৩৫তম ফোবানা সম্মেলনে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত
৩৫তম ফোবানা সম্মেলনে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত
থ্যাংকস গিভিংয়ের ছুটিতে গত ২৬ থেকে ২৮ নভেম্বর ওয়াশিংটন ডিসির গেলড ন্যাশনাল রিসোর্ট এন্ড কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো প্রবাসী বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলা ফোবানা কনভেনশন। ৩৫তম সম্মেলনের এই অনুষ্ঠানে তৃতীয় দিন দুপুর দুইটায় সকল ধর্মের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় আন্তঃধর্মীয় কনফারেন্স।
কনফারেন্সের বিভিন্ন অংশজুড়ে ছিল- ইন্টারফেইথ প্রেয়ার, পিস ডায়লগ, প্যানেল ডিসকাশন, মেডিটেশন, এওয়ার্ড সিরিমনি এবং হারমনি সেলিব্রেশন। এরপর আন্তধর্মীয় প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে কনফারেন্সটি শেষ হয়। অতিথিদের বক্তব্যে উঠে আসে শান্তির বার্তা।
ইন্টারফেইথ সেন্টার অব ইউএসএ-এর উদ্যোগে পরিচালিত হয় এই আন্তঃধর্মীয় কনফারেন্সে। এতে বিভিন্ন ধর্মের স্কলার ও নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ইন্টারফেইথ সেন্টার অব ইউএসএ-এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্বে এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারী সুখেন গমেজ কনফারেন্সটি পরিচালনা করেন।
ঐতিহাসিক ন্যাশনাল মসজিদ অব ওয়াশিংটনের ইমাম কাদির আব্দুস সালামের আন্তঃধর্মীয় প্রার্থনার মাধ্যমে কনফারেন্স শুরু হয়। জাতিসংঘের এনজিও বিষয়ক প্রতিনিধি ডক্টর রেমী আলাপো, গ্রেটার গ্রেস মিনিস্ট্রির বিশপ ডক্টর এডুয়ার্ট বারনেট, ইন্টারন্যাশনাল বুডিস্ট সেন্টারের প্রেসিডেন্ট কাতোগোসতোতা উপারানাতারা মাহাথেরা নিজ নিজ ধর্মের পক্ষে সার্বজনীন প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেন।
ডক্টর রেমী আলাপো তার বক্তৃতায় বলেন, পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধর্মই শান্তির কথা বলে। যারা ধর্মের অনুসারী তাদের মধ্যে অনেক নেতিবাচক বিষয় থাকতে পারে কিন্তু ধর্মের মধ্যে কোনো নেতিবাচক বিষয় নেই। ধর্ম শুধু শান্তির বার্তা দেয়। তাই ধর্মকে আশ্রয় করে অপরাধ করা জঘন্য ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, ধর্মের নামে হানাহানির যে ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি, সেটা মূলত ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে ঘটে। কাউকে বাদ দিয়ে অর্থাৎ কোনো মানুষকে বাদ রেখে সম্প্রীতি হতে পারে না, সেটা যে ধর্মের বা যে জাতিগোষ্ঠীরই হোক না কেন। সম্প্রীতি তৈরি করতে হবে মানুষে-মানুষে, নির্দিষ্ট কোনো ধর্মে নয়।
ডক্টর এডুয়ার্ট বারনেট বলেন, পৃথিবীর সব ধর্মের মধ্যে একটা মিল আছে। একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই প্রতীয়মাণ হবে যে, তারা একই শান্তির কথা বলছে, মানবতার কথা বলছে। অথচ আমরা সেগুলোকে গ্রহণ না করে যে অল্প কিছু অমিল আছে, শুধু সেগুলো নিয়েই কথা বলি।
বারনেট বলেন, ধর্ম সম্পর্কে আসলে আমরা খুব কমই জানি। যতটুকু জানি, সেটা শুধু নিজের ধর্ম সম্পর্কে। আমরা মনে করি, আমি এক ধর্মের অনুসারী বলে আরেকটি ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা সঠিক চিন্তা হতে পারে না। প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থ পড়তে হবে। প্রত্যেক ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। অন্য ধর্মে কি লেখা আছে সেটা যদি আমি জানি, তাহলে আমার মধ্যে ওই ধর্ম সম্পর্কে কোনো বিদ্বেষ থাকবে না।
কাতোগোসতোতা উপারানাতারা মাহাথেরা বলেন, বর্তমান পৃথিবীতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, এটাকে মোকাবেলা করতে হবে ধর্মের শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে। অন্য ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল হবে। অন্য কেউ নয়, তারা আসলে আমাদেরই ভাই। সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে এই বিশ্বকে শান্তিময় করে তুলতে হবে, এটাই হোক প্রত্যেক ধর্মের মূলসুর।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছেন নিউইয়র্কের হেইওয়া পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন ফাউন্ডেশন অব নিউইয়র্কের প্রতিষ্ঠাতা ড. টি কে নাগাশাকি। তিনি বলেন, আমাকে আমন্ত্রণ জানানো জন্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ওয়াশিংটনে সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারলে আমার ভালো লাগতো, কিন্তু অসুস্থকার কারণে সেটা সম্ভব হলো না।
ড. নাগাশাকি আরও বলেন, সম্ভবত পৃথিবীর সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দগুলোর একটি শান্তি। কিন্তু বর্তমান পৃথিবীতে এর বড়ই অভাব। বিষয়টা আসলে কী, কীভাবে এটা সমাজে প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সেই কাজটিই করে যাচ্ছে ইন্টাফেইথ সেন্টার অব ইউএসএ। আমি এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইতে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
হেইওয়া পিস অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন ফাউন্ডেশন অব নিউইয়র্কের এই প্রতিষ্ঠাতা বলেন, নিজের ধর্মই একমাত্র শ্রেষ্ঠ ধর্ম- এই চিন্তাকে আমি ভুল মনে করি। এমন উগ্রবাদী চিন্তা থেকেই মানুষ মূলত অন্য ধর্মের লোকের ওপর আক্রমণ করে বসে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দুর্বল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর যেসব আক্রমণ হয়, তা এই উগ্রবাদী চিন্তার ফল বলে মনে করি।
অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে ইন্টারফেইথ সেন্টার অব ইউএসএ-এর প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সংগঠনের পরিচিতি এবং কার্যক্রম তুলে ধরেন। এরপর ওয়ার্ল্ড ইয়োগা কমিউনিটির চেয়ারম্যান এবং জাতিসংঘের বিশেষ পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত গুরু দীলিপজি মহারাজ মেডিটেশন পরিচালনা করেন।
ফোবানা সম্মেলনের আহŸায়ক জিআই রাসেল এসময় উপস্থিত থেকে নেতৃবৃন্দকে শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, এমন একটি সেশন নিঃসন্দেহে ফোবানা ৩৫তম সম্মেলনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। ফোবানার পক্ষ থেকে ইন্টাফেইথ সেন্টার অব ইউএসএ-এর কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এমন সুন্দর আয়োজনের জন্য। আশাকরি, ফোবানার পরবর্তী সম্মেলনগুলোতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
অনুষ্ঠানে বিশ্ব শান্তি ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের ওপর বিশেষ প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন বিদিতা রহমান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই একটা পশুবৃত্তি ঘুমিয়ে থাকে। ক্ষমতা পেলে অন্যকে মানুষ বলে গণ্য না করার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এই পয়েন্টে ধর্ম বলছে, যত বেশি উপরে উঠবে, যত বেশি ক্ষমতা পাবে তত বেশি বিনয়ী হবে।
বিদিতা তার প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করেন, আমি যদি ভাবি, আমার মতবাদ বা আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, তখন অন্য ধর্মগুলো স্বাভাবিকভাবেই গৌণ হয়ে পড়ে। এতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। অথচ মানুষকে ভালো না বাসলে প্রভুকে ভালোবাসা যায় না। আগে পাশের মানুষটিতে ভালোবাসতে হবে, শ্রদ্ধা জানাতে হবে, সম্মান করতে হবে। তারপর আসে শ্রষ্ঠার আরাধনার বিষয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য প্রদান করেন- ইউনিভার্সেল পিস ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি তমিকো দুগান, মেট্রোপলিটন ওয়াশিংটন ডিসির বেদিক কালচারাল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তপন দত্ত, বিডি খ্রীষ্টান নিউজের সম্পাদক বিপুল এলিট গলছাভেস, জেরিমি বিশপ জুনিয়র, রাজ সুসান বুসান। তাদের বক্তব্য শেষে ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
তমিকো দুগান বলেন, শান্তি ব্যাপারটা চর্চার বিষয়। এটা আত্মস্থ করার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। চাইলেই কোথাও থেকে শান্তি উড়ে আসে না। তাই চর্চা আর উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আমাদের সহনশীলতা অর্জন করতে হবে। তাহলেই অপর ধর্মের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হবে।
বিপুল এলিট গলছাভেস বলেন, বিশে^ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ধর্মের কাছেই আশ্রয় নিতে হবে। ধর্মহীন পৃথিবী শুধু অস্থিরতা, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ বাড়াবে, আর কিছু নয়। অন্য ধর্মের সঙ্গে অমিল নয়, মিলনের অংশটুকু খুঁজতে হবে।
তপন দত্ত তার আলোচনায় বলেন, সংঘাত থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষকে ভালোবাসা। কে হিন্দু, কে মুসলিম, কে মুচি- এই ভেদাভেদের ঊর্দ্ধে যদি উঠতে না পারি তাহলে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হবে না। সব সময় মাথায় রাখতে হবে, আমরা সবাই মানুষ। মানুষকে বাদ দিয়ে, মানুষকে দূরে সরিয়ে কোনো সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা হবে না। আমরা যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তখন নিজ ধর্মের মানুষের জন্য করবো না, সমগ্র মানবজাতির জন্য করবো। আমাদের প্রার্থনার মধ্যেও যেন কোনো ভেদাভেদ না থাকে।
জেরিমি বিশপ জুনিয়র বলেন, সব ধর্মের মানুষকে সম্প্রীতির মন্ত্রে এক করাই হচ্ছে ধর্মীয় সংঘাতের সমাধান। মানুষ হিসেবে নিজেকে বড় মনে না করে আমরা যদি বিনয়ী হই, নত হই তাহলে সংঘাত অনেকাংশে কমে যাবে। সংলাপের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতাবোধ জাগাতে হবে। সেজন্য এমন আন্তঃধর্মীয় আয়োজনগুলো যত বেশি করা যাবে ততই মঙ্গল।
রাজ সুসান বুসান বলেন, ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির আজকের বাস্তবতায় আন্তঃধর্ম আলোচনা কোনো বিকল্প নেই। এসব আলোচনা সভার মাধ্যমে দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করি। অনগ্রসর কিংবা নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকা এবং মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠা আমাদের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, আন্তঃধর্মীয় সংলাপসহ বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে সমাজে শান্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার মহান লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে ইন্টারফেইথ সেন্টার অব ইউএসএ। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষকে একটি প্ল্যার্টফর্মে বসিয়ে জ্ঞান বিনিময় ও রিলিজিওয়াস হারমনি সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- ডা. ফারজানাকে অভিনন্দন
- ওরে বাব্বা কত পিঠার কত নাম!
- রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের পাসপোর্ট সেবার অনলাইন কার্যক্রম ফেসবুকে ল
- মাকে হারালেন আজিজ আহমদ
- স্বজনদের শেষ মাটি দিতে না পারা প্রবাসীদের জীবনে বড় কষ্ট
- বিনা সাক্ষাৎকারে
ভ্রমণ, ব্যবসা ও মেডিকেল ভিসার আবেদন নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস - দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম হিসেবে
এনওয়াইপিডির লে. কমান্ডার হচ্ছেন বাংলাদেশি আমেরিকান শামসুল হক - কানাডায় পেস এর উদ্যোগে বর্ণবাদ বিরোধী কার্যক্রম শুরু
- নিউইয়র্কে আগ্রাবাদ নাইট, এক মুখরিত সন্ধ্যার গল্প
- বিদেশি সিইও নয়, ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা পাবেন নিজ দেশে কাজের সুযোগ