সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪ || ৯ পৌষ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়

হীরেন পণ্ডিত

২৩:৪০, ১৪ আগস্ট ২০২২

৭৫৮০

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়

বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণিত, বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডেরের মধ্যে একটি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। তবে এটি শুধু হত্যাকাণ্ড ছিল না। একটি সদ্য স্বাধীন ও জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও পরাজিত দেশ, বিদেশি শক্তি এবং ঘাতক চক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করেছিল। দিনটি বাঙালির জাতীয় শোক দিবস।প্রতিবছর ১৫ আগস্ট শনিবার জাতি শোকাতুর হৃদয়ে শ্রদ্ধাভরে জনককে স্মরণ করে।

২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনসহ নানা জাতি-গোষ্ঠী দ্বারা হাজার বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে। পর্বতসম সাহস আর সাগরের মতো হৃদয়ের অধিকারী শেখ মুজিব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঙালিকে পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। এজন্যই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে আজও তিনি সবার হৃদয়ে।

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি ও তাদের ভূখÐকে করা হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনস্ত। বাঙালির ওপর চেপে বসে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন আর নিপীড়ন। সেই নির্যাতিত বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। এই আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। বার বার তাঁকে হতে হয়েছে মৃত্যুর মুখোমুখি।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ দিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি অধিষ্ঠিত করে তাদের জাতির পিতার আসনে। বিশ্ববাসীর কাছেও বঙ্গবন্ধু পরিচিত হয়ে উঠেন নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসেবে।

স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘদিনের শোষিত-বঞ্চিত এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই সময়ও তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হন। সব ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী একটি দল হানা দেয়। এ সময় তারা বঙ্গবন্ধুসহ বাড়িতে থাকা পরিবারের সবাইকে একে একে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তারা প্রাণে বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীরা স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধকে পদদলিত করে উল্টো পথে সেই পাকিস্তানি ভাবধারার দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যায়। আবারও বাঙালির ঘাড়ে জেঁকে বসে সামরিক স্বৈরশাসন।
জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, হত্যা এবং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালা বদল হতে থাকে। সেইসঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয় চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীরা।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় তাকে হত্যা করা হয়। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডের আরও শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ দেশবরেণ্য সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তস্বত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুলাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু ও বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষায় এগিয়ে আসা প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ দফায় দফায় বীভৎস সময় অতিক্রম করেছে। যে বিষয়গুলো কেন্দ্র করে এই বীভৎসতার সৃষ্টি এবং ফিরে ফিরে অনেক মানুষ এর নির্মম বলি হয়েছে,  সে সবকিছুরই নিরসন ঘটেছিল একাত্তর-পর্বে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা স্বাধীনতা-উত্তর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় নিপতিত হলাম গাঢ় অন্ধকারে; ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সৃষ্ট নির্মম অধ্যায় শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা কয়েক ব্যক্তিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার বিষয় হিসেবে কোনোভাবেই দেখার অবকাশ নেই। যে জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের স্বপ্ন ছিল দীর্ঘদিনের এবং যার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের পথরেখা রচিত হয়েছিল, এর যবনিকাপাত ঘটল এবং রক্তমূল্যে অর্জিত বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার সব রকম চেষ্টা হয়ে উঠল বেগবান।

বিশ্বের ক'টি দেশে আইন করে মানুষ হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখার দৃষ্টান্ত আছে? বাংলাদেশ সেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে পঁচাত্তর-পরবর্তী অধ্যায়ে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ হীনস্বার্থবাদী কিংবা রাজনীতির নামে অপরাজনীতির কুশীলবদের নখরাঘাতে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। এই ক্ষত উপশমের উপযুক্ত দাওয়াই না মেলায় ক্ষতের ওপর ক্ষত সৃষ্টি হয়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক বীভৎসতা এরই পুরোনো নজির। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টার কোনো মামলারই বিচার সম্পন্ন হয়নি আজও। কোনো অপরাধ কিংবা দুস্কর্মের যদি বিচার না হয়; এসব যদি থেকে যায় প্রতিকারহীন, তাহলে জনজীবনে দুঃখের খতিয়ান বিস্তৃত হওয়াই তো স্বাভাবিক এবং তা হয়েছেও। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি কিংবা বিলম্বিত বিচারের কুফল কী হতে পারে, এর অনেক নজির আমাদের সামনে আছে। এসবই রয়েছে হীনস্বার্থবাদী রাজনীতির মেরুকরণের ছকে।

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তাতে মুক্তিযুদ্ধ পর্বের প্রত্যয়ের প্রতিফলনই ঘটেছিল। কিন্তু সেই সংবিধানের মূল স্তম্ভগুলোতে আঘাত আসতে থাকল একে একে। বদলে গেল রাষ্ট্রের ধর্ম-চরিত্র দুই-ই। সাংবিধানিকভাবেই রাষ্ট্রের চরিত্র হলো সাম্প্রদায়িক। এ অবস্থায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার যে উচ্চারণ আমরা শুনি, এর বাস্তবায়ন কী করে সম্ভব? বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবি দীর্ঘদিনের। এখন সেই সুবর্ণ সুযোগ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও এ নিয়ে কোনোই কথা নেই। এমতাবস্থায় সব অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি কিংবা প্রত্যয় প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে পারে কী করে?

বাংলাদেশের মানুষ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও অনেকেই পছন্দ করেন গরম কথা। আমাদের রাজনীতি ও অনেক রাজনীতিবিদের ব্যর্থতা, দ্বিচারিতা, স্ববিরোধিতা, গøানি এত বেশি যে, এসব ঘাঁটলে দুর্গন্ধ ছড়ানোর আশঙ্কাই বেশি। তবুও মানুষ আশায় বাঁচে। এও সত্য, নদীতে সব সময় ভাটার টান থাকে না, জোয়ারও আসে। তিমির হননের গানও এই সমাজেই শোনা যায়। তার পরও দুঃখের অবসান হয় না। দুঃখের বিচার হয় না; উপরন্তু দুঃখের খতিয়ান বিস্তৃতই হতে থাকে। মোট কথা, রাষ্ট্রব্যবস্থায় এত অসংগতি জিইয়ে রেখে সংগতিপূর্ণ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের চিন্তা কতটা যৌক্তিক- এ প্রশ্ন এড়ানোর অবকাশ খুব ক্ষীণ। 

এই সত্য এড়ানো কঠিন- অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাদের রাজনীতির বহিরঙ্গে যতটা দৃশ্যমান, ব্যক্তির প্রাণে কিংবা সমাজের গভীরে তা ততটা প্রবেশ করেনি। এর মুখ্যত কারণ, মানুষের চেতনার অগ্রগতি ও তা ধরে রাখার জন্য রাজনৈতিকভাবে মনোজগতে প্রভাব ফেলার মতো তেমন গভীর কোনো কাজ হয়নি। আজকের উন্নত ইউরোপ এক সময় গভীর সাম্প্রদায়িক ব্যাধিমগ্ন ছিল। কিন্তু সেখানে নানা ধারার সংস্কার আন্দোলন ও ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তবুদ্ধি চর্চার বহুমুখী প্রয়াস সমাজকে সংস্কারমুক্ত হতে, অচলায়তন ভাঙতে বড় ভূমিকা রেখেছে। বাঙালি সমাজে প্রতিরোধের আন্দোলন হলেও সঠিক অর্থে স্বাধীন দেশে জাগরণের আন্দোলন কতটা হয়েছে, এ নিয়ে তর্ক আছে। আমরা জানি, দায়িত্বশীলতা বলে মানবজীবনে এক অবশ্য অনুষঙ্গ আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- বলবান কিংবা ক্ষমতামদমত্ত, দায়িত্বজ্ঞানহীন কুচক্রী মানুষেরা কতদূর যাবে? বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও ধর্ম সমার্থক হয়ে গেছে। আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টায় প্রথমেই আঙুল তুলি ধর্মাশ্রয়ী, রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে। হ্যাঁ, তা অমূলক নয়। 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটো আলাদা নাম হলেও ইতিহাস কিন্তু একটিই। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক, এক ও অভিন্ন। তিনিই স্বাধীন বাংলাদেশের পথিকৃৎ। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় তিনিই অবিসংবাদিত মহানায়ক, রাজনীতির মহাকবি। তিনি যুক্ত ছিলেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, ভূমিকা রেখেছেন চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট গঠনে, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। তার হাত দিয়ে আসে ছেষট্টির ছয় দফা। গ্রেফতার হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। সেই মামলার জন্য বাঙালি নামে রাজপথে। 

৩০ লাখ শহিদ ও দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। সেই হত্যা কেবল বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নয়, পুরো বাঙালিকে জাতিকে করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাঙালির কলঙ্কিত এক ট্রাজেডির জন্ম দেয় বিপথগামী কিছু বাঙালিই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মানেই বাঙালির ইতিহাসের ট্রাজিক পরিণতি। যে পরিণতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি অনেক বছর পিছিয়ে ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনাই শেষ পর্যন্ত আমাদের পথে ফিরিয়েছে। সময় পরাজিত হলেও বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ হারেনি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার পর সারা বিশ্বে তীব্র শোকের ছায়া নেমে আসে এবং বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বজুড়ে মানুষ হিসেবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বিশ^স্ততা হারায়। বিদেশরা মনে করতো যে বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে, সাহসী বাঙালিরা নিজেদেরকে একটি কাপুরুষ-আত্মঘাতী জাতি হিসেবে এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার আত্মঘাতী চরিত্র বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে স্বাধীনতার চেতনাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিলো। মানুষ মনে করেছে বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাংলাদেশের প্রকৃত অস্তিত্ব নেই। এটা সহজেই বলা যেতে পারে যে, বাঙালি জাতির চেতনার নাম, একটি স্বপ্নের নাম, সৃষ্টির ইতিহাসের নাম, আকাক্সক্ষার নাম, সংগ্রামের নাম এবং সাফল্যের নাম তাহলে তার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ইতিহাসের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন থাকবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পেছনের অপরাধীরা একদিন প্রকাশ পাবে। তিনি ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank