এই মানুষগুলি এমনই হয়!
এই মানুষগুলি এমনই হয়!
মুখে তাঁর হাসি নেই
ভালোবাসাবাসি নেই
চিন্তার রেখা থাকে তাঁর চোখে মুখে
চান তিনি সকলেই থাক খুব সুখে।
কার কথা বলছি বলুন তো? ঠিক ধরেছেন, বলছি বাবার কথা, বাবাদের কথা। চলুন না আজ বাবাদের নিয়ে গল্প করি। যদিও আমার খেজুরে আলাপে বাবাদের নিয়ে গল্পটা ঠিক জমবে না। হয়তো বা বাবাদের মতোই রসকষহীন হয়ে উঠবে। কিন্তু বাবাদের নিয়ে একটু গল্প তো করাই যেতে পারে। কাল যেহেতু বাবা দিবস, আজ তাই বাবাদের নিয়েই কিছু শোনা যাক।
অনেক খুঁজে টুজে দেখলাম আমার বাবাকে নিয়ে মজা করে বলার মত গল্প একেবারেই নেই। আমি জানি আপনাদেরও খুব একটা নেই। তবে বাবাদের নিয়ে বলার মতো অনেক কিছুই আমাদের আছে। তবে সবই হয়তো খুব সিরিয়াস টাইপের। আসুন, আমার বাবার কথা বলার আগে আমার এক বন্ধুর বাবা সম্পর্কে একটা ছোট্ট একটা গল্প শুনি।
আমার এক বন্ধু ছিল রতন। ওদের বাড়ির দক্ষিণে ছিল ওদের বাংলা ঘর। ওরা অনেকগুলো ভাইবোন কিন্তু বাংলা ঘরটা ছিল ওর দখলে। এই ঘরে বসে রাজত্ব করতো রতন। বন্ধুদের আড্ডা হত এই ঘরে। অসম্ভব এক মজার মানুষ ছিল রতন। তো রতন প্রস্তাব করল, চল সবাই যাত্রা দেখতে যাই। মহজমপুর মেলায় যাত্রা হচ্ছে। মহজমপুর মেলা আমাদের সোনারগাঁ এলাকায় খুবই প্রসিদ্ধ। প্রতি বছর বাংলা মাঘ মাসে চান্দ্র মাসের ১১ তারিখে এখানে ওরশ হয়। শাহ লঙ্গর নামে এক দরবেশের দরগাহ এখানে। এই দরবেশের নামে উরস। দোয়া-দরুদের পাশাপাশি সেই ওরশে হয় ঝুমুর ঝুমুর নাচের যাত্রা। কী কনট্রাস্ট!
সকালে মাইকিং করে গেছে সারা এলাকায়, আজ রাতে অনুষ্ঠিত হবে যাত্রা পালা, গুনাই বিবি। সেই সাথে থাকবে ডানাকাটা পরীদের ঝুমুর ঝুমুর নাচ। নাচবেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী ড্যান্সার প্রিন্সেস রত্না। যাত্রার সব ড্যান্সারদের নাম মনে হয় রত্নাই হয়!
তো যেই কথা সেই কাজ। রাত ১০টায় রতনদের বাড়িতে সবাই হাজির। গ্রাম এলাকা। রাত দশটায় সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। পড়াশোনার নাম করে যারা শীতকালে যাত্রা টাত্রা দেখতে যায় তারাই শুধু জেগে থাকে। রাত দশটা এগারোটার দিকে হারিকেনের আলো একেবারে কমিয়ে, কোলবালিশ টাইপের কিছু একটা লেপের নিচে রেখে ঘর থেকে আস্তে করে বেরিয়ে পড়ে। বালিশ ও লেপটাকে এমনভাবে রাখা হয়, যা দেখলে মনে হয় একটা মানুষ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রতনের বাবা ছিল খুবই কড়া টাইপের মানুষ। পড়াশোনার ব্যাপারে কোন ছাড় নেই। মাগরিবের আজানের সাথে সাথে সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। আজানের পর বাইরে থাকলে তার খবর আছে। সন্ধ্যা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত পড়তে হবে। তারপর রাতের খানা। রাতের খাবারের পর কমপক্ষে আরো একঘন্টা পড়তে হবে। ওদের সবই চলে রুটিন ধরে। এত কড়াকড়ির মধ্যেও রতন হেন কোন কাজ নেই করে না। কারো গাছের ডাব পাড়া থেকে শুরু করে যাত্রা দেখা পর্যন্ত। কিন্তু লেপ-বালিশের এই ঝাড়িজুড়ি বুঝে যান রতনের বাবা। ছেলে যে ঘরে নেই এটা বুঝে তিনি এক বদনা পানি নিয়ে বিছানার শোয়ার জায়গা খানিকটা ভিজিয়ে দেন। সকালে বাড়ি আসার পর শুতে গিয়ে রতন মিয়া টের পায় বিছানা ভেজা। কোন রকমে চৌকির একপাশে শুয়ে পড়ে। একটু পর তার বাবা আসে বাংলা ঘরে। রতনের ঘুম কেমন হল এটা সেটা জিজ্ঞেস করে। তারপর জানতে চায়, তোমার বিছানা ভেজা কেন? এত বড় হইছ, এখনো বিছানায় পেশাব কর! আজ রাত থেকে তুমি আর বাংলা ঘরে ঘুমাইবা না। বড় ঘরে মায়ের বিছানার কাছে মাটিতে বিছানা করে ঘুমাইবা। রতনের সারা জীবনের যাত্রা দেখার কাজ সারা।
আমার বাবা কড়া মানুষ ছিলেন না মোটেই। তিনি ছিলেন খুবই সাদামাটা মানুষ। দুনিয়ার মোহ তাঁকে কখনো আচ্ছন্ন করেনি। তার প্রিয় ফুল ছিল গন্ধরাজ। বৃষ্টির দিনে প্রায়ই একটা গন্ধরাজ ফুল থাকত তাঁর হাতে। হয়তো বা প্রিয় রং ছিল হালকা নীল। দুটো পাঞ্জাবির বেশি কখনো দেখিনি আমরা। তার মধ্যে একটা থাকত হাল্কা নীল। পছন্দের খাবারের তালিকায় ছিল গরুর ঝুরা মাংস আর ছোট মাছের দোপেঁয়াজা। যারপরনাই তার প্রিয় ছিল আম। সকাল বিকাল আম আর মুড়ি খেতে পছন্দ করতেন। ফুটবল খেলা দেখতে পছন্দ করতেন। ছাত্র জীবনে নাকি খুব ভালো ফুটবল খেলতেন শুনেছি। একবার আমার নানাবাড়ির এলাকায় গিয়েছিলেন ফুটবল খেলতে। আমার নানা সাহেব নাকি তখনই পাত্র পছন্দ করে রেখেছিলেন। হবেই না কেন। অত্যন্ত সুন্দর ছিলেন দেখতে। উন্নত নাক, লম্বা একহারা শরীর আর অনেক ফর্সা একজন মানুষ। আমরা ছয় ভাইবোন একজনও বাবার মত দেখতে হইনি।
এসব পছন্দের কথা তিনি কখনোই বলেননি, কিন্তু বুঝতে পারতাম। মানুষকে অনেক অনেক ভালোবাসতেন বাবা। তাঁর বন্ধু ছিল অনেক। তাঁর বন্ধু তালিকায় কোন জাতপাত ছিল না। হিন্দু-মুসলিম সবার সাথেই তাঁকে চলাফেরা করতে দেখেছি। সবার বিপদে এগিয়ে যেতেন। আমাদের পাশের পাড়াতে আমার অনেক জুনিয়র একটা ছেলে ছিল। নাম গোঁসাই সাহা। ওর এসএসসি পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি ইত্যাদি নানা কারনে বাবাকে এত দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছি তার অর্ধেকও সম্ভবত নিজের সন্তানদের জন্য করেননি। ওনার এক ‘উকিল মেয়ে’ ছিল। বাবার কাছে সেই মেয়ে ছিল আমাদের থেকেও প্রিয়। সেই উকিল মেয়ের এক কন্যার নাম নাজমা। নাজমার লেখাপড়ার জন্য তিনি কী যে খেটেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। স্কুল, কলেজ, চাকুরীর ইন্টারভিউ সব কাজে তিনি যেতেন। এসব আমাদের ভালোই লাগত। বাবা মাছ ধরতে পছন্দ করতেন। বাবার নিজস্ব ছিপ ছিল। আর ছিল একটা টেটা। প্রতি বছর এই বর্ষার সময়টাতে আমাদের সোনারগাঁ এলাকার খালে পানি আসত। খাল উপচে সেই পানির জোয়ারে ভেসে যেত ধান খেত, পাট খেত। বাবাকে দেখতাম, রাতের খাবার খেয়ে টেটা আর একটি তিন ব্যাটারির লাইট নিয়ে বেড়িয়ে যেতেন। লাইটের নাম ছিল এভারেডি। তিনটি চান্দা ব্যাটারী ভরতেন। আমারা লেখাপড়া শেষ করে ঘুমিয়ে যেতাম। তখনো বাবা ফিরতেন না। বাবা নাকি ফিরতেন অনেক রাত করে। ডুলা ভর্তি করে মাছ নিয়ে ফিরতেন। বাঁশ দিয়ে তৈরি মাছ রাখার এক ধরণের ঝুড়িকে আমাদের এলাকায় বলে ডুলা। কোনো কোনো দিন একদমই মাছ পেতেন না। এসে আক্ষেপ করে বলতেন, ব্যাটারির পয়সাও উঠল না।
বড়শি দিয়ে কই মাছ ধরতে বাবার কোন জুড়ি ছিল না। আমার মনে হতো, কই মাছ ধরতে বাবার চেয়ে পারদর্শী আর কেউ নেই। ভাদ্র মাসে ছোট্ট কোষা নৌকা করে দুটো ছিপ নিয়ে বিকালে বিলের দিকে যেতেন বাবা। সন্ধ্যায় ডুলাভর্তি কই মাছ নিয়ে ফিরতেন। আমি একদিন সাথে গিয়েছিলাম বাবার মাছ ধরা দেখতে। অনেকটা নিপুন শিল্পীর মতো বড়শি ফেলতেন বাবা। সেদিন খেয়াল করে দেখেছি, ছোট মাছ উঠলে পানিতে ছেড়ে দিতেন। শুধু বড় মাছগুলি ঝুড়িতে রাখতেন। বাবাকে কখনো সামান্য লোভ করতে দেখিনি। কখনো অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করতে দেখিনি। কখনোই মানুষের গীবত করতে দেখিনি। আমাদের একদিন অনেক টাকা হবে, এমন কোন চিন্তা করতেও দেখিনি বাবাকে। তিনি কথা কম বলতেন। একটু রাগী রাগী ভাব থাকত তাঁর চেহারায়। সবার বাবার মত। যখন একটু হাসতেন, তখন একটা বেহেস্ত আমাদের সামনে এসে হাজির হত।
সন্তানদের প্রতি কখনোই কোন উচ্চাশা করতেন না বাবা। কিন্তু সন্তানদের সাফল্যে যারপরনাই খুশি হতেন। আমি এসএসসি পাশ করার পর জনে জনে বলছেন, আমার ছেলে কিন্তু অনেক নম্বর নিয়ে পাশ করছে। যদিও আমি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছিলাম। এইচএসসি’র রেজাল্ট বের হবার পর আমার ভীষণ মন খারাপ। ফলাফলের তালিকায় আমার রোল নম্বর নেই। তখনকার সময়ে দৈনিক পত্রিকায় রেজাল্ট ছাপা হত। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার দাম বেড়ে যেত রেজাল্টের দিন। বাবা আগে থেকেই পত্রিকাওয়ালাকে বলে রেখেছেন ইত্তেফাক দেয়ার জন্য। রেজাল্ট বেরিয়েছে। রেজাল্টে আমার রোল নম্বর নেই। ঢাকা বোর্ড, কলা বিভাগ, কেন্দ্র বৈদ্যেরবাজার, পাশকৃতদের তালিকায় আমার রোল নম্বর নেই। নেই তো নেই। বাবা আরো দুয়েকটা পত্রিকাও দেখেছেন। কোথাও আমার রোল নম্বর নেই। আমার বিপর্যস্ত অবস্থা। একদিন পার হয়ে গেল। কোথাও থেকে কোন খবর পেলাম না। আমার সাথে যারা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছে তারা মিষ্টি বিলিয়েছে এর মধ্যে। আমি অনেক ভেঙে পরেছি। আমার ফেল করার কোন কারনই থাকতে পারে না। তখনকার সময়ে পাশের হার ছিল শতকরা ৩০-এর আশেপাশে। আমাদের সময়ে সম্ভবত এইচএসসি’র পাশের হার ছিল ২৮%। তাই কেউ কেউ এসে বাবাকে বুঝাচ্ছে, শোনেন মিয়াভাই, একশজনের মধ্যে বাহাত্তর জন ফেল। ফেল করতেই পারে। চিন্তা না করে আগামী বছরের জন্য তৈরি হতে বলেন। কিন্তু ছেলের ওপর বাবার আস্থা এত বেশি তা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। বাবা কলেজে গেলেন। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করতে। প্রয়োজনে খাতা চেক করাবেন। যেই মানুষ ছেলে ঠিকমত পড়ে কি না তার খবর কোন দিন নেননি, তিনি গেছেন খাতা চেক করাতে। বিকালে জিলিপির প্যাকেট হাতে বাড়ি ফিরলেন। হাসি হাসি মুখ। আমাকে শুধু তিনটা শব্দ বললেন, সেকেন্ড ডিভিশন পাইছস। পকেটে নিশ্চয়ই মিষ্টি কেনার টাকা ছিল না। তাই জিলাপি কিনেছেন। বাড়িতে আর সময় দিলেন না। বাজারের দিকে হাঁটা ধরলেন। সুখবরটা মানুষকে দিতে হবে না!
আমার বাবার নেই আজ ম্যালা বছর। তিনি হয়তো বা এই অস্থির বা অসুস্থ দুনিয়ায় থাকতে চাননি। তাই বিদায় নিয়েছেন। কারন, এসব তাঁর ভালো লাগত না। মানুষের প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা অসম্মান তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। সংসার জীবনে তিনি অনেক কষ্ট করেছেন সত্যি, কিন্তু যত দিন বেঁচেছিলেন অনেক সম্মান নিয়ে বেঁচেছিলেন।
যাই হোক অনেক সিরিয়াস কথাবার্তা হলো। এবার একটা হাল্কা গল্প বলা যাক।
এক কৃষক বাবার ছেলে লেখাপড়া করে। পড়াশোনায় বেশ ভালো। বাবার স্বপ্ন ছেলে বড় হয়ে মুহুরী হবে। উকিলের পাশে পাশে থাকবে। তাঁর ধারণা উকিল লোকগুলোর চাইতে মুহুরী ব্যাটারা অনেক ভালো। তাদের সাথে মন খুলে দুটো কথা বলা যায়। তো তার ছেলে একসময় এলএলবি পাশ করল। মানুষ এসে তার বাবাকে অভিনন্দন জানাল। গ্রামের মানুষ অনেক খুশি। আর যাই হোক নিজের গ্রামের একজন উকিল তো পাওয়া গেল। কিন্তু বিধি বাম। বাবা রেগেমেগে একসার। ওরে আমার বাড়ি থাইক্কা বাইর অইতে ক। ওরে কইছি মুহুরী অইতে, ও উকিল অইছে ক্যান?
বাবাদের প্রত্যাশার পাল্লা অত ভারী থাকে না। রাগী রাগী বাবাদের খুশি করা খুবই সহজ।
ভালোবাসা বাবাদের বুকে থাকে জমা
বাবাদের রাগ থাকে, সাথে থাকে ক্ষমা
বাবাদের থাকে শুধু একটাই চাওয়া
সন্তান সুখে থাক, হোক সব পাওয়া।
মোহাম্মদ শাহ আলম: লেখক ও উন্নয়নবিদ।
আগের লেখা পড়ুন:
খেজুরে আলাপ: মান্টু নান্টুদের তেলেসমাতি জীবন!
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন - ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৩] - শোকস্রোতের নীলমণি: নাট্যদিশারী আফসার আহমদ
- ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২] - ভ্রমণকাহিনী: ইরানি গোলেস্তান আর ঝর্ণার গল্প
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩
- রশীদ হায়দার আর নেই
- ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২৪
- সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই