাঝে ১৩ জুলাই ২০২১ বিকেলে বন্ধু মনসুর ফোন করে বললো, ‘হারূন তুমি কি টিভি দেখেছো, স্ক্রল যাচ্ছে, বিচারপতি একেএম জহির আহমেদ আজ দুপুরে সিএমএইচ এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। হারূন এই জহির কি আমাদের জহির।’ কিছুক্ষন পর সেন্টু রায়ের ফোন। সে উদীচী থেকে খবর পেয়েছে। সেন্টু বললো, ‘হারূন আমিও করোনায় আক্রান্ত। ঢাকার একটা হাসপাতালে আছি। ভেবেছিলাম আমিই আগে চলে যাবো তোমাদের ছেড়ে, কিন্তু জহির আগে চলে গেলো। আমি মেনে নিতে পারছিনা।’ সেন্টুর কান্নার শব্দ ভেসে ভেসে আসছে আমার কাছে।

এখানে ছবির একটি ১৯৭৬ সালের যখন আমরা সদ্য এমএ পরীক্ষা দিয়েছি। পরবর্তি ছবিটি তার ৩৬ বছর পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে। একই স্থানে আমাদের আরেকটি ছবি তোলার ইচ্ছে ছিলো, হলোনা। 

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব  ১

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank