রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সত্যিই কি ‘অপু’র বিদায় হয়!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

১৩:৩৮, ১৫ নভেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৫:৩৪, ১৮ নভেম্বর ২০২০

১৪৫৬

সত্যিই কি ‘অপু’র বিদায় হয়!

সেই নিশ্চিন্দিপুর গ্রাম থেকে কলকাতায় থিতু হয়ে লেখক হতে চাওয়া অপুর স্বপ্ন-জীবনসংগ্রাম আর পাণ্ডুলিপি ছিড়ে উড়িয়ে সেই স্বপ্নভঙ্গের প্রকাশের কষ্ট কি ভুলেছে কেউ? নাকি ভোলা যায়! 

মনে গেঁথে আছে, সমাপ্তির মৃন্ময়ীকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলা সেই লাজুক প্রেমিক মুখটি। আর ‘অমল’ নামটি চিরকালের মতো যেন শুধুই চারুলতার। স্বদেশী সন্দীপের কণ্ঠের ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান স্মৃতিকে ফিরিয়ে নেয় ঘরে-বাইরের ঠাকুর দালানে। 

এসব ছাড়াও, সাঁতারের কোচ ক্ষিতিদার দুর্দান্ত লড়াকু চরিত্র, অশনি সংকেতের গঙ্গাচরণ, হীরক রাজাকে ধারশায়ী করা বিপল্বী মাস্টারমশাই বা সত্যজিতের অনবদ্য সৃষ্টি বিখ্যাত গোয়েন্দা ফেলুদা আর এইতো মাত্র বছর কয়েক আগের বেলাশেষের স্বাধীনচেতা দুর্নিবার চরিত্রের প্রবীণ বিশ্বনাথ। এমন হাজারো মনে রাখবার মতোন সিনেমায় তিনিই মধ্যমণি, সর্বত্র তিনিই সাতপাকে বাঁধা।

৬ দশক ধরে সেলুলয়েড শাসন করে যাওয়া দাপুটে কিংবদন্তী। তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। যাকে নিয়ে বলা শুরু করা যায়, কিন্তু শেষটায় দাঁড়িটানা কঠিন। অসামান্য অভিনয়গুণে আর যাপিত জীবনে ক্ষণজন্মা এই মানুষটি বাংলা ও বাঙালির জীবনে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ইতিহাস। বলতেন, তার মনমননে শুধু রবীন্দ্রনাথ, রবি সৃষ্টিতে তিনি বেশি মিশেছেন অস্থিমজ্জায়। 

প্রথমত তিনি অভিনেতা ছিলেন। কিন্তু কবিতাচর্চা, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন তার বিপুল বৈচিত্র্যতা ও কর্মময় পথচলার একেকটি দিক। সবকিছুতেই অনন্য। তিনি এমনই এক শিল্পী, যার মূল্যায়নে শব্দ থেমে যায়। সেই মানুষটির সময় আজ চিরতরে থেমে গেল। জীবন-মৃত্যুর মাঝের সুক্ষ্ম রেখাটির বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তিনি চলে গেছেন শেষ গন্তব্যে।

দরাজ কন্ঠ, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চাহুনীর শক্তিশালী এই অভিনেতা জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি। জীবনের প্রথম ১০টা বছর সৌমিত্র কাটিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে। আদি বাড়ি ছিল বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কাছে কয়া গ্রামে। বাড়িতে নাট্যচর্চার পরিবেশ ছিল। ছোটবেলা থেকেই নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। পড়াশোনা হাওড়া জেলা স্কুল, স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতার সিটি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিষয় বাংলা সাহিত্য।

কলেজের ফাইনাল ইয়ারে হঠাৎ একদিন মঞ্চে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখার সুযোগ হয় সৌমিত্রর। সেদিনই জীবনের মোড় ঘুরে যায় তার। তিনি পুরোদস্তুর নাটকে মন দেন। শিশির ভাদুড়ীকে গুরু মানতেন সৌমিত্র। নিজেই বলেছেন, অদ্ভুত এক বন্ধুত্ব ছিল তার সঙ্গে।

অপুকে সত্যজিৎ আবিষ্কার করে ১৯৫৯ এ, পরের ইতিহাস জয়যাত্রার। কারণ এখান থেকেই সৌমিত্রতে কেন্দ্রীভূত হলো সিনেমাপ্রেমীদের দৃষ্টি। সৌমিত্র নিজেও বলতেন, অপুর চরিত্র যে খ্যাতি তাকে এনে দিয়েছে, এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু নেই। তারও আগে রেডিওর ঘোষক ছিলেন। 

সত্যজিতের ৩৪টি সিনেমার ১৪টিতেই দোর্দণ্ড প্রতাপে কাজ করেছেন তিনি। সত্যজিত এও বলেছেন, তিনি সৌমিত্রকে মাথায় রেখেও অনেক গল্প বা চিত্রনাট্যগুলো লিখেছেন। বিশেষ করে ফেলুদা চরিত্র চিত্রনাট্যে অঙ্কিত হয়েছে শুধুমাত্র সৌমিত্রের অবয়বেই। তুলনাহীন অভিনয় গুণে শাণিত বুদ্ধির ফেলুদা একাকার হয়েছেন সৌমিত্রতে। 

পরবর্তীতে তিনি মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অজয় করের মতো পরিচালকদের সাথেও কাজ করেছেন। মাতিয়ে দিয়েছেন সিনেমাজগত। রূপালী পর্দা ছাড়াও বহু নাটক এবং টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। লিখেছেন কবিতা, নাটক, করেছেন পরিচালনাও।

সৌমিত্র অভিনীত শতাধিক সিনেমার মধ্যে বেশিরভাগই মনে রাখবার মতো, ব্যবসা সফলতো বটেই। উল্লেখযোগ্য অপুর সংসার, ক্ষুদিত পাষাণ, দেবী, তিন কন্যা, ঝিন্দের বন্দী, চারুলতা, বাক্স বদল, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, সাত পাকে বাঁধা, তিন ভুবনের পারে, পরিণীতা, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ, আবার অরণ্যে, বেলাশেষে। 

বাংলা চলচ্চিত্রের এই দিকপাল ২০১২ সালে পেয়েছেন ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। এ ছাড়া আরও পেয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্রান্সের ‘লেজিয়ঁ দ্য নর’ পুরস্কার (২০১৮)। পেয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মভূষণসহ (২০০৪) ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র, সংগীত, নাটক একাডেমি, ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার।

চেয়েছিলেন জীবনের ইনিংসে সেঞ্চুরি করবেন। হলো না। এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আমিও চূড়ান্ত বিপর্যয়ে নিজেকে বলি, ফাইট, সৌমিত্র ফাইট।’ 

কিন্তু সব যুদ্ধেতো জেতা যায়না। মৃত্যুর কাছে এই যোদ্ধাকে শেষমেশ হার মানতেই হলো। তবে অসামান্য অভিনয় দক্ষতা আর সাবলীলতাই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না। সব কথার শেষ কথা, সৌমিত্রকে হারানোর শোক আর অপূর্ণতার সত্যিই কোনো তল নেই, নেই কূলকিনারা।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank