মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নাট্য-পর্যালোচনা

আরশিনগর-এর ‘সিদ্ধার্থ`: আত্ম-অনুসন্ধানের নাট্যাখ্যান

ড. ইসলাম শফিক

০০:১৪, ১২ আগস্ট ২০২৩

আপডেট: ০০:১৬, ১২ আগস্ট ২০২৩

১৪১৮

নাট্য-পর্যালোচনা

আরশিনগর-এর ‘সিদ্ধার্থ`: আত্ম-অনুসন্ধানের নাট্যাখ্যান

আরশিনগর চতুর্থ প্রযোজনা হিসেবে  ঢাকার মঞ্চে এনেছে নতুন  নাটক ‘সিদ্ধার্থ'। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে গত ৯ আগস্ট বুধবার সন্ধ্যায় উদ্বোধনী মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের থিয়েটার শিল্পে নতুন এক পালক সংযোজন হলো। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস (১৮৭৭-১৯৬২) এর লেখা অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘সিদ্ধার্থ’ অবলম্বনে এই নাট্যপ্রযোজনা। জাফর আলম অনূদিত এই উপন্যাসের নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন রেজা আরিফ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজা আরিফ  মঞ্চনাটক নির্দেশনায় দুই বাংলায় ইতোমধ্যে বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। নাট্যনির্দেশক হিসেবে  রেজা আরিফ থিয়েটারের দৃশ্য নির্মাণে নিজস্ব একটি সিগনেচার ভাষা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। থিয়েট্রিক্যাল গতি-চলন-সঙ্গীত সহযোগে মুহুর্মুহু কম্পোজিশনে নব-নব চিত্রভাষা সৃজনের মাধ্যমে মঞ্চভূমিকে তিনি  সুবিশাল নান্দনিক  ক্যানভাসে বিবর্তন করেন। রেজা আরিফ নির্দেশিত মঞ্চনাটক-‘কারবালার জারি’, ‘রহু চণ্ডালের হাড়’, ‘দ্য আলকেমিস্ট’  ও ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ ‍ভালো মানের নাট্যনির্মাণ হিসেবে দর্শক ও সুধিমহলে সমাদৃত হয়েছে। নির্দেশক রেজা আরিফ এবার হাত দিয়েছেন ভিন্ন মেজাজের উপন্যাস  ‘সিদ্ধার্থ’ আখ্যানে।

গৌতম বুদ্ধের সময়ে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণকারী "সিদ্ধার্থ" নামে এক যুবকের আধ্যাত্বিক অভিযাত্রা এবং দর্শন এই নাট্যপ্রযোজনার মূল বিষয়। প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থ একজন ব্রাহ্মণ যুবক যিনি বুদ্ধের সন্যাস গ্রহণ করে মায়াহীন আত্মিক প্রশান্তিতে ভরা জীবন কাটাতে চান, মোক্ষম লাভ করতে চান। উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণে নির্দেশকের ভাষ্য- “হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ সরাসরি গৌতম বুদ্ধ নয়- আবার একইসাথে গৌতম বুদ্ধ-ও। গৌতম বুদ্ধের ঔজ্জ্বল্যে আড়াল হয়ে পড়া গৌতমের ব্যক্তিগত মনেজগতের রঙে সিদ্ধার্থকে আঁকা হয়েছে।” মহাকারুণিক গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক। গৌতম বুদ্ধের পিতৃপ্রদত্ত নাম সিদ্ধার্থ। তবে হেরমান হেস এর উপন্যাসটি গৌতম বুদ্ধের জীবনের আদলে লেখা নয়। নাটকের সিদ্ধার্থ একজন ব্রাহ্মণ যুবক। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে জীবন কাটানোর সিদ্ধান্তে অবিচল সে। কিন্তু তাতে শান্তি না পেয়ে তিন পুনরায় ফিরে আসেন সাধারণ জীবনপ্রবাহে। পার্থিব জীবনের নেশায় মত্ত হয়ে  নিমজ্জনের পর সিদ্ধার্থের উপলব্ধি ঘটে-তারুণ্যের বেগ, যৌণসম্পর্ক, শরীরসর্বস্ব সৌন্দর্য  ও অর্থকুড়ি-সম্পদ  মানবজীবনে কোনো স্থায়ী সুখ বা শান্তি বয়ে আনে না। তাই  সিদ্ধার্থ প্রত্যাবর্তন করেন তাপস্যজীবনে। সিদ্ধার্থ  আশ্রয় নেন নদীর ধারে। নদীর কাছে থাকতে থাকতে সিদ্ধার্থ  শিখে নেন নদীর ভাষা। উপলব্ধি করেন জীবনের বৃহত্তর অর্থ। জীবন-মৃত্যু, পাপ-পুণ্য, জ্ঞান-নির্বুদ্ধিতা এগুলো সব কিছুরই প্রয়োজন রয়েছে জীবনে। এসব অভিজ্ঞতা জীবনকে পূর্ণ করে। এ অভিজ্ঞতার নামই জ্ঞান। যা কাউকে শেখানো যায় না, অর্জন করতে হয়। জীবনটাও নদীর মতো। বয়ে চলা নদীর সর্বাঙ্গে যে জল থাকে, সে জল সর্বদা নতুন। নদী তাই চির নবীন, চির প্রবাহমান, চির পূর্ণ। নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে তার গতিপথ, পর্বত, জলপ্রপাত, স্রোতধারা, খেয়াঘাট, মোহনা, সমুদ্র সবটা জুড়েই নদী থাকে। নদীর কাছে বর্তমানটাই সত্য। অতীত বা ভবিষ্যতের ছায়া পড়ে না নদীর বুকে। মনুষ্যজীবনটাও নদীর প্রবাহমানতার মতো। শিশুকাল, পরিণত বয়স বা বার্ধক্য— শুধু ছায়ার পর্দা দিয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন! আসলে নদী ও মনুষ্যজীবনে কোন পার্থক্য নেই! উভয়ই  যেন এক সুতোয় গাঁথা। মানুষের পূর্বজীবন- অতীতে হারিয়ে যায় না। ভবিষ্যতের জন্যও কিছু অপেক্ষা করে নেই। সবকিছুর অস্তিত্ব আছে বর্তমানে। দুঃখ থেকে চিরমুক্তির নাম নির্বাণ। নির্বাণ কথাটির সাধারণ অর্থ নিভে যাওয়া। প্রদীপ যেমন তেলের অভাবে নিভে যায়, তেমনি যেসব কারণে দুঃখ আসে— সেসব কারণগুলোকে সরিয়ে ফেলতে পারলে দুঃখও নির্বাপিত হয়। উপন্যাসের মঞ্চভ্রমণ শেষে দর্শক আত্ম-অনুসন্ধানের মধ্যদিয়ে একটি দার্শনিক জীবনবোধে স্নাত হন। 

দশ মিনিটের মধ্য বিরতিসহ দুই ঘণ্টা বিশ মিনিট পুরো প্রযোজনার ব্যাপ্তিকাল। অভিনয় পরিকল্পনা মুখ্যত চরিত্রানুগ হলেও কখনো কখনো বর্ণনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা লোকনাট্য পরিবেশনার তিন দিকে খোলা মঞ্চের আদলে গ্যালারিতে দর্শক বসিয়ে অভিনয় উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রযোজনার মঞ্চ রাখা হয়েছে নিরাভরণ। অভিনয়ে দ্বি-তল মঞ্চ ব্যবহারের মধ্যদিয়ে থিয়েটার ক্যানভাসের ক্ষেত্র গভীরতা ও বিশালত্বকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীর প্রবাহমনতা ও জলতরঙ্গের দৃশ্য নির্মাণ অত্যন্ত চমৎকার, থিয়েট্রিক্যাল ও নান্দনিক। কিন্তু বারংবার ব্যবহার করাতে এটার বিশেষত্ব অনেকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ট্রান্সপারেন্ট সুবিশাল সাইক্লোরামার পেছনে আসীন সংগীতদল প্রযোজনার গতি-প্রকৃতিকে দারুণভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আবহসংগীত অসাধারণ। তবে কোনো কোনো সময় মিউজিকের শব্দমাত্রা সংলাপকে ছাড়িয়ে যায়; সেসময়  অভিনেতার সংলাপ বুঝতে দর্শকের সমস্যা হয়েছে। নদীর প্রবাহমনতা ও জলতরঙ্গের দৃশ্য নির্মাণ অত্যন্ত চমৎকার, থিয়েট্রিক্যাল ও নান্দনিক। কিন্তু বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তির ফলে এটার আকর্ষণে নষ্ট হয়েছে। পোশাক পরিকল্পনা দারুণ। পোশাকের রঙ, আদল ও পোশাক পরিবর্তন কৌশল নাটকীয় ও নান্দনিক। পুরো নাটকে অসাধারণ আলোক পরিকল্পনা ও প্রক্ষেপণে  মুন্সিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে এলইডি লাইটের তীব্র রঙ ও ইনটেনসিটি অনেক সময় আবেগ কেড়ে নেয়। স্মোকের ব্যবহার কমাতে হবে পরিকল্পনা করে এবং স্মোক মেশিন থেকে বের হওয়ার সময় যে শব্দ তৈরি হয় তা স্মোক ইলিউশ্যন সৃষ্টিতে শুরুতেই দেয়াল তৈরি করে।
   
‘সিদ্ধার্থ’ প্রযোজনায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন— কাজী নওশাবা আহমেদ, ওয়াহিদ খান সংকেত, পার্থ প্রতিম হালদার, ইসনাইন আহমেদ জিম, নাজমুল সরকার নিহাত, মাঈন হাসান, শাহাদাত নোমান, জিনাত জাহান নিশা, রেফাত হাসান সৈকত, আরিফুল ইসলাম নীল, আকাশ তুহিন, পলি পারভীন, মাঈন উদ্দিন বাবু, জেরিন চাকমা, ক্যামেলিয়া শারমিন চূড়া, রাদিফা নারমিন, আজমেরী জাফরান রলি, প্রজ্ঞা প্রতীতি, ইমাদ ইভান, জিতাদিত্য বড়ুয়া, সারিকা ইসলাম ঈষিকা, প্রিন্স সিদ্দিকী প্রমুখ। তুলনামূলক ভাবে তরুণ নাট্যকর্মীদের নিয়ে এই প্রযোজনা নির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন নির্দেশক। প্রায় সকল অভিনেতার উচ্চারণ ও প্রজেকশন বেশ ভালো। তবে অভিনয় আরোও এরা বেশ ভালো করবে; সেই সম্ভাবনার দ্যুতি সকলের চোখে-মুখে দেখা গেছে। নাটকের প্রারম্ভে সিদ্ধার্থের চরিত্রে নওশাবা আহমেদ এর অভিনয় সত্যিই প্রশংসনীয়; সিদ্ধার্থের পিতার চরিত্রে পার্থ প্রতিম হালদার এর অভিনয় অনবদ্য। এছাড়া কমলা চরিত্রে জিনাত জাহান নিশা, যুবক সিদ্ধার্থ চরিত্রে নাজমুল সরকার নিহাত, বয়স্ক সিদ্ধার্থ চরিত্রে মাঈন হাসান ও মাঝি চরিত্রে রেফাত হাসান সৈকত বেশ ভালো অভিনয় করেছেন।

নির্দেশনায় বেশ কিছু কম্পোজিশন অসাধারণ নাট্যমুহুর্ত তৈরি করেছে। অভিনেতাদের ব্লকিং, মুভমেন্ট চমৎকার। তবে থিয়েটার গেমস্-এর কিছু প্রাথমিক কসরৎ দিয়ে  কয়েকটি কম্পোজিশন নির্মাণ করা হয়েছে সেসব পুরাতনের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়েছে। কমলা-সিদ্ধার্থ চুম্বন দৃশ্যটি আরও হ্রস্ব ও  নাট্যিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। সতর্ক থাকতে হবে- পাছে সাধারণ দর্শকের কাছে যেন অশ্লীল বার্তা না পৌঁছায় । নাটকের শেষ দৃশে উর্ধ্বগমনে কপিকলের ব্যবহার বেশ চমকপ্রদ ও নাট্যবিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সর্বোপরি দর্শক মিলনায়তনে প্রথম বেল শুনে প্রবেশ করার পর, যে মৃদু আলোয়-ধুপ, ধোঁয়া গায়ে পরশ মেখে নাটকের মায়াজাগতে প্রবেশ করেন- তা নাটকের সমাপনী বেল পর্যন্ত নির্দেশক তাঁর নিজস্ব নির্দেশনাশৈলি ও নাট্যগল্পের দর্শনগত তত্ত্বে দর্শককে অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে রাখতে পেরেছেন-এখানেই নির্দেশক রেজা আরিফ-এর শৈল্পিক স্বকীয়তা।    

প্রযোজনা অধিকর্তা-স্নেহাশীষ চন্দ্র দেবনাথ; প্রযোজনা ব্যবস্থাপনা-ওয়াহিদ খান সংকেত; পোশাক পরিকল্পনা- জিনাত জাহান নিশা ও নুসরাত জাহান জিসা;  মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন- অনিক কুমার ; কোরিওগ্রাফি-নুসরাত জাহান জিসা ও আকাশ সরকার; প্রপস্-অনিক কুমার ও নুসরাত জাহান জিসা; আবহসংগীত তত্ত্বাবধান- সাদমান রাব্বি অন্তর; অভিনয় নির্দেশনা-পার্থ প্রতিম হালদার। সহযোগ- নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও তাড়ুয়া।

অভিনয়কালীন সার্বিক স্পেসের ব্যবহারের কারণে, শুধু মঞ্চভূমি নয় পুরো মিলনায়তন অভিনয়ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। অভিনয়, সংগীত পরিকল্পনা কোরিওগ্রাফ, আলোক পরিকল্পনা ও ব্যবহার, পোশাক পরিকল্পনা, সেট পরিকল্পনা, প্রপস-এর ব্যবহার সবকিছুর নাট্যিক প্রয়োগ ও পরিমিত ব্যবহারের কারণে নাটকটি সুবিশাল ক্যানভাসে চিত্রিত হয়েছে। প্রযোজনা দেখে  ভালো লেগেছে। আরশিনগর এর তরুণ সব থিয়েটারকর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও নাট্যমেধার প্রকাশ ঘটেছে এই প্রযোজনায়। প্রযোজনা দলের সবাইকে অভিনন্দন ও সাধুবাদ। মঞ্চে এরকম ভালো মানের নাটক নিয়মিত আসুক। জয় হোক বাংলা নাটকের।

ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও নির্মাতা।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank