শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নুরু চাচার অলৌকিক ক্ষমতা

মোহাম্মদ শাহ আলম

১৪:০৪, ১২ জুন ২০২১

১০৮৫

নুরু চাচার অলৌকিক ক্ষমতা

আজকে আমার নুরু চাচাকে নিয়ে গপ করব। কারন নুরু চাচা গপ করতে পছন্দ করতেন। নুরু চাচার গপ ছিল আকাশ-পাতাল গপ। গপের কারনে তিনি এতটাই প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন যে, লোকে তার নাম দিয়েছিল গপী নুরু। গ্রামের মানুষদের এই একটা অলিখিত ক্ষমতা, কেমন করে যেন তারা মানুষকে নাম দিয়ে বিশেষায়িত করে ফেলেন। আমাদের গ্রামে ছিল পাঁচ জন নুরু। এই পাঁচ জনেরই ছিল আলাদা আলাদা বিশেষায়িত নাম। এক নুরু ছিলেন বাঁশি বাজাতেন, তার নাম হলো বাঁশি নুরু। আরেকজন ছিলেন নুর বক্স, তার নাম হয়ে গেল বাকশো নুরু। যে নুরু কাঁচা তরকারীর ব্যবসা করতেন তার নাম তরকারী নুরু। আর এক নুরু ছিলেন ছোটখাটো মানুষ, তার নাম হলো বুইট্টা নুরু। তবে এটাও একটা কথা, এক নামের এত মানুষ কেন একটা গ্রামে?

সে যাকগে। গপী নুরুর কথায় আসি। শুধু আমাদের গ্রাম নয়, পুরো এলাকা জুড়ে গপী নুরু ছিলেন পরিচিত। নুরু চাচা ছিলেন অকৃতদার। জীবনে বিয়েথা করেননি। এর কোন কারন আমাদের জানা নেই। তিনি ছিলেন অদ্ভুত রকমের মানুষ। সব সময় একা একা থাকতেন। হাঁটতেন একা একা। লুঙ্গি পরতেন আর পরতেন আমাদের নারায়নগঞ্জের সতিশ হোসিয়ারীর হাফহাতা কোরা গেঞ্জি। হাতে থাকত একটা পাখির খাঁচা। খাঁচার ভিতরে একটা ঘুঘু পাখি। সম্ভবত মেয়ে পাখি। আরেক হাতে থাকত একটা পাখি ধরার ফাঁদ। সারাদিন পাখি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। কোন ঝোপঝাড়ে গিয়ে পাখির ফাঁদ পাততেন। মেয়ে পাখির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ফাঁদে পা দিত পুরুষ ঘুঘু। সন্ধ্যার দিকে কয়েকটা ঘুঘু হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন নুরু চাচা। নুরু চাচার লুঙ্গির কোচড়ে থাকত একটি ছোট কৌটা। এই কৌটা নিয়ে আমাদের কৌতুহলের অন্ত ছিল না। মাঝে মাঝে দেখতাম ওই কৌটা থেকে সাদা কিছু একটা হাতের তালুতে নিয়ে মুখে পুরতেন। বড়দের কাছে শুনেছি ওটা ছিল বেকিং সোডা বা খাবার সোডা। মাঝে মাঝেই প্রচন্ড পেট ব্যথা হত নুরু চাচার। তখন তিনি একটু সোডা খেতেন। এতে নাকি ব্যথার প্রশমন হত। গ্রামে একটা কথা চাউর হয়েছিল যে পাখি ধরার কারনে তার পেটে ব্যথা হত। এতে অবশ্য একটা ভালো কাজ হয়েছিল। গ্রামের ছেলে ছোকড়ারা কেউ পাখি ধরতে যেত না।

নুরু চাচার সাথে গ্রামের বড়দের খুব একটা কথা বলতে দেখা যেত না। তবে তিনি কথা বলতে পছন্দ করতেন। ছোটদের দেখলেই দাঁড়িয়ে যেতেন। আর গল্প বলা শুরু করতেন। আগেই বলেছি, তার গল্প ছিল আকাশ-পাতাল গল্প। গল্পগুলো কখনোই বিশ্বাস হতো না আমাদের। কিন্তু গল্প শুনতে মজা লাগত। আমরা খেলা ফেলে তার গল্প বা গপ শুনতাম। তার গপের একটা নমুনা দেয়া যেতে পারে।

“. . . আরে কী আর কমু। একবার মাছ ধরতে গেছিলাম মর্তুজাবাজ। গেছিলাম চাইর পাঁচ জন। তারপর আমাকে ইঙ্গিত করে, এই ছেড়া, তোর বাপও গেছিল লগে। (আমার বাবা যেতেও পারেন। মাছ ধরার নেশা ছিল ওনার।) তোরা তো আবার চিনবি না মর্তুজাবাজ কই। এই গ্রামডা অইল ভুলতার কাছে। আমগো গেরাম থেইক্কা আডা ধরলে, মজুমপুর, মিরেরবাগ, পাকুন্দা, গোলাকান্দাইল, ভুলতা পার অইয়া তারপর মর্তুজাবাজ। এই গ্রামে একটা অনেক পুরান মাদরেসা আছে। এই মাদরেসার কাছে আছে বড় একটা পুশকুনি। এই পুশকুনিতে মাছ ধরার জন্য যহন পলো নিয়া নামলাম তহন ঘটল এক আরচয্য ঘটনা। আমি পলো দিয়া একটা চাপ দিছি। পরের চাপটা দেয়ার লগে লগে আমারে কে জানি পানি থেকে উড়াইয়া নিয়া ফালাইল পুশকুনির পারে।”

সম্ভবত এই গপের কারনেই বড়রা তারে সময় দিতে চায় না। তার গপ একবার শুরু হলে না যায় গপ শোনার লোভ সামলানো, না যায় সময় দেয়া। তো লোক বলে, এই নুরু চাচার নাকি আছে অলৌকিক এক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা আমরা বিশ্বাস করি কিন্তু দেখি নাই। কী তার সেই ক্ষমতা? ক্ষমতাটা নাকি কল্যানকর নয়, ক্ষতিকর। ধরুন, কারো জমিতে খুব ভালো ধানের চারা হয়েছে বা কারো খেতে ফুলকপির চারা খুবই তরতাজা দেখাচ্ছে। এখন যদি নুরু চাচা জমির পাশে দাঁড়িয়ে শুধু একবার বলে, বাহ্, খেতটা কী সুন্দর! খুব ভালো ফলন হবে। তবে নাকি তিন দিনের মধ্যে খেতের ফসল শেষ। পচে যাবে। এই কারনে নুরু চাচাকে দেখলে কেউ খেতের কাছে থাকে না। দূরে চলে যায় বা বাড়ি চলে যায়। কারন খেতের পাশে দেখলেই নুরু চাচা দুটো কথা বলবে। তারপর খেতের প্রশংসা করবে। তারপর, যা হবার তাই হবে। কে চায় এত কষ্ট করে জমি চাষ করে, গপী নুরুর সাথে একটা কথা বলে, জমির ফসল নষ্ট করতে? কেউ না।

এই একটি কারনেও বড়রা নুরু চাচার সাথে কথা বলে না। তাছাড়া বাড়ির বউ ঝিদের তো নুরু চাচার সামনে পরা একদমই নিষেধ। কখন আবার বলে ফলে, বাহ্, বউডা কী সোন্দর!

তো নুরু চাচার এই ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে চাইল পাশের গ্রামের এক কৃষক। জমিতে গম চাষ করেছেন। কিন্তু এমন ঘাস হয়েছে যে গমের চারা আর দেখা যায় না। শুধুই ঘাস আর ঘাস। এই পুরো জমির ঘাস তুলতে অনেক টাকার ব্যাপার। কৃষক সাহেব বুদ্ধি করলেন, একবার নুরুকে এনে দেখালে কেমন হয়। নুরু যদি শুধু একবার বলে, বাহ্, কী সোন্দর ঘাস। তবে তিন দিনেই ঘাস মরে পরিস্কার।

যেই ভাবা সেই কাজ। নুরু চাচার ডাক পড়ল। জমির কাছে নিয়ে গেলেন কৃষক। তারপর বললেন, নুরু ভাই, আপনি ভালো বললে তো ফসল খারাপ হয়ে যায়, তাই একবার বলুন, ঘাস অনেক ভালো হইছে। নুরু চাচা সব শুনলেন। খানিকটা ভাবলেন। তারপর নুরু চাচা কী বলতে গিয়ে কী একটা বলে ফেললেন, খেতটা তো ভালোই অইছে ভাই সাব। গমের চারাগুলি কিন্তু অনেক সোন্দর। ঘাসগুলি নিড়াইয়া দিলে গম অনেক ভালা অইব।

তিন দিন পর দেখা গেল খেতে আর গমের চারা নেই। শুধুই লকলকে ঘাস। আপনাদেরও এমন একজন নুরু চাচা আছে নিশ্চয়ই!

 

মোহাম্মদ শাহ আলম: লেখক ও উন্নয়নবিদ।

আগের লেখা পড়ুন:

খেজুরে আলাপ: মান্টু নান্টুদের তেলেসমাতি জীবন!

অনলাইনের বেলতলা

সবারই একটা হিসাব আছে

‘স্যার’ বলবেন না প্লিজ, ‘ভাই’ বলবেন 

‘খেজুরে আলাপ’

আমাদের অফিসে যেদিন প্রথম কম্পিউটার এল

 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank