সহকর্মীর সঙ্গে কেমন হবে আপনার সম্পর্ক?
সহকর্মীর সঙ্গে কেমন হবে আপনার সম্পর্ক?
চাকরি জীবনের প্রতিটি দিন নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় সবাইকে। এসব চ্যালেঞ্জকে সামলে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। চাকরিটা উপভোগ করতে হবে। উপভোগ করতে না পারলে সফলতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হতাশাজনক আচরণ শুধু আপনার ক্যারিয়ারের জন্যই শুধু নয়, সহকর্মীদের জন্যও ক্ষতিকর। মনমরা হয়ে না থেকে উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক কাজগুলো সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করাই আদর্শ কর্মীর একমাত্র বৈশিষ্ট্য। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সহ সকল সহকর্মীদের কাছে নিজেকে জাহির করতে এর বিকল্প হতে পারে না। পরিবেশ সবসময় আপনার মনের মতো হবে না। বরং আপনাকে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জানতে হবে।
অফিসের পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে উপযোগী হয়ে উঠুন। ঘুণে ধরা নিয়ম আঁকড়ে থাকার মতো মানসিকতা বিসর্জন দিন। সবার প্রতি সহনশীলতা দেখাতে পারলে আপনাকে অন্যরা অনুসরণ করবে। অনেকের সঙ্গে মতের মিল নাও হতে পারে। কিন্তু বোঝাপড়ার মাধ্যমে সব কিছুর সমাধান সম্ভব। বড় কর্তাব্যক্তি হতে চাইলে নিজেকে নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে আনুন। যদি নিজে তা না পারেন, তাহলে কিভাবে অন্যদের নিয়মের মধ্যে আনবেন? কাজেই কী করতে হবে তা আপনি ভালোই জানেন। তাই চর্চা চালাতে পিছপা হবেন না।
দিনের বেশির ভাগ সময়টা সহকর্মীদের সঙ্গে কাটাই আমরা। পরিবারের চেয়েও বেশি সময় কাটে তাদের সঙ্গে। কর্মক্ষেত্রকে তাই অনেকে বলেন ‘দ্বিতীয় ঘর’। সেই ‘দ্বিতীয় ঘর’—এ যাদের সঙ্গে থাকছেন, তাদের সঙ্গে সহজ, সাবলীল, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিন্তু কাজে আনন্দ এনে দেয়। কাজের মানও ভালো হয়।
চাওয়া-পাওয়া, দেনা-পাওনা, সুযোগ-সুবিধা প্রতিটি সম্পর্কের সেতু। অফিসেও এর ব্যত্যয় ঘটে না, সেটা সব সহকর্মীর ক্ষেত্রে প্রজোজ্য, হোক নারী কিংবা পুরুষ। আমরা সবাই জানি এবং বুঝি, অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক হওয়া উচিত। কিন্তু এই ‘নীতি কথা’ সব সময় মানা যায় না। অফিস যদি ‘পরিবার’ই হয়, সেখানে মান-অভিমান তো থাকবেই। থাকতে হবে পাশে দাঁড়ানোরও নিদর্শন।
প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন ও নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কাজে আনন্দ পেতে অফিসে তাই সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব জরুরি। সেটি যদি না-ও গড়তে পারেন, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের বিকল্প নেই। সহকর্মীদের সাথে যাদের আচরণ বন্ধুত্বপূর্ণ তারা কাজ করে অনেক বেশি আনন্দ পায় এবং বেশি সময় ধরে কাজ করে।
কিভাবে কর্মক্ষেত্রে কেমন আচরণের মাধ্যমে সহকর্মীর সাথে একটি ভালো ও সুস্থ সম্পর্ক গড়বেন – এবং কিভাবে এটা আপনাকে শক্তিশালী করবে এ লেখায় তা তুলে ধরা হলো:
নিজেকে জানুন:
সহকর্মীদের জানার চেষ্টা করার আগে নিজেকে জানুন। নিজের আগ্রহের জায়গাগুলো চিহ্নিত করুন। নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে জোর করে কিছু করবেন না। নিজেকে মেলে ধরুন। দেখবেন, আপনি নতুন কর্মী হলেও ঠিক সেখান থেকেই সবার সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ হতে শুরু করবে।
সম্পর্কের সীমারেখা টানুন:
সহকর্মী নারী বা পুরুষ হোক, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই কাম্য। মাত্রাতিরিক্ত সৌহার্দ্য কিন্তু সুসম্পর্ক নয়, বিপদে পড়ার ফাঁদ তৈরি করে। এ জন্য অফিসে সবার সঙ্গেই সুসম্পর্কের সীমারেখা টানাও জরুরি।
সহযোগিতা করুন:
অফিস মানেই ‘দলগত অংশগ্রহণ’—সেখানে সহকর্মীরা একে-অপরকে সাহায্য করে কাজ সম্পন্ন করবেন, এটাই নিয়ম। আপনার অসহযোগিতা শুধু সেই কাজকেই প্রভাবিত করবে না, বরং সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কেও রাখবে নেতিবাচক প্রভাব। মনে রাখবেন, ভালো সহকর্মী হতে চাইলে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। নতুন কর্মীকেও মানিয়ে নিতে সাহায্য করুন।
অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দিন:
কর্মক্ষেত্রে সকলের আস্থা অর্জনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ছোট বড় সবার মতামতকে দুরুত্ব দেয়া। কর্মক্ষেত্রে যাঁরা ভালো সম্পর্ক গড়েন, তাঁরা যে অন্যের মতামতকে শুধু গুরুত্বই দেন – তা নয়, অন্যের কাছ থেকে ভালো পরামর্শ পেলে সেটা গ্রহণ করেন। ফলে একটি অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেখানে সবাই সবার মতামত নিশ্চিন্তে জানাতে পারে। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের আচরণের ফলে আপনার মতামতকেও অন্যরা গুরুত্ব দেবে।
বিনয়ী হোন:
সব সহকর্মীর সঙ্গে আচরণে কথাবার্তায় বিনয়ী হয়ে ওঠা জরুরি। উদ্ধত আচরণ মানুষকে ধীরে ধীরে একা করে দেয়। অহংকার পরিত্যাগ করে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। ধৈর্য কিংবা বিনয় কখনোই চারিত্রিক দুর্বলতা নয়, এগুলো দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্কের হাতিয়ার।
সঠিক তথ্য বিনিময় করুন:
কর্মক্ষেত্রে যে কাজটি বিরামহীন চলতে থাকে, তা হল তথ্য আদান প্রদান। মৌখিক, ইমেইল, কাজগপত্র, ফোন – বিভিন্ন মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠানে সারাদিন তথ্য বিনিময় হয় এবং এই তথ্য বিনিময় অনেকটা শরীরে রক্ত চলাচলের মত – এটা বাধাগ্রস্ত হলে পুরো প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কর্মক্ষেত্রে সবার মাঝে ভালো সম্পর্ক থাকলে, প্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে কেউ দ্বিধা করে না। আপনার সহকর্মী যদি আপনাকে ভয় পায়, অথবা অপছন্দ করে – তবে সময়মত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া আপনার জন্য কঠিন পড়বে।
পারষ্পরিক সম্মানবোধ দেখান:
মানুষে মানুষে সম্মান দেওয়া-নেওয়া থেকে সুসম্পর্কের সৃষ্টি হয়। অফিসে সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক তা-ই। যেকোনো কাজে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিন। অফিসে এ চর্চাটা সহকর্মীদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। কেননা, আপনি নিজেকে অফিসের অংশ হিসেবে মনে করলেই কেবল সহকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে, সহকর্মীরা আপনার মতামতের গুরুত্ব না দিলে অফিসের অংশ হয়ে উঠবেন কীভাবে? এ জন্য সহকর্মীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সম্মানবোধটা জরুরি।
ভাল কাজের প্রতিযোগিতা করুন:
স্কুলের বন্ধুদের চেয়ে আপন কেউ নেই। কিন্তু এই বন্ধুদের সঙ্গেই বেশি নাম্বর তোলার প্রতিযোগিতা হয়। এই প্রতিযোগিতা খারাপ তো নয়। ও ভালো করছে, আমাকে ওর চেয়ে ভালো করতে হবে—এই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলুন। কর্মক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রতিযোগিতা থাকলে সহকর্মদের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠানও উপকৃত হয়।
ষড়যন্ত্র পরিহার করুন:
পরনিন্দা, পরচর্চা কিংবা সবকিছু বাঁকা দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস অফিসের পরিবেশকে দূষিত করে তোলে। এসব বদভ্যাস থাকলে আপনি কখনোই সহকর্মীদের মন জয় করতে পারবেন না। কোনো একটি ঘটনা শুনলেই তা পাঁচ কান করার অভ্যাস সহকর্মীদের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। মনে রাখবেন, অফিসে আপনার উন্নতি কিন্তু সহকর্মীর মূল্যায়নের ওপরও নির্ভর করে।
পরিশিষ্ট:
সহকর্মীদের সাথে ভালো আচরণ ও তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখার উপকারিতা নিয়ে বলতে গেলে বলে শেষ করা যাবে না। আপনার ক্যারিয়ারের প্রতিটি পর্যায়ে, প্রতিটি ক্ষেত্রে সহকর্মীর সাথে ভালো সম্পর্ক দারুন সব সুবিধা দেবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনার কর্মদক্ষার চেয়েও এটা বেশি ফলাফল দেবে। কাজেই যতটা সম্ভব সহকর্মীদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।
আর সেই পথে এই লেখাটি যদি আপনাকে একটু হলেও সাহায্য করে – তবেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
জিয়াউল হক: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক, নেক্সাস টেলিভিশন।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়