সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ || ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ইতিহাসের দিঘল বাঁক থেকে রূপসা নদীর বাঁকে

শ্যামল কান্তি ধর

১১:৩০, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১১:৩৩, ২৩ জানুয়ারি ২০২১

২৩২৪

ইতিহাসের দিঘল বাঁক থেকে রূপসা নদীর বাঁকে

তানভীর মোকাম্মেলের “রূপসা নদীর বাঁকে” চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র মানব মুখোপাধ্যায়, দক্ষিণাঞ্চলের বাম রাজনীতিবিদ বিষ্ণু চট্টপাধ্যায়ের ছায়াছবি হয়েই যেন  ইতিহাসের নানা বাঁক থেকে আমাদের ভ্রমণ করিয়ে আনেন। রূপসা নদীর বাঁক থেকে আমরা ফিরে যাই স্বদেশী আন্দোলন, বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, তেভাগা আন্দোলন, দেশভাগ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, ভাষা আন্দোলন, গনঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনে। ইতিহাসের বাঁক থেকে উঠে এসে বিষ্টু ঠাকুর যেন মানব মুখোপাধ্যায়ের মাঝে হয়ে উঠেন কমরেড ঠাকুর। বিষ্ণু চট্টপাধ্যায় আজীবন শাসকের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে পরিচিতি পেয়েছিলেন বিষ্টু ঠাকুর হিসেবে। স্বদেশী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিল তার সরব উপস্থিতি। কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে, জমিদারতন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, লাঠিয়াল ও পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, হাজার হাজার কৃষক শ্রমিক নিয়ে শোভনার প্রজাবান্ধি বাঁধ নির্মাণ করে তিনি আজও কিংবদন্তি।

সিনেমার শুরুতেই একটি  প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রী ঊর্মিমালা যখন রবীন্দ্র সংগীত গায়, তখন বালক মানব মুখোপাধ্য্যায়ের কন্ঠে ক্ষুদিরামের গান যেন তার ভবিষ্যতের সংগ্রামী নেতা হয়ে উঠারই বার্তা দেয়। তবে বিদ্যালয়ের পরিবেশ আরেকটু উৎসবমুখর করে চিত্রায়িত করলে বোধহয় আরো ভালো হত। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে নায়কের বালক থেকে যৌবনে পদার্পনের দৃশ্যায়ন বিভিন্ন বিচিত্রতায় উপস্থাপন করা হয়। রূপসা নদীর বাঁকেও তার ব্যতিক্রম ছিলনা, তবে তানভীর মোকাম্মেল তার নিজস্ব শৈলীতেই তা উপস্থাপন করেন।  হারিকেনের আলোয়, বিছানায় শুয়ে বালক মানব যখন “রামের সুমতি” পড়ছে তখন ক্যামেরা প্যান করে বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ হয়ে দেয়ালে ঝুলানো মার্ক্স, লেনিনের ছবিতে আসে, তখন বালক মানবকে যুবক হিসাবে দেখা যায় এবং অনেকদিন পর জাহিদ হোসেন শোভনকেও বড়পর্দায় দেখা গেল। বোঝা গেল, নিয়মিত সাহিত্যচর্চা ও লালমলাটের বই পড়ে একজন বাম তাত্ত্বিক হিসাবেই বড় হয়ে উঠলেন মানব।

যেখানেই সামন্তবাদ কিংবা সাম্রাজ্যবাদ মাথাচাড়া দেয়, সেখানেই কিছু মানুষ সংশপ্তকের মতই বিপ্লবের লাল পতাকা শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যান, যারা বিপ্লবের শক্তি বাহুর চেয়ে বুকে ধারণ করেন বেশী। অনুশীলন সমিতি থেকে শুরু করে মানব সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ান গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে। জমিদারের বানানো ভাঙা বাঁধ দিয়ে নোনাজল ঢুকে যখন ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে, তখন জমিদার বাঁধ নির্মানের বদলে মাছের ঘেরের স্বপ্ন দেখেন। জমিদারের লাভের স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান মানব। কৃষকদের সাথে নিয়ে প্রজাবান্ধী বাঁধ নির্মান করেন যাতে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করে। যেমন করেছিলেন বিষ্ণু চট্টপাধ্যায়। কৃষকদের বিশ্বাস ছিল  বিষ্ণু চট্টপাধ্যায় বাঁধের উপর দিয়ে হেটে গেলে সেই বাঁধ ভাঙবেনা।  

এভাবে রূপসা নদীর বাঁকের মানব মুখোপাধ্যায়ও একদিন কৃষকের কাছে কমরেড ঠাকুর হয়ে যান। মানব মুখোপাধ্যায় যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গ্রামে আসেন, তখন গ্রামবাসীদের মিলিত কন্ঠের উচ্ছ্বাস, শঙ্খধ্বনি, লাল সেলাম, কমরেড মানবের জনপ্রিয়তাই প্রকাশ করে। কমরেড ঠাকুরের কাছ থেকে সমাজতন্ত্রের সহজ পাঠ পেয়ে বুর্জোয়া শব্দটির অর্থটিও তারা তাদের মত করে বুঝে নেয়। যেমন, একজন কৃষক মানব মুখোপাধ্যায়কে জানান, আক্কাস বুর্জোয়া হয়ে গেছে কারণ আক্কাস এখন চিড়ার সাথে হাত মুঠো করে গুড় খায়!  প্রজাবান্ধি বাঁধ নির্মাণের ফলে বিস্তীর্ণ মাঠ আবার সোনালী ধানে পরিপূর্ণ হয়। এরপর তেভাগা আন্দোলনের  জোয়ারে  কৃষক তিন ভাগের দুই ভাগ ধানও তাদের গোলায় তোলতে পারে।

রূপসা নদী যেন তার বুকে শ্রেনী সংগ্রাম, মুক্তি সংগ্রাম, দেশভাগের কষ্টের ইতিহাস ধারন করে মানব মুখোপাধ্যায়েরই বিভিন্ন সংগ্রামের সাক্ষ্য দিচ্ছে,  যিনি সারা জীবন কৃষকদের কল্যাণের কথা, নিপীড়িত মানুষের কথা ভেবে নির্যাতিত হলেন, সংসার বিবাগী হলেন। জেলে থাকা অবস্থায় শুনতে হল তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ।সারাজীবন অকৃতদার থাকলেন, তার প্রতি ঊর্মিমালার প্রেমকেও তিনি উপেক্ষা করলেন।

আমরা স্মরণ কর‍্তে পারি সেই দৃশ্যের, যেখানে ঊর্মিমালা সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত নিজ হাতে মানবের প্রিয় খাবার রান্না করে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে তার প্রিয় মানবদার জন্য। ঊর্মিমালার এ অপেক্ষার প্রহর যেন সিনেমার ভেতর আরেকটি সিনেমা হয়ে যায়, যেখানে ক্যামেরা তার নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। পুরো সিনেমায় সংলাপ এবং বিভিন্ন ফুটেজ প্রাধান্য পেলেও, মানবের জন্য ঊর্মিমালার এ অপক্ষার উৎকণ্ঠা প্রকাশে  সিনেমার একান্ত  নিজস্ব ভাষার প্রয়োগ হয়েছে। স্থির ফ্রেমে পুরনো বাড়ির দেয়ালে, উঠানে আলোছায়ায় খেলা, উর্মিমালার অপেক্ষার চোখ এক প্রেমময় অনভুতির সৃষ্টি করে। কিন্ত বিপ্লবী মানবের কাছে ঊর্মিমালার  ‘নিমন্ত্রণ' এ বাড়িতে প্রতিদিনের খাবার গ্রহণের মত ছিল। কমরেড বিপ্লবী  ঊর্মিমালার এ নিমন্ত্রণ বুঝলেন না কিংবা এড়িয়ে গেলেন। ঊর্মিমালার অপেক্ষার চোখ থেকে দুপুর ও বিকেলের নরম আলো ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে যখন সন্ধ্যা নামল, তখন তুলসীতলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানোর সময়, সন্ধ্যার রঙ নিয়ে মানব আসেন। মানবের বিপ্লবী মনের কাছে ঊর্মিমালার এ নিমন্ত্রণ আলাদা কোনো অর্থ বহন করলনা, তাই উর্মিমালাকেও একদিন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হল। সাতপাঁকের সময় যখন ঊর্মিমালা মানবের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়, তখন  সেই চোখে হাজার কথা বলা হয়ে যায়। ঊর্মিমালা অবশ্য মানব মুখার্জির সাথে শেষ পর্যন্ত চিঠির মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গেছেন।

তানভীর মোকাম্মেলের  আরেকটি সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র “চিত্রা নদীর পারে”তে দেশ বিভাগের বিস্তারিত চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। দেশ বিভাগ নিয়ে সীমান্তরেখা নামে রয়েছে তার আরেকটি তথ্যচিত্র। রূপসা নদীর বাঁকেতে মানব যখন মকবুলের পোয়াতি স্ত্রীর খোঁজখবর নিতে তার বাড়িতে যান এবং মকবুলকে পাকিস্তান সৃষ্টির খবর দেন, তখন সে বেদনার্ত হয়ে বলে, আমাদের পাকিস্তান হলেই কি আর হিন্দুস্থান হলেই কি,আমার সন্তানটাই মারা গেল! মৃত সন্তানের জন্য মকবুলের স্ত্রীর গগনবিদারী চিৎকার যেন দেশভাগের যন্ত্রণা, হতাশা, কষ্টের  সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

তানভীর মোকাম্মেল খাপড়া ওয়ার্ডের রাজবন্দি কমিউনিস্ট নেতাদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করার নির্মম ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন। খাপড়া ওয়ার্ডের জেল সুপার বিলের অন্যায় আচরণের প্রতি মানব মুখোপাধ্যায়ের প্রতিবাদের দৃশ্যায়ন আরো নতুন মাত্রা যোগ করে। বিলকে স্যালুট না করায় সে যখন  মানব মুখোপাধ্যায়ের উপর দশটি চাবুকের আঘাতের নির্দেশ দেয় এবং তা প্রতিপালিত হয়, তখন মানব মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে উচ্চারিত “ হ্যাভ ইউ গট ইওর স্যালুট, বিল?” সংলাপটি কমিউনিস্ট নেতাদের শত বাধা ও নির্যাতনে অবিচল থাকাকেই মনে করিয়ে দেয়। বিলের চরিত্র চিত্রনে সংশ্লিষ্ট অভিনেতা সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন। জেলে দীর্ঘ বছর বন্দি জীবন কাটিয়ে প্রবীণ মানব মুখোপাধ্যায় যখন বেরিয়ে আসেন, তখন মানব মুখোপাধ্যায়ের  চরিত্রে শোভনের বদলে খায়রুল আলম সবুজেকে দেখা যায়। যদিও খায়রুল আলম সবুজ তার অভিনয় প্রতিভার পুরোটাই ব্যবহার করেছেন, তবু হঠাৎ করে মানবের চরিত্রে সবুজের আবির্ভাব কিছুটা ধাক্কা দেয়। মনে হল মানব মুখোপাধ্যায় বুঝি হারিয়ে গেলেন! তবে এ ধাক্কার রেশ বেশী সময় থাকেনা, সবুজ তার সহজাত অভিনয় গুণে ফিরিয়ে আনেন জেল ফেরত প্রবীন মানবকে।

ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক পেরিয়ে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, গনঅভ্যুত্থান শেষে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধ। জেল ফেরত মানব মুখোপাধ্যায় সক্রিয় হয়ে যান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে। সঙ্গী তার সাইকেল। সবার নিষেধ সত্ত্বেও একদিন মুসলিমলীগের এলাকায় যাবার পথে, রাজাকারদের অস্ত্রে গুলিবিদ্ধ হন কমরেড মানব। রেললাইনের উপর পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। পাশে পড়ে থাকে চিরসাথী সাইকেল। টপ শটে দেখা যায় নিথর  মানবের পাশে পড়ে থাকা সাইকেলের চাকা, যা ঘুরতে ঘুরতে এক সময় স্তব্দ হয়ে যায়। ক্যামেরা মানবের মৃতদেহের উপর থেকে লংশটে স্থির হয় সমান্তরাল রেল লাইনের উপর, কেমন এক শুন্যতার অনুভুতি হয়। মানব মুখোপাধ্যায় সময়ের পরিভ্রমণ শেষে মিলিয়ে গেলেন অসীমে, শুন্যতায়। যে মানব মুখোপাধ্যায় তার সারাজীবন সমর্পণ করেছেন শ্রেনী সংগ্রামে,কৃষকদের কল্যাণে,স্বাধীনতা সংগ্রামে, সেই মানবের মৃতদেহ পড়ে থাকে রেল লাইনের উপর একজন ‘নাস্তিক’, ‘মালাউন’ কমিউনিস্ট অভিধা নিয়ে!

স্মৃতি থেকে মানব রতন মুখোপাধ্যায়ের একটি সংলাপ উল্লেখ করে লেখাটির ইতি টানছি, ‘দুইবার বামে ঘুরলে ডানেই ঘোরা হয়, তাই কোনকিছুতেই উগ্রতা  ভালোনা’। এই অতিমারির সময়ে, অনলাইনে বিকল্প প্রদর্শনীর মাধ্যমে ঘরে বসে ছবিটি উপভোগের সুযোগ করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ তানভীর মোকাম্মেলকে ধন্যবাদ।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank