সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪ || ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

আমার নাটুকে মামা ও পাতা উল্টানোর দিনগুলো

কিযী তাহনিন

১১:৪২, ২১ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৫:৩৪, ২১ জানুয়ারি ২০২১

৪০৭০

আমার নাটুকে মামা ও পাতা উল্টানোর দিনগুলো

কান্তা সেন্ট। কেমন সুঘ্রাণ? গোলাপের? বেলি? চন্দন? কান্তা সেন্ট আমার  খুঁজতে থাকা প্রথম সুঘ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের গল্পে। ভাই গেল যুদ্ধের ট্রেনিং শেষে, দেশ জয় করার ব্রত নিয়ে, হাতে মুঠো করা কান্তা সেন্টের ছোট্ট শিশি। ছোটবোনের জন্য। কোত্থেকে খুঁজে নিয়ে আসল কে জানে? স্বাধীন দেশের সুঘ্রাণ মাখামাখি ভরপুর কান্তা সেন্টে। 

আর ছোটবোন যখন আশপাশ থেকে খবর পেত, যুদ্ধের দিনে মিষ্টিকুমড়া আর ভাত খেয়ে দিন কাটায় তার মুক্তিযোদ্ধা ভাই, সেই ৯ মাস মুখে তোলেনি ভাইয়ের পছন্দের কোন খাবার। সে এক যুদ্ধ সময়ের গল্প। হয়তো এমন গল্প দেশ জুড়েই ছিলো। তেমনই এক গল্প ছিলো আমার পরিবারেও।  

এই গল্পের ছোটবোনটি যখন আমার মা হল, তাঁর কাছ থেকে বারবার বহুবার শোনা এমন এক গল্পেই চিনলাম মুক্তিযুদ্ধকে।  চিনলাম খুব নিজের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। চিনলাম সম্পর্ককে। আমার দেখা, চেনা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা। দিলু  মামা।


মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরার পর ছোটবোন জেবুর সাথে (বাঁয়ে)। পরিবারের সাথে দিলু, স্ত্রী রানী রহমান, মেয়ে রিমঝিম, দুই ছেলে অয়ন এবং অতুল

কিছু আলো আছেনা, সবটুকু নিয়ে আলোকিত হয়? কিছু হাসি আছেনা, চারপাশের সবটুকু নিয়ে হাসে? তেমন হাসি আমি প্রথম দেখেছি শিখেছি দিলু মামাকে দেখে। হাসতে হাসতে আসে, হাসতে হাসতে যায়, যতক্ষণ থাকে হাসিয়ে আলোয় ভাসিয়ে দিয়ে যায়। পরিবারের ছোট তিন ভাই বোন তাকে ডাকে ছোট ভাইয়া বলে। বড়রা দিলু। কারো বাবা, কেউ ডাকে মামা, কারো  চাচা। আমার কাছে দিলু মামা।  আর মামার কাছে আমরা? কথা শুরুই হবে এক গাল হাসিতে, "ধুর মিয়া।"

মামা জন্মদিনে লাল নীল বই আর সাথে ক্যাসেট দিত।  লেখা থাকত টোনাটুনি।  বই থেকে গল্প পড়া যায়, ক্যাসেটপ্লেয়ার চালিয়ে সেই গল্প শোনা ও যায়। ক্যাসেটের ভেতর থেকে মামা গল্প বলে।  আমরা গল্প শুনি।  মামা বলে 'পাতা উল্টাও'। আমরাও পাতা উল্টাই।  আমি তো ভাবতাম, মামা বোধহয় শুধু আমার জন্যই এ গল্প পড়ে, আমাদের জন্য।  চারপাশ একটু একটু করে জানতে শুরু করলাম যখন, দেখি টোনাটুনি আসলে সবার। পাতা উল্টানোর গল্প সবার। শৈশবের। বড় হয়ে ওঠার।


মজিবুর রহমান দিলুর বড় ভাই মঞ্চসারথি আতাউর রহমানের বাসায়, ঈদের দিন পরিবারের সবাই

এমন বড় হতে হতে দেখি, মামা তো শুধু আমাদের নয়। মামা আরো অনেক গল্পের। অনেক চরিত্রের। মামা আমি গাধা বলছির গাধা। মামা নীলপানিয়ার  ইমাম, মহাপ্রস্থানের পুরোহিত। মামা সংশপ্তকের মালু। মামাকে পর্দার ওপারে দেখতে দেখতে মনে হত, কে সত্যি? আমাদের দিলু মামা, নাকি মালু? জীবনকে হাসতে শেখানো, নাকি পর্দার গভীর চরিত্রে ডুব দেয়া কোনটা সত্যি? 

আমি কখনো এ প্রশ্ন করিনি তাঁকে। কেন করিনি এখন ভাবছি। কারণ তাঁকে দেখলে আমরা শৈশবে মেতে উঠতাম, তখনো, এখনো। একবার আমাদের মামাত ভাই অয়নকে, অন্য ভাই বোনরা সবাই মিলে একটা মজার নাম দিলাম। ক্ষেপাতাম। তো শুধু  আমরা ক্ষেপিয়ে শান্ত নেই। মামাকে বললাম, "মামা তোমার বড় ছেলের তো একটা নাম দিয়েছি আমরা।" মামা বললো, "অবশ্যই, ভাল হয়েছে।" ব্যাস, মামা জুড়ে গেল আমাদের সাথে। আমরা সবাই মিলে অয়নকে ক্ষেপাই, সাথে আছে মামা। এমন মধুর পাগলামিতে, আমরাও হাসি, অয়নও। সবাই মিলে শৈশব উৎসব পার করে দিতে দিতে, কত পাল্টা উল্টে ফেলি, পাল্টে ফেলি।  

এমন উল্টে পাল্টে যেতে যেতে, বড় হয়ে যাই আমরা। মামা কিন্তু বুড়ো হয়না। মনেতে কিংবা হাসিতে, একটু ও। অয়নের বিয়ে হয়। মামা  শ্বশুর হয়। আমাদের আমুদে নাটুকে মামা, একদিন অয়নের নতুন বউয়ের সামনে ফিসফিস করবার ভঙ্গিতে জোরে জোরে আমাদের বলে, "শোন  অয়নকে ওই যে একটা নামে ডাকতিস, কিছুদিন ওই নামে ডাকিস না বুঝলি। মাত্র বিয়ে হয়েছে। বউ কি ভাববে। "ব্যাস মামার যে উদেশ্য ছিল, তা সফল। নতুন বউ সে কথা শুনতে পায়। তাতে কি? সেও আমাদের হাসিখুশি দলে যোগ দেয়। আমরা সবাই মিলে মামাকে সাথে নিয়ে অয়নকে সে নাম ডাকি। এক নির্মল আনন্দে সবাই মিলে অকারণে হেসে লুটোপুটি।  

আরো একটি হাস্যোচ্ছল পারিবারিক ছবি

হাস্যরস, কৌতুক যে কি নিঁখুত এক শিল্প, আমি মামাকে দেখে জেনেছি। ছোটবেলার সেইদিনের কথা বারবার মনে পড়ে। কুরবানী ঈদের পরদিন। আমাদের ধানমন্ডির বাসায় রাতে মামা পুরো পরিবার নিয়ে এসেছে। মামা, মামী, রিমঝিম, অয়ন আর অতুল। আর আমরা বাসার মানুষেরা। রাতের খাওয়া দাওয়া  সেরে, সবাই টিভি দেখছি। বিটিভিতে ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠান। শীতকাল।  হঠাৎ হুসহুস আওয়াজ। প্রথমে শুনলে মনে হয়, বৃষ্টি বোধহয়। বারান্দায় যেয়ে দেখি, কলোনির গ্যাস লাইন ফেটে গ্যাসে ভরে যাচ্ছে আশপাশ। ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিল। আমরা বাসার সবাই হুড়পাড় করে বেরিয়ে আসি। মামার গাড়ি বাইরে রাখা। সে গাড়িতে মামার পরিবারের ৫ জন, আর আমরা ৫ জন চেপে বেশি। কেমন করে বসি, সেই  বিস্ময় আজ ও। তবে বেশ মনে আছে, ৫ জনের বসবার গাড়িতে ১০জন জড়াজড়ি আটকে। এক পাশের দরজা খোলা রেখেই গাড়ি টানল মামা। আর মুখে বলল, "ধুর মিয়া।" সেদিনের সেই দুর্ঘটনা কাটিয়ে উঠবার পর, শুরু হল গল্প। মামার সাথে যতবার দেখা হয়, ঠিক ঠিক অভিনয় করে দেখায় সেদিন রাতে আমাদের সবার চলন বলন। হাসিতে সবাই লুটিয়ে পরি। সেই গল্প সেদিন থেকে চলছিল আজ ও। প্রত্যেকবার যখনই  মামার সাথে দেখা হয়েছে।  ভাবি, অমন গভীর সংকটের রাতে, কখন এতো মনযোগ দিয়ে সবাইকে দেখল মামা? কেমন করে এতো কঠিনকে সহজ করে দিল, হাসিতে?

কঠিন কে সহজ করতেই এসেছিল হয়ত। ২০০৫।  গুলেন বাড়ি সিনড্রোমে আংক্রান্ত হয়ে, ক্লান্ত হল। ফাটল জমল। ভাঙলোনা। জেগে উঠলো, উঠে দাঁড়াল, ফিরে তাকাল, এক হাতে লাঠি নিয়ে টুকটুক। হাসি ম্লান হয়নি, ক্ষয় হয়নি জীবনকে দেখবার আলোর। মামাকে একবার বলেছিলাম, "তুমি কি শুনতে পেতে আমাদের, বুঝতে আমরা চারপাশে, যখন অচেতন ছিলে?" "সব জানতাম, সব দেখতাম।" মামা হাসে। 

সেইবার ফিরে এসেছিল জীবনে, আরেকবার। মামা। একবারও ভাঙেনি। ক্লান্ত হয়েছে, থেমে যায়নি। 

মামা মজিবুর রহমান দিলুর সাথে কিযী তাহনিন (বাঁয়ে)। আরো একটি পারিবারিক ছবি (ডানে)

আমার নাটুকে মামা। আর এবার, জীবনভূমি ছেড়ে একেবারে চলে যাওয়ার দুইদিন আগে বলল, "আর দুই দিন।" চলে গেল। ঠিক দুদিন পরেই। ১৯ জানুয়ারি ২০২১। ঠিক যেন ১৯৮৫ সাল ফিরে এসেছিল পুরো পরিবারে আরেকবার। একইদিনে সে বছর চলে গিয়েছিল, এ পরিবারের প্রিয়জন। আমাদের নানাভাই।  তাঁর বাবা। অনেকবছর পরে, একইদিনে চলে গেল, বাবার কাছে, মায়ের কাছে। শূন্যজীবন পূর্ণ করে, কানায় কানায়, আনন্দমন্ত্রে। যুদ্ধে যুদ্ধে জীবন, রোগের বিরুদ্ধে, এ জীবনের ক্ষয়ের বিরুদ্ধ। যুদ্ধ শেষে, ঝিকমিক হাসিতে, শেষটুকুতে রয়ে গেল হাসিমুখে আমাদের দিলু মামা। আমার চেনা প্রথম মুক্তিযোদ্ধা।   

সেই পাতা উল্টানোর দিনের মতন, একটার পর একটা, পাতা উল্টে যাচ্ছি আমরা। পুরোনো গল্পের নতুন পাতা। তুমি কি শুনতে পাচ্ছ মামা? 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank