সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

আইসিডিডিআরবি`র গবেষণা

বাংলাদেশে শিশুদের সুরক্ষা দিচ্ছে না অ্যান্টিবায়োটিক, মৃত্যু বাড়ছে

নিউজ ডেস্ক

২২:৩৮, ১৫ জুলাই ২০২১

৬৮৪

আইসিডিডিআরবি`র গবেষণা

বাংলাদেশে শিশুদের সুরক্ষা দিচ্ছে না অ্যান্টিবায়োটিক, মৃত্যু বাড়ছে

আইসিডিডিআর,বি এবং ম্যাসাচুসেটস জেনেরাল হসপিটাল (এমজিএইচ)- এর গবেষকদের পরিচালিত একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগজীবাণু প্রতিরোধী হয়ে উঠছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই গবেষণার ফলাফল ওপেন ফোরাম ইনফেকশাস ডিজিজেস জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগজীবাণুর প্রতিরোধী হয়ে ওঠা একটি সম্ভাব্য মারাত্মক মহামারীর সৃষ্টি করতে পারে যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যেতে পারে।

আইসিডিডিআর,বি-র নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি, এমমেড, পিএইচডি এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। ড. চিশতি এই গবেষণা পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যখন তিনি দেখতে পান যে, আইসিডিডিআর,বি-র হাসপাতালে অনেক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত কমবয়সী শিশু ভর্তি হচ্ছে যারা উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার বিরুদ্ধে উচ্চ মাত্রায় প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত। 

“আমাদের হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত অ্যান্টিবায়োটিক এবং শ্বাসতন্ত্রের উন্নততর চিকিৎসা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক ডজন শিশু নিউমোনিয়ায় মৃত্যৃবরণ করে।”
- ড. মোহাম্মদ যোবায়ের চিশতি

নিউমোনিয়া হল ফুসফুসের একটি সংক্রমণ যার ফলে এর বায়ু থলিগুলোতে তরল পদার্থ ও পুঁজ জমা হয় এবং এতে কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। কার্যকর চিকিৎসা ছাড়া এই সংক্রমণ প্রাণহানিকর হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ নিউমোনিয়া। কমবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ভাইরাসের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার কারণেও নিউমোনিয়া হতে দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য উচ্চ-আয়ের দেশে স্ট্যাফিলোকক্কাস (“স্ট্যাফ”), স্ট্রেপটোকক্কাস (“স্ট্রেপ”) এবং হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার সবচেয়ে কারণ, যা সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে চিকিৎসার মাধ্যমে উপশম হয়। শেষের দু’টি জীবাণুর ক্ষেত্রে টিকা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য জীবন রক্ষা করেছে।

যখন ড. চিশতি এবং তার সহকর্মীরা ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পাঁচ বছরের কমবয়সী ৪,০০০-এরও বেশি শিশুর স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত রেকর্ড পরীক্ষা করলেন, তখন তাঁরা দেখতে পেলেন যে ব্যাকটেরিয়াজনিত একদম ভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য স্থানে নিউমোনিয়ার জন্য দায়ী সাধারণ স্ট্যাফ ও স্ট্রেপের কারণে সংঘটিত সংক্রমণের হার এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ছিল। এসব শিশুর মধ্যে যাদের পজিটিভ কালচার ছিল তাদের মধ্যে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যকটেরিয়া ৭৭%  সংক্রমণের জন্য দায়ী ছিল, এসব জীবাণুর মধ্যে ছিল সিউডোমোনাস, ই. কোলাই এবং  ক্লেবসিয়েলা, প্রভৃতি।

এই গবেষণার সহ-প্রধান লেখক ও ম্যাসাচুসেটস জেনেরাল হসপিটাল ফর চিল্ড্রেন-এর পেডিয়ট্রিক গ্লোবাল হেলথ বিভাগের প্রধান ড. জেসন হ্যারিস, এমডি, এমপিএইচ বলেন, “বোস্টনে আমি যে কাজ করি তার থেকে এই বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।” তিনি আরও বলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, এসব শিশুর মধ্যে আমরা যে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দেখেছি সেগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।” এই গবেষণায় পাওয়া প্রায় ৪০% গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় সচরাচর ব্যবহৃত প্রথম- ও দ্বিতীয়-স্তরের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধকে প্রতিরোধ করে। আরও উদ্বেগের বিষয় হল, যেসব শিশুর ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ ছিল না তাদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৭ গুণ বেশি ছিল।
ড. হ্যারিস মনে করেন এসব গবেষণালব্ধ ফলাফল সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত তুলে ধরে যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এমন দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ এখন আর তাত্ত্বিক নয়, বরং এই সমস্যা ইতিমধ্যেই শেকড় গেড়ে বসেছে। 

“এসব শিশু ইতিমধ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার কারণে অকালে মারা যাচ্ছে, এবং এই একই কারণে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ভয়াবহ সংক্রমণের সৃষ্টি হবে।” 
- ড. জেসন হ্যারিস

আইসিডিডিআর,বি-র এক্সকিউটিভ ডিরেক্টর ও এই গবেষণার জেষ্ঠ্য গবেষক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে যেসব কারণে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঘটনা ঘটছে সেগুলোর সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদেশে যারা বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না তারা প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ কিনতে পারে এবং অনেক মানুষ আমাশয়, সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো সাধারণ অসুস্থতায় নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে নিজেদের চিকিৎসা করে থাকে। 

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার বৃদ্ধি করে। ড. আহমেদ আরও বলেন, “আমরা হয়তো অ্যান্টিবায়েটিক ব্যবহারের যথাযথ তত্ত্বাবধান, বিশেষ করে হাসপাতালে ভর্তি নেই এমন মানুষদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের উন্নয়ন সাধন করে এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ-সংক্রান্ত সমস্যা হ্রাস করতে পারি।” দেশে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ শনাক্ত করার মতো ল্যাবও অপ্রতুল। “এছাড়া, পরিষ্কার পানি ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিস্তারে বড় কারণ হিসেবে কাজ করে।” 

তিনি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বলেন যে, স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর উন্ন্য়ন এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে এমন নীতিমালার পরিবর্তন একান্ত অপরিহার্য, যদিও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থারও প্রয়োজন সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম উন্নততর অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সুযোগ লাভ করা।

ড. হ্যারিস বলেন, যদি এসব এবং অন্যান্য পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করা না হয় তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের এই মারাত্মক সমস্যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। বর্তমানের আরেকটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটের সাথে তুলনা করে তিনি বলেন, “আমরা জানি যে, ভ্রমণকারীদের মধ্যে সচরাচর অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ গড়ে উঠতে দেখা যায়, এবং যখন বিশ্বের একটি অংশে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী রোগজীবাণু গড়ে ওঠে, তখন তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কোভিড-১৯ যদি একটি জলোচ্ছাস হয়ে থাকে তবে উদ্ভবশীল অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সমস্যা একটি বন্যার পানির মতো। এবং বাংলাদেশের শিশুরা ইতিমধ্যেই এতে তলিয়ে যাচ্ছে।”
ড. হ্যারিস হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবেও নিয়োজিত আছেন। ড. হ্যারিস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ থেকে অর্থায়ন পেয়েছেন। আইসিডিডিআর,বি-তে বাংলাদেশ, কানাডা, সুইডেন এবং যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নের সাহায্যে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank
স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বাধিক পঠিত