দক্ষ কর্মীরা কেন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যায়?
দক্ষ কর্মীরা কেন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যায়?
চারপাশে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা কত তার শতভাগ সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না! বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে শত শত সিভি জমা পড়ে। অথচ সাক্ষাৎকার শেষে প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ কর্মী খুঁজে পায় না। আবার যে দু-একজন দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় তাদেরও বেশি দিন ধরে রাখা যায় না।
কোনো কোনো মালিক অভিযোগ করে থাকেন, ভালো কর্মীরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়, প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা না করে তারা কেবল নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যেসব মালিক এমন মন্তব্য করেন, তাদের নিজেদের ভুলগুলো খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। তাদেরও ভাবা উচিত, ভালো কর্মীরা কেন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যায়?
প্রতিযোগীতার এই যুগে একটি ভালো চাকরি পাওয়া বেশ কঠিন। একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য ভালো চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন তেমনি প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন দক্ষ কর্মী পাওয়া আরো বেশি কঠিন। প্রতিষ্ঠানের কিছু ভুলের জন্য দক্ষ কর্মীরা প্রতিষ্ঠানে ছেড়ে চলে যান।
অনেক মালিক মনে করেন শুধুমাত্র অর্থের জন্য কর্মীরা প্রতিষ্ঠান ছাড়েন। বস্তুত অর্থ ছাড়াও আরও কিছু কারণ থাকতে পারে একজন দক্ষ কর্মীর প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার পেছনে। তার মধ্যে অন্যতম কিছু কারণ জেনে নেওয়া যাক।
কর্মী ভেদে অসম আচরণ
স্বজনপ্রীতি, বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক পরিবেশে কোনো দক্ষ কর্মী চাকরি করতে চায় না অথবা পারেনা। শুধুমাত্র অসম আচরণের কারণে অনেক দক্ষ কর্মী অল্প সময়ের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেন। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে কর্মীদের চাহিদায় অনেক পরিবর্তন হয়। তারা প্রতিষ্ঠানে ভাল পরিবেশের পাশাপাশি ভাল আচরণও প্রত্যাশা করে।
নতুন কিছুতে নিরুৎসাহিত করা
প্রত্যেক কর্মী প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন কিছু করতে চায়। নিজের বাড়তি দক্ষতা দেখাতে চায়। কিন্তু কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা পরিবর্তনকে মেনে নিতে চায় না, নতুন কিছু সহজে মেনে নিতে পারে না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা একই কাজ বারবার করতে করতে আগ্রহ হারিয়ে একসময় প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
অযোগ্য কর্মীদের মূল্যায়ন
কোন কোন সময় প্রতিষ্ঠানে ভুল বা অযোগ্য ব্যাক্তিকে পদন্নোতি দেয়া হয। শুধুমাত্র সুসম্পর্কের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা বা কাজের মূল্যয়ন কম সেসব প্রতিষ্ঠানে দক্ষ কর্মীরা বেশি দিন থাকে না।
সৃজনশীলতার অবমূল্যায়ন
কাজের স্বীকৃতি সব কর্মীরা আশা করেন। কাজের পুরস্কারের জন্য খুব বেশি কিছু করার প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। একটি ছোট ধন্যবাদ কিংবা কাজের প্রশংসা হতে পারে কর্মীদের কাজের পুরস্কার। ছোট এই কাজটুকু কর্মীদের কাজের দক্ষতা বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ। প্রতিষ্ঠানে একই পদে দীর্ঘদিন কাজ করে যদি একজন কর্মী পদোন্নতি বা প্রণোদনা না পান তাহলে তিনি কাজে মনোযোগ হারাবেন। এসব কর্মীকে বেশি দিন প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখা যাবে না। প্রতিষ্ঠানের উচিত হবে কর্মী অদক্ষ হলে তাকে সম্মানজনকভাবে বিদায় দিয়ে নতুন কর্মী নিয়োগ দেয়া এবং একই সাথে দক্ষ কর্মীকে সময়মত পদোন্নতি দিয়ে তাকে কাজকে উৎসাহিত করা।
কর্মজীবনে প্রশিক্ষণের অভাব
কোনো মানুষই একই কাজ প্রতিদিন করতে চান না। সবাই চায় নতুন কিছু শিখতে, নতুন কিছু করতে। কর্মক্ষেত্রে উন্নতি কর্মীদের অন্যতম একটি চাহিদা। কর্মীরা আশা করেন তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কাজে আরো দক্ষ করে তোলা হবে। কর্মীরা চায় নিজেদের ক্যারিয়ারে উন্নতি। তাই কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষনের বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষন পেলেই কর্মীদের কাজে উন্নতি ঘটবে, ফলে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন হবে।
অসম্মানিত হলে
প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিদের মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তার সবাই যার যার যোগ্যতা দিয়ে নিজের পদে অধিষ্টিত হয়েছেন। এখানে কে পিওন, কে অফিসার, কে ম্যানেজার তা ভাবার চাইতে যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। কাজের পুরস্কারের জন্য খুব বেশি কিছু করার প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। একটি ছোট ধন্যবাদ কিংবা কাজের প্রশংসা হতে পারে কর্মীদের কাজের পুরস্কার। ছোট এই কাজটুকু কর্মীদের কাজের দক্ষতা বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।
স্বৈরাচারী নেতৃত্ব
যেসকল প্রতিষ্ঠানে স্বৈরাচারী নেতৃত্ব বিদ্যমান সেখানে কর্মীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কর্মীদের মতামতের গুরুত্ব প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া উচিত। “বস ইজ অলওয়েজ রাইট” এই ধরনের নেতৃত্ব কর্মীরা পছন্দ করেন না। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে দক্ষ কর্মীরা খুব বেশিদিন থাকেন না।
অতিরিক্ত কাজের চাপ
প্রতিষ্ঠানে যে কর্মী যত বেশি নিবেদিত ব্যবস্থাপকও তার প্রতি তত বেশি নির্ভরশীল। ব্যবস্থাপক চায় তার কাজ যেন যথাযথ ও সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়। আর তাই বড় বড় কাজের চাপ সবসময় সেই নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর কাঁধেই বর্তায়। ব্যবস্থাপক একজন দক্ষ কর্মীর হাতে কাজ দিয়ে সবসময় নিশ্চিন্ত থাকতে চান। কিন্তু এটাও ভাবা উচিত, এত কাজের চাপ তার পক্ষে নির্দিষ্ট সময়ে সব কাজ করা সম্ভব নাও হতে পারে। ফলস্বরূপ, তিনি সব কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠেন এবং বিকল্প কাজের সন্ধান করতে থাকেন।
আমাদের অনেকেরই চাকুরির ক্ষেত্রে কিছু কিছু অনুত্তরিত জায়গা থাকে। অনেকেই অকপটে তা স্বীকার করেন, অনেকে স্বীকার করেন না। কাজটাকে ভালোবাসার জায়গা করে নিতে আমরা অনেকেই পারি না। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো আমাদের মেধার অভাব রয়েছে অথবা এমন একটি পেশায় আপনি রয়েছেন যেখানে আপনি কাজটাকে ভালোবাসতে পারেননি। যেহেতু আমরা সবাই দিনের অধিকাংশ সময় কর্মস্থলে ব্যয় করি সেহেতু আমাদের হাতে সময় থাকে না এই অনুত্তরিত জায়গাগুলোকে ভালোবাসা বা শখের জায়গা হিসেবে দাঁড় করাতে। কর্তৃপক্ষ চাইলে চাকুরির জায়গাটাকে উপভোগ্য এবং শখের একটি জায়গা হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন।
কর্তৃপক্ষ চাইলে কাজগুলো এমনভাবে সাজাতে পারেন যাতে কর্মীরা অনুপ্রাণিত হন এবং কাজগুলোকে ভালোবাসতে পারেন। সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো সেই কাজগুলোই কর্মীর মাঝে বণ্টন করা উচিত যা তারা করতে ভালোবাসে। অন্যথায় কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে “কর্মীরা কী বস বদলায় নাকি চাকরি বদলায়”!
জিয়াউল হক: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক, নেক্সাস টেলিভিশন।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়