শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-নয়]

কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক

১৯:৪৬, ৩০ মে ২০২১

আপডেট: ১০:১৭, ৯ জুন ২০২১

১১৬১

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-নয়]

ওমর, দ্য টেন্ট মেকার
ওমর, দ্য টেন্ট মেকার

কিস্তি - ৯ বাগিচায় একদিন

সকালের রোদ গোলাপের পাপড়ি থেকে সবে রাতের বৃষ্টির কণা মুছে দিয়েছে এমন সময়ে নিজাম-উল-মুলক চলে এলেন। সঙ্গে আরেকজন, যিনি এমন একটি ঘোড়ায় চড়ে এসেছেন যা আরবীয় ঘোড়ার তুলনায় নেহায়েৎ সাদামাটা। পরনে আলখাল্লা, দেখে মনে হয় যেন ওটার ভেতর কেউ তার পরিচয় লুকোতে চেয়েছে। অতিথি দুজন ওমরের বাড়িতে পৌঁছুবার আগেই ওমরের মনে হল আগন্তুকের হাবভাব কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। তারা দুজন ঘোড়া থেকে নেমে বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই ওমর বুঝতে পারলেন যে মালিকশাহ স্বয়ং ওমরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। সুলতানের একটা প্রিয় শখ ছিল ছদ্মবেশে শহর ঘুরে বেড়ানো। প্রায় সকল মহান নৃপতিগণই এ কৌশলে প্রজাদের সঙ্গে মিশেছেন, রাজকর্মচারীদের বাইরে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে রাজ্যের হালহকিকত জেনেছেন, প্রজারা কীভাবে জীবন কাটাচ্ছে সেটা নিজ চোখে দেখেছেন। কোনো কোনো সময় অবশ্য নিছক কৌতুহলেও তারা ছদ্মবেশ নিয়েছেন। সেরকমই মালিকশাহও ওমরের তুলনামূলক কম আড়ম্বরপূর্ণ বাসগৃহে চলে এসেছেন। স্বাভাবিক সৌজন্য হলো এই যে গৃহস্বামী অতিথির ছদ্মবেশ ভাঙানোর কোনো চেষ্টা করবেন না। কিন্তু সুলতান আসলে কিছু সময়ের জন্য সাম্রাজ্য চালানোর জটিলতা ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন। রাস্তায় বিপদ ঘটতে পারে ভেবে সতর্কতা হিসেবে তিনি আজকের ছদ্মবেশ নিয়েছেন। ওমরের বাসায় পৌছুতেই তিনি ছদ্মবেশ খুলে ফেললেন। ওমর দেখতে পেলেন যে সুলতান আর দশজন বন্ধুবৎসল ব্যক্তির মতই সহৃদয় ব্যবহার করছেন। 

মালিকশাহ প্রস্তাব করলেন যে নিজাম-উল-মুলক আর ওমরের সঙ্গে তিনিও গ্রীষ্মকালীন বাগিচায় যাবেন। তবে তার আগে তিনি দেখতে চান ওমর কীভাবে থাকেন। শুরুতেই তিনি কবির বৃদ্ধ মাতা জেবা খাতুনের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং মধুর স্বরে কথা বলে রমণী হৃদয় জয় করলেন। এরপর তিনি ওমরের বাগান, এবং বিশেষ করে তাঁর গাণিতিক হিসেব-নিকেশে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি দেখতে চাইলেন। তিনি একটি জলঘড়ি দেখে অত্যন্ত চমৎকৃত হলেন। এটি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সময়ের হিসেব দিচ্ছিল। ওমরের তৈরি করা নভোমণ্ডলের মডেলটিও তাঁর নজর কাড়ল। এতে আকাশের বিভিন্ন অংশ, রাশিচক্রের বারোটি গ্রহের অবস্থান এবং তাদেও আবর্তনপথ দেখানো হয়েছে। এক কোণায় আবার উপরদিকে গম্বুজবিশিষ্ট একটা ধনুকাকৃতি খিলান ছিল। মেঝেতে কৌণিক ডিগ্রি হিসেব করে নানান রেখা আাঁকা। গম্বুজের ছিদ্রপথে আলো ঢুকে সেগুলোর ওপর পড়লে ওমর হিসেব করে সূর্যের উচ্চতা এবং বছরের কোন সময় চলছে তা বের করতে পারতেন। আধুনিক কালের হিসেবে যন্ত্রগুলো একেবারেই সেকেলে এবং সাদামাটা, কিন্তু এগুলো দিয়েই ওমর কাজ চালাতে পারতেন।

সুলতান নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। ওমর বিনয়ের সঙ্গে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে সেগুলোর জবাব দিলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন যে জ্যোতির্বিদ্যায় তিনি তার সময়ের বিজ্ঞানীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তিনি কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে সেই জামশিদের* আমল থেকে প্রচলিত অবৈজ্ঞানিক বর্ষপঞ্জীর কথাও পাড়লেন। প্রচলিত এই পঞ্জিকাটি যেমন ছিল জটিল, তেমনি ভুলে ভরা**। সুলতান গভীর আগ্রহ নিয়ে তার কথা শুনলেন, এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, যে পাহাড়টিতে শিকারের আস্তানা করা হয়েছে তার চুড়ায় ওমরের ব্যবহারের জন্য তিনি একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। এতে ওমরের নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করা হবে। তিনি তৎক্ষণাৎ মনে মনে আরও ঠিক করলেন যে, একটি নতুন বর্ষপঞ্জী তৈরির মাধ্যমে তিনি তাঁর শাসনকালকে বিশিষ্ট করে রাখবেন এবং ওমরকেই সেই পঞ্জিকা তৈরির দায়িত্ব দেবেন। বিষয়টা তিনি অন্য দুজনকে বললেন না, কারণ এত সুদূরপ্রসারী একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে উপদেষ্টাদের সঙ্গেও পরামর্শ করে নিতে চান। 

এরপর তারা ছায়াচ্ছন্ন বাগানে গিয়ে বসলেন। আয়তাকার জলাধারে তাজা মাছের লাফঝাঁপে পানি ছিটাচ্ছিল আর জলতরঙ্গের টুংটাং ধ্বনি তুলে ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছিল। জেবা খাতুন ইতোমধ্যে সুস্বাদু শরবত তৈরি করেছিলেন। মেহমানদের সামনে তা পরিবেশন করা হল। 

আগের কিস্তিসমূহ:


[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ] [কিস্তি-৩ পাহাড়ি উদ্যান] [কিস্তি-৪. পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ] [কিস্তি-৫: হাসান বিন সাবাহর কাহিনী] [কিস্তি-৬. প্রাচ্যের দ্বারমণ্ডপ] [কিস্তি-৭: উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকারী] [কিস্তি-৮: কবির শিক্ষাজীবন]


এরই মধ্যে প্রাসাদ থেকে একজন সহিস ওমরের জন্যও ঘোড়া নিয়ে এসেছিল। সুলতানের পরামর্শ মত তারা তিনজন ঘোড়ায় চড়ে দক্ষিণ তোরণ দিয়ে শহরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। নগর প্রাচীরের বাইরে তারা দেখতে পেলেন যে চাষীরা তখনও কষ্টকর কাঠের ফলার লাঙ্গল দিয়ে চাষবাস করছে। বাতাস হাজার হাজার বৃক্ষশোভিত ফলবাগানের মৌ মৌ ঘ্রাণে মাতোয়ারা। আঙিনার আঙুর গাছের সদ্য ধোয়া পাতা আর পথপার্শ্বের পানির প্রবাহে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে চকচক করছে। বেশ কবছরের নিরবচ্ছিন্ন শান্তি প্রমাণ করে দিয়েছে এ উপত্যকা উৎপাদনশীলতার দিক থেকে কত বেশি উর্বরা। পথে একটা বাগান পড়ল যাতে মানুষের ক্ষুধা উদ্রেক করে এমন সকল ধরনের ফলের আবাদ করা হয়েছে। সুলতান কাব্যপিপাসু, তবে ব্যবহারিক দিকেও সমান মনোযোগী। আরেকটু দূরে একটা বায়ুচালিত কল সুলতানের নজর কাড়ল। রোদে-শুকানো ইটের গাঁথুনি দেয়া দুটি সমান্তরাল দেয়ালের উপর আড়াআড়ি একটা থামে এটা বসানো হয়েছে। থামটা আবার নিচে একটা গোলাকার পাথর কলের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত যে বাতাস এলে উপরের পাখাগুলো ঘুরে, এবং তার প্রতিক্রিয়ায় নিচের পাথর কল মাড়াই করতে শুরু করে। ব্যাপারটা ভালো করে দেখার জন্য সুলতান থামলেন। ঘোড়ার উপর থেকেই মিল মালিকের সঙ্গে কথা বললেন। পুনরায় রওনা দেবার আগে তিনি মিল মালিককে একটা সোনার মুদ্রা দিলেন আর বললেন, খোদা আপনার হেফাজত করুন।

ঘন্টাখানেক পথ চলে তারা উদ্দিষ্ট বাগিচায় পৌঁছুলেন। বিশ্ববাসীদের চোখে জায়গাটা অপবিত্র, কেননা এখানে অবাধে মদ্যপান চলে। এখানে মূলত সুফিরা আসেন, যারা যুক্তি দেন যে ধর্মীয় বিধিনিষেধের কঠিন বেড়া তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। পরবর্তী বছরগুলোতে সুফি মতবাদে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল, এমনকি হাফিজ ও সাদির কবিতার স্বাভাবিক অর্থের বদলে উদ্ভট ও দুর্বোধ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। কিন্তু ওমরের সময় সুফিরা নিজেদের মুক্ত-চিন্তার অধিকারীর চেয়ে খুব বেশি কিছু বোঝাতেন না। ঐশ্বরিকতার সঙ্গে আত্মিক সংযোগ এবং পরম সত্যের পর্যায় তথা হাকিকত পর্যন্ত পৌঁছুনোর পথকে তারা মোটামুটি চারটি স্তরে ভাগ করতেন। কিন্তু অনেকেই, তখন এবং এখনও, প্রথম পর্যায় অতিক্রম করেই তুষ্ট থাকতেন। এ স্তরে শিষ্যগণকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ, এবং মানবজাতির জন্য উপকারী সকল আচার-আচরণ মেনে চলতে হতো। এরপর তারা দ্বিতীয় স্তরে বা হারিকতে অবস্থান করতেন। এ স্তরে পৌছুতে পারা ভাগ্যবানগণ ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও আচার-অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করতেন। এ স্তরে পৌছুনোর জন্য যদিও অত্যন্ত বিশুদ্ধতা, গুণ এবং অধ্যবসায়ের প্রয়োজন পড়ত, দেখা যেত যে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে যাওয়ায় এ পর্যায়ে অনেকেই আত্মসুখে নিমজ্জিত হয়ে গেছেন।

প্রকৃত সুফি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন এবং বিশ^াস করেন যে সবকিছুই ঈশ্বর-নির্ধারিত মঙ্গল ও আনন্দময়। তারা ধার্মিকতা এবং অবিশ্বাসের মধ্যে ফারাক খুঁজে বেড়ান না। তাদের কাছে আইনসম্মত ও বেআইনির মাঝে কোনো ভেদ নেই। সামনে যা দেয়া হয় কোনো প্রশ্ন না করে তা-ই তারা খান। নারীগণ বেপর্দায় চললেও তাদের কোনো আপত্তি নেই। সুরা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ওমরের মতই, যিনি লিখেছেন,

“পান করো, কারণ এটা অনন্ত জীবনের- এখন ফুল, সুরা ও আনন্দময় সঙ্গীর কাল। এই মূহুর্তেই সুখি হও, এজন্য যে, এটাই জীবন।”

এবং সুলতান ও নিজামউলমুলকের সঙ্গে চলতে চলতে তার মনে একটা চতুষ্পদীর ভাবনা এল, সরল গদ্যে যার অর্থটা এরকম:

“গোলাপের ঋতুতে, নদীর তীরে, বাগানের তৃণাচ্ছাদিত কিনারে এক, দুই বা তিন জন পছন্দসই সঙ্গী আর কয়েকজন স্বর্গের অপ্সরার মত তরুণীর সঙ্গে সুরা পান ক’রো!”

সরাইখানার মালিক কল্পনাও করতে পারেনি যে ওমরের সঙ্গীদ্বয়, সাদাসিধে পোষাক পরনে আর একজনমাত্র চাকর নিয়ে আসা এ দুই লোক সেলজুক সাম্রাজ্যের দুই প্রধান ব্যক্তি - সুলতান নিজে আর তার বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী। জানলে হয়ত বিস্ময়ে তার চোখ গোল হয়ে যেত, আর সে তৎক্ষণাৎ অন্য অতিথিদের কানে ফিসফিস করে খবরটা জানিয়ে দিত। এবং যতকাল বেঁচে থাকত, ব্যাপারটা গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করত। সে কোনো সন্দেহ করেনি, তবে অতিথিদের মুখে আভিজাত্যের ছাপ তার নজর এড়ায়নি। সে তাদেরকে সেরা জায়গাটাতে নিয়ে বসালো। বিলাসবহুল ডিভান আর সিরাজের পশমী বালিশে সাজানো ছাউনিতে তারা বসলেন। সাকি বা মদ পরিবেশনকারী তাদের সামনে উৎকৃষ্টতম সুরা পরিবেশন করল। সুগন্ধী বাতাসে নদীর স্রোতে উঠা ঢেউয়ের মৃদু হিল্লোল অতিথিদের নয়ন জুড়াল। মাথার উপরে বিস্তৃত বৃক্ষেরা তাদের শাখা-প্রশাখা নেড়ে অভ্যর্থনা জানাল। পাখিরা এমনভাবে গান করছিল যেন তাদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ। নদীর অন্যপারের জমিতে পোস্ত ফুলের আবাদ করা জমিটাকে টকটকে লাল আর হলুদের তারতম্যে তৈরি হওয়া অসংখ্য রঙের বিচ্ছুরণে একটা জমকালো কার্পেটের মত দেখাচ্ছিল। মনোরম এই দৃশ্যটা সাজানো হয়েছিল অপরূপ সুন্দর খিলানের ছাঁচে, যাকে মুসলমানদের ডিজাইন বলা যেতে পারে। 

মেঝেতে আরও একটা সুন্দর কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হলো। পাশেই একজন সুবেশী বাদিকা বীণা নিয়ে বসল। তার আঙুল সঞ্চালনায় এমন ঝঙ্কার উঠল যা আগে কেউ কখনো শুনেনি। তারপর নাচতে নাচতে একজন নর্তকী এল। সরু, নগ্ন পায়ে তার চলার ভঙ্গী বাতাসে লিলি ফুলের দোল খাওয়ার মত নির্ভার। সুগোল বাহুতে ঢেউ খেলিয়ে সে একের পর এক নির্বাক করে দেয়ার মত নাচের লহরি তুলল। এমন নৃত্য এখানে এই প্রথম।

ওমর চমকে উঠলেন, যেন বৈদ্যুতিক শক খেয়েছেন। নিজের চোখকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, আবার ভুল করারও কোনো কারণ নেই। হ্যা, আগাপে, রহস্যময়ী গ্রিক তরুণী, তার হৃদয়ের দেবী আগাপেই এই নর্তকী। তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সেও তাঁকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু সে এখানে কেমন করে এল? তিনি নিজেকেই এই প্রশ্ন করলেন, কিন্তু উত্তর পেলেন না। সে যদি নিজেই কৌশল খাঁটিয়ে অন্দরমহল থেকে বের হয়ে থাকে, তাহলে সুলতান মালিকশাহ এবং নিজাম-উল-মুলকের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় সত্ত্বেও কেমন করে এখানে আসার দুঃসাহস করল? এ সাহসের যেন সীমা নেই। এর ফলাফল কী হতে পারে কল্পনা করে তিনি ভয় পেলেন। কিন্তু সুলতান এবং নিজাম-উল-মুলকের হাবভাবে মনে হচ্ছে যেন তারা অবাক হননি, সবকিছু ঠিকই আছে। লাল মদিরায় চুমুক দিতে দিতে মালিকশাহ আয়েশি ভঙ্গিতে নাচ দেখছিলেন। মনকাড়া মুদ্রা আর কলার সমন্বয়, কিন্তু অশ্লীল ইঙ্গিত বা ইন্দ্রিয়প্রবণতার লেশমাত্র নেই। আলোকোজ্জ্বল দিনে ফুটে উঠা চারপাশের সুন্দর দৃশ্য, মাঝে মাঝে পাপড়ি ঝরানো গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণ, বৃক্ষশাখার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ, নদীর কলধ্বনি, সব মিলিয়ে পুরো নিসর্গটাই সুলতানের মন কাড়ল। তিনি বললেন,

“হে আল্লাহ! এ নর্তকী সুন্দর, আর নাচেও কী চমৎকার! রাজপোষাক পরিহিত থাকলে আমি হয়ত আমার মুকুটের হিরেটাই তাকে দিয়ে দিতাম।”

“ঠিকই বলেছেন,” নিজাম-উল-মুলক বললেন। “সে সুলতানের প্রিয় হিরে দরিয়া-ই-নুর পাবার উপযুক্ত বটে।” এরপর ওমরের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, “আচ্ছা শুনি তো, বন্ধু ওমর কী উপহার দিতে চাইতেন?” ওমরের তখন অন্য কোনোদিকে মনোযোগ নেই, দৃষ্টি নৃত্যে নিবদ্ধ।

“তিনি নিশ্চয়ই তাকে একটা চতুষ্পদী উপহার দিতে চাইবেন,” সুলতান বললেন। “হে কবিতার রাজপুত্র! একটা রুবাই আবৃত্তি করুন যা এই তরুণীর ভ্রুকে রাঙিয়ে তুলবে।”

ওমর যেন অনুপ্রাণিত হলেন। আগাপের সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে নিচু আর কম্পিত স্বরে এমন একটা চতুষ্পদী আবৃত্তি করলেন, যা আটশো বছর পরে ফিটজেরাল্ডের অনুবাদে ইংল্যান্ডের বাগানে বাগানে সঙ্গীতের মত বেজে উঠেছে: 
                “A Book of verse underneath the Bough,
                A Jug of Wine, a Loaf of Bread – and Though
                Beside me signing in the Wilderness,
                Oh, Wilderness were Paradise now.”
    
এই ইংরেজি ভাষ্য থেকে বাংলা ভাষায় রুবাইয়াতে ওমর খৈয়ামের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় অনুবাদক কান্তিচন্দ্র ঘোষ এর বাংলা করেছেন: 

“সেই নিরালা পাতায় ঘেরা
বনের ধারে শীতল ছায়,
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে
ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়!
মৌন ভাঙ্গি মোর পাশেতে
গুঞ্জে তব মঞ্জু সুর –
সেই তো সখি স্বপ্ন আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর!”*

ফিটজেরাল্ড এবং তার অনুবাদে প্রভাবিত হয়ে যারা বাংলায় অনুবাদ করেছেন, তারা শেষ লাইনে স্বর্গের তুলনা টেনেছেন। ওমর কিন্তু বেহেশত নয়, বরং সুলতানদের রাজত্বের কথা বলেছিলেন। মূল রুবাইটি এরকম:

                “তুঙ্গি মেইয়ে লা’ল খোয়াহাম ও দিওয়ানি
                সাদদে রামাগি বইয়াদ ও নেসফে নানি
                ওয়ানগাহ মান ও তো নেসাসতে দার বিরানি
                খুশতর বুভাদ অন জে মামলুকাতে সুলতানি।”**
এর আক্ষরিক অর্থ হলো –-
                “পেয়ালা ভর্তি মদিরা সঙ্গে চাই কবিতার বই,
                আধখানা রুটি, একেবারে কমে কোনোমতে বেঁচে রই
                এবং যদিবা তুমি থাকো পাশে, ধ্বংসস্তুপেও হয়
                সুলতানের ঐ রাজত্ব জেনো এর চেয়ে শ্রেয় নয়।”(কবির চান্দ অনূদিত)

মোদ্দা কথায় এমনকি যদি জীবন বাঁচানোর অবলম্বন থাকে, থাকে খানিকটা রুটি আর মদ, এবং সর্বোপরি কাঙ্খিত সঙ্গী, তাহলে সেটা ধ্বংসস্তুপ হলেও যে-কোনো রাজার রাজত্বের চেয়ে উত্তম। সুলতানের সামনে এরূপ বলাটা ধৃষ্টতা, কিন্তু মালিক শাহ সেটা গায়ে মাখলেন না, বরং খুশি হয়ে বললেন:
    “আল্লাহ মহান! প্রশংসা তার যে তিনি আমাদের মধ্যে এমন একজন কবি দিয়েছেন যিনি তাৎক্ষণিক এত চমৎকার কবিতা রচনা করতে পারেন! এখন এই চমৎকার দিন আর এই সুন্দর সময়টা নিয়ে আরেকটা হয়ে যাক।”

গ্রিক তরুণীর সুন্দর মুখ দেখে ওমর উদ্দীপিত ছিলেন। সুলতানের অনুরোধে তিনি আরেকটা রুবাই রচনা করলেন, যার ছন্দ অন্য রুবাই থেকে একটু আলাদা:
            রুজিস্ত খুশ ও হাওয়া না গরম আস্ত ও না সার্দ
            আর্ব অজ রুখে গোলজার হামি শুইয়াদ গার্দ
            বুলবুল বে জবানে পাহলভি ব গুলে জার্দ
            ফরিয়াদ হামি জানাদ কে: মেই বইয়াদ খার্দ। ***
এর অর্থ,
            নাতিশীতোষ্ণ কী চমৎকার এই দিন
            উদ্যানের চেহারা থেকে কালিমা ধুয়ে দিচ্ছে মেঘ
            হলদে ফুলের কানে ঝরছে বুলবুলের গান
            পাহলভি ভাষায় ফরিয়াদ জানাচ্ছে: এসো শরাব করো পান। ****
        
গ্রিক তরুণী মাধুর্যময় কর্তৃত্ব নিয়ে অপেক্ষমান সাকি বা সুরাপরিবেশকের হাত থেকে মদভর্তি জগটা নিল। সাকির ভ্রু কুঞ্চিত হলো, কিন্তু আগাপে তার দিকে স্মিত হাসি ছুড়ে দিল। উত্তরে সেও হাসল। তরুণী তখন তিন বন্ধুর পেয়ালা পূর্ণ করে মদ ঢেলে দিল।

“তাকে একটা গণিতের প্রশ্ন করো”, নিজাম-উল-মুলক বললেন। চমৎকার পরিবেশ আর মদ তার হৃদয়ে অন্যরকম আনন্দের সঞ্চার করেছিল। তিনি এতটাই খোলামেলা ও উদার হয়ে উঠলেন যে গ্রিক তরুণীকে নিজেদের সমস্তরের কেউ হিসেবে বিবেচনা করে সেরকম ব্যবহার করতে লাগলেন। সত্যি বলতে কি জন্মের উৎস দিয়ে বিচার করলে তরুণী হয়ত তার চেয়েও অভিজাত হবেন। “তাকে তোমার প্রিয় বীজগণিতের একটা অঙ্ক দাও,” তিনি ওমরকে বললেন। *****

ওমর মালিকশাহের দিকে তাকালেন, যেন বুঝতে চান তিনি কী বলেন। সুলতান একটা মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলেন। 

ওমর আগাপেকে কাছে ডাকলেন, কাছ থেকে তার দিকে তাকালেন। তার মনে হল সে যেন নারীকুলের মুক্তো। তিনি আস্তে করে তার হাত ধরে বললেন, 

“হে সুন্দর নর্তকী, আমাকে এটার জবাব দাও: একটা সোনালী মৌচাক থেকে একপঞ্চমাংশ মৌমাছি কদম গাছের দিকে গেল, এক তৃতীয়াংশ গিয়ে বসল কলাগাছের ফুলে, আর এ দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য তার তার তিনগুণ মৌমাছি গেল স্বচ্ছ ঝর্ণার তীরে ফুলভারে নুয়ে থাকা আরেকটা গাছের দিকে। যারা বাকি থাকল, তারা এক কুমারীর সুন্দর মুখকে গোলাপ ফুল ভেবে তার চারপাশে ঘুরতে লাগল। হে সুন্দরী, এবার আমাকে বল, মৌমাছির মোট সংখ্যা কত!”

“ইন আসান নিস্ত! এটা সহজ নয়,” আগাপে বিড়বিড় করে বলল। বোঝা গেল যে সে ফার্সি কিছুটা জানে, কিন্তু উচ্চারণে গ্রিক ছাপ স্পষ্ট। “কিন্তু আমার ধারণা গ্রীষ্মের লম্বা দিনে নিশাপুরের সবচেয়ে মধুর কবির মুখে আমি যে কয়টা রুবাই শুনতে চাইতাম মৌমাছির সংখ্যা ততটাই হবে।”

“নিশাপুরের কবিকে মুকুট পরিয়ে দাও!” সুলতান কাছের একটা গোলাপের গাছ দেখিয়ে চিৎকার করে বললেন, “তাঁকে গোলাপের মুকুট পরিয়ে দাও!”

আনন্দে আগাপের গাল আরক্ত হল। সে রাজকীয় ফুল তুলে সযত্নে কাঁটা বেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একটা মুকুট তৈরি করল আর ওমরের ঢেউ খেলানো ঘন চুলের ওপর বসিয়ে দিল। 

তারপর সে দ্রুত চলে গেল। সে যখন বাঁকা প্রবেশপথের মুখে কারুকাজ খচিত থাম ঘুরে বের হয়ে গেল, ওমরের মনে হল তিনি যেন ভৃত্য জলিমকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন। তাকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল।


* কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদটি বর্তমান অনুবাদক সংযুক্ত করেছেন।
**উপন্যাসে মূল রুবাইটির উচ্চারণ দেয়া নেই। অনুবাদক এর উচ্চারণ যুক্ত করেছেন। 
*** এ রুবাইটির উচ্চারণওউপন্যাসে দেয়া নেই। অনুবাদক যুক্ত করেছেন। এর ছন্দ অন্য রুবাইর ছন্দ থেকে আলাদা বলে ঔপন্যাসিক যে মন্তব্য করেছেন, তার কারণ বোধহয় এই যে, বেশিরভাগ রুবাইর প্রথম দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনের শেষে অন্তমিল থাকে(ককখক ধরনের), কিন্তু এ রুবাইটির চারটি লাইনের শেষে অন্তমিল (কককক ধরনের) উচ্চারণ লক্ষণীয়। রুবাইয়াতে এ ধরনের বেশ কতগুলো চতুষ্পদী বিদ্যমান। 
**** পাহলভি হচ্ছে ফার্সিভাষার প্রাচীন রূপ, বিশেষত ইসলামপূর্ব কালের ব্যবহৃত ভাষা। ফার্সিভাষার অনেক শব্দ পাহলভি থেকে উদ্ভুত। চতুর্থ লাইনের শেষে যে ‘খার্দ’ শব্দটি আছে, ফার্সিতে তা খোর্দ। কিন্তু খোর্দ লিখলে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনের অন্তমিল যথাক্রমে সার্দ, গার্দ ও জার্দ এর সাথে মিলত না। ওমর তাই খার্দ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এটি পাহলভি শব্দ। 
***** রুবাইয়াতের কল্যাণে ওমর কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও, তিনি যেমন প্রতিভাবান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন, তেমনি ছিলেন বড় মাপের গণিতবিদও। বিশেষ করে বীজগণিতে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে তার সেরা কাজ সমীকরণ ঘটিত। এখন নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রীদের যে ধরনের সমীকরণ শেখানো হয়, মোটাদাগে তিনি সে স্তরের সমস্যার সমাধান করেছেন। বর্তমানের পরিমাপে তা অত্যন্ত সাদামাটা মনে হতে পারে, কিন্তু অন্য গণিতবিদরা ওমরের ওইটুকু পর্যন্ত পৌছুতে পেরেছিলেন প্রায় সাতশ বছর পরে।     

পরের কিস্তি: প্রমোদের ফাঁকে ফাঁকে কাজের আলাপ

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank