শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক উপন্যাস

বলতে এলাম ভালোবাসি

১৯:৩৯, ১৪ অক্টোবর ২০২০

আপডেট: ১৬:৩৬, ৩১ অক্টোবর ২০২০

২৩৪৯

ধারাবাহিক উপন্যাস

বলতে এলাম ভালোবাসি

বলতে এলাম ভালোবাসি

ধারাবাহিক উপন্যাস


পলাশ মাহবুব


১.
বিয়ের বয়স আসলে কত?
বিয়ের কি আসলে নির্দিষ্ট কোনও বয়স আছে? যে বয়সে আর বিয়ে করা যাবে না।
অনেকদিন ধরে মনে মনে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজছে রাত্রি। কারণ বিভিন্ন সময় তাকে ঘিরে এই প্রশ্নটি ওঠে। 
প্রশ্নকর্তা অধিকাংশ সময় রাত্রির বাবা।
প্রশ্নটা ঠিক এরকম নয় যে, বাবা তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করছে, তুমি কি জানো না বিয়ে করার বয়স কত? কিংবা তুমি বিয়ে করছো না কেন? অথবা তোমার কি বিয়ের প্রতি কোনও আগ্রহ নেই?
আবার বিষয়টা এমনও নয় যে, প্রশ্নটা সরাসরি তাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় রাত্রিকে শুনিয়ে তার মাকে প্রশ্নটা করেন বাবা।
সেই ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার পর থেকে বিষয়টা শুরু হয়েছে। চোখের সামনে পড়া মানেই রাত্রির বাবার মুখে কথা একটাই।
এই রাত্রির মা, এদিকে আসো। 
কি হলো আবার। 
বেশিরভাগ সময় মায়ের জবাব আসে রান্নাঘর থেকে।
আরে শুনে যাও না...
মাকে কিছুটা আড়ালে নিয়ে যান বাবা। এবং যে কারণে আড়ালে নেওয়া তাতে জল ঢেলে খানিকটা উঁচু স্বরেই কথা বলেন তিনি। উদ্দেশ্য আশপাশে যারা আছে মানে রাত্রির কানেও যেন কথাগুলো ঠিকঠাক যায়।

সারাদিন বাড়িতে থাকো। চোখ দিয়ে কিছু দেখো বলে তো মনে হয় না? মাথা নিচু করে সারাদিন রান্না-রান্না আর বাসন মাজলে চলবে? চলবে না।
বাবার প্রশ্নে মা একটু থতমত খান।
কেন, কি হয়েছে আবার?
কি আবার হবে। মেয়ে যে বড় হয়ে গেছে সে খেয়াল তো নাই। আমাকেই সব চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়। আশ্চর্য। শোনো, মেয়েকে বেশি দিন ঘরে রাখা যাবে না। পরের ঘরে যাওয়ার জন্যই মেয়েদের জন্ম। বুঝতে পেরেছো কথাটা কি বল্লাম?
তাই বলে এতো তাড়াহুড়ার কি আছে?
মায়ের কথায় বাবার বিরক্তি বাড়ে। তিনি ভ্রু কোঁচকান।
তোমার বিয়ে হয়েছিলো কত বছর বয়সে?
আমদের যুগ আর এখনকার যুগ কি এক হলো। যুগ বদলে গেছে। তাছাড়া রাত্রির তো পড়াশুনাই শেষ হয়নি এখনো। সবে আইএ পাশ করলো। এখনই বিয়ে দিতে হবে কেন?
নিচু গলায় বলে রাত্রির মা। রাত্রির বাবার কথার জবাব ঠিক না। কথাটা তিনি এমনভাবে বলেন, মনে হবে নিজেকেই নিজে বলছেন।
শুনে রাত্রির বাবা খ্যাক করে ওঠেন। মায়ের যুক্তিকে পাত্তাই দেন না।
আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা, তোমার মেয়ের যুগে তারা পড়ালেখা করে মেলা। আরও পড়াশোনা করতে চায়? ভালো কথা। করবে। বইপত্র তো কেউ ট্রাংকে ভরে তালা মেরে রাখছে না।
এতটুকু জোরের সঙ্গে বলে গলাটাকে এবার খানিকটা নরম করেন রাত্রির বাবা।
শোনো, বাকি পড়াশোনাটা স্বামীর ঘরে গিয়েও করতে পারবে। তাতে তো দোষের কিছু দেখছি না। বেগম রোকেয়াও স্বামীর ঘরে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। তাতে তার কোনও সমস্যা হয় নাই। স্বামীর ঘরে গিয়েই তিনি বেগম রোকেয়া হয়েছেন। ঠিক কিনা?
স্ত্রীর জবাবের অপেক্ষা না করে আবার গলার স্বর উঁচু করেন বাবা।
শোনো, ভালো ছেলের খোঁজে লোক লাগিয়েছি। আশাকরি সন্ধান পেয়ে যাবো। আমাদের অফিসের মোতালেব সাহেব শৌখিন ঘটক। সজ্জন মানুষ। এখন পর্যন্ত বাইশটা বিয়ের ঘটকালি করেছে। সাকসেস হান্ড্রেডে হান্ড্রেড। প্রত্যেকেই সুখে-শান্তিতে আছে। মোতালেব সাহেবকেও বলে রেখেছি। তিনি মাঠে নেমে পড়েছেন। যেকোনও সময় ভালো ছেলে হাতে চলে আসবে। তখনই কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ বলে কবুল। অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে লাইন-ঘাট কিন্তু আমি মানবো না। আমার কথা পরিষ্কার। তোমাকে বললাম। তুমি মেয়েকে জানিয়ে দিও। যুগ যতই বদলে যাক- নো, লাইন-ঘাট।
রাত্রির মা বলতে চেয়েছিলেন, যে যতই বলুক। বিয়ের পরে মেয়েদের আর পড়াশুনা হয় না। তখন সংসারের বোঝা মাথায় চলে আসে। কিন্তু তিনি তা বলেন না। তিনি চুপচাপ রাত্রির বাবার পরিষ্কার কথা শুনে যান।

বেশি কিছু বলতে গেলেই ঝামেলা হবে। অতীতে হয়েছে। 
কথার পিঠে কথা বললে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন রাত্রির বাবা। তখন বিয়ের প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে অপ্রাসঙ্গিক আরও নানান প্রসঙ্গ চলে আসে তার কথায়। সেটা হতে পারে রাত্রির ছোট খালা কেন এবার বেড়াতে এসে তিনদিনের জায়গায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে গেলো। কিংবা এবারের আমের মৌসুমে রাত্রির মামাবাড়ি থেকে যে ঝুড়ি পাঠানো হয়েছিল তার বেশির ভাগ আমই ছিল টক। এবং বাবার ধারণা তা করা হয়েছে ইচ্ছাকৃত।
তাই নির্বাক শ্রোতা হয়ে চুপচাপ শুনে যাওয়াকে একটা সিস্টেমে পরিণত করেছেন রাত্রির মা। এর ফলাফল যেহেতু পারিবারিকভাবে স্বীকৃত তাই রাত্রিও মায়ের পদ্ধতি অনুসরন করে। বাবা যখন তাকে কিছু বলে তখন ভালো শ্রোতা হিসেবে তার কথা শুনে যায় সে। হু-হা করে পাড় করে দেয়। এতে কাজ হয়।
কথা বলতে বলতে এক সময় নিজে থেকেই চুপ হয়ে যান বাবা।
এই আমার গামছা কই? দরকারের সময় হাতের কাছে কিছু পাই না বলে গা ভেজাতে বাথরুমে ঢুকে যান তিনি। কলের ঠান্ডা জলে খানিক শীতল হন। শীতলতা তার মধ্যে এক ধরণের আরামবোধ তৈরি করে। কিছুক্ষনের জন্য তিনি জাগতিক নানা সংকট থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করেন। এরপর পেপার হাতে নেন। পেপার হাতে নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলকে যুগপৎ গালিগালাজ করেন। ক্রিকেট দলের সাফল্যের খবর পড়ে উল্ল­সিত হন। ব্যর্থতার খবর থাকলে তাদের হোয়াইটওয়াশ করেন। তারপর ঘুম তাড়ানোর জন্য কড়া দুধ চা খান। এবং চা খাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে পড়েন।
এভাবে রাত্রির বিয়ের বিষয়টা কিছুদিনের জন্য চাপা পড়ে যায়। 

এর পেছনে হয়তো আরও একটি কারণ থাকতে পারে। 
যাদেরকে ভালো পাত্রের সন্ধানে মাঠে নামানো হয়েছে, মাঠ পর্যায়ে তাদের পারফরমেন্স আশানুরূপ না। ঠিকঠাক ভালো ছেলের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তারা। কিংবা মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে রাত্রির বাবা যতটা সিরিয়াস রাত্রির মা এবং রাত্রি নিজে ঠিক ততটা না। 
শৌখিন ঘটক মোতালেব সাহেবও নিশ্চয়ই উপযুক্ত পাত্র হস্তগত করতে পারেননি যার সঙ্গে রাত্রি সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে ঠিক তার ঘটকালি করা আগের বাইশ দম্পতির মতো। যাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে মোতালেব সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসে এটা সেটা উপহার সহকারে। পায়ে হাত দিয়ে কদমবুচি করে।
এভাবেই মোতালেব সাহেবদের ব্যর্থতা এবং ঠান্ডা পানির কার্যকারিতা বেশ কিছুদিন ধরে অব্যাহত থাকে।
তাই ঘুরে ফিরে রাত্রির বিয়ের কথা উঠলেও তা হালে পানি পায় না।
... পাত্র পাওয়া মাত্রই কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ বলে কবুল। তোমার মেয়েকে সবসময় স্ট্যান্ডবাই থাকতে বলবা। আমার কথা কিন্তু পরিষ্কার। অন্য কোনও ছেলে-ছোকরার সাথে লাইন-ঘাট কিন্তু মানবো না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া মানেই যার-তার সাথে ঝুলে পড়লাম ওসব চলবে না। আমার পরিষ্কার কথা। 
এ জাতীয় একই টাইপের নানান কথার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে রাত্রির বাবা যথারীতি গায়ে পানি ঢালতে বাথরুমে চলে যান।
তিনি শীতল হন। এবং কিছুক্ষনের জন্য জাগতিক সংকট থেকে নিজেকে মুক্ত মনে করেন। সকাল বেলার বাসি পেপার হাতে নিয়ে ঘুম তাড়ানোর চা খান। পত্রিকার খবর পড়ে সরকার এবং বিরোধী দলকে যুগপৎ গাল-মন্দ করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন।

এভাবেই চলছে।
এই ফাঁকে রাত্রি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জসিম উদ্দিন বাংলা কলেজের তৃতীয় বর্ষে উঠে যায়। মধ্যম মানের ছাত্রী হওয়ায় পড়ার বিষয় হিসেবে পায় ‘সরকার ও রাজনীতি’। 
সাবজেক্ট একটি কিন্তু উপাদান দুইটি। এবং এই দুটো বিষয়ই তার বাবার মতো উত্তেজনায় ভরপুর। 
গায়ে পানি পড়লে তার বাবা তাও ঠান্ডা হন। কিন্তু এ দুটো বিষয় ঠান্ডা হওয়ার নয়।
এরা শিখা অনির্বান। সবসময় জ্বলন্ত।

২.
বিষয়টা অবাক হওয়ার মতো। 
‘সরকার ও রাজনীতি’ মার্কা টানটান উত্তেজনার সাবজেক্টের শিক্ষক এরকম হিমশীতল হন কিভাবে!
ঠান্ডারও একটা মাত্রা আছে। এই মানুষ মাত্রা ছাড়া।
বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকরা মাঝে মাঝে মজা করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে।
আতিক সাহেব শিক্ষকতায় না এসে ফ্রিজ বিক্রির ব্যবসা করলে ভালো করতেন। উনিও ঠান্ডা ওনার প্রোডাক্টও ঠান্ডা। ঠান্ডা ঠান্ডা,  কুল কুল। ব্যবসা একদম জমে যেত। হা হা হা।
যার কথা বলা হচ্ছে তিনি আতিকুল হক। রাত্রি যে বিভাগে পড়ে সেই বিভাগের শিক্ষক। পদে সহকারি অধ্যাপক। 
সহকারি অধ্যাপক হয়েছেন এবং ঢাকায় এসেছেন দুটোর কোনটিই বেশিদিন হয়নি। এক বছরের কিছুটা বেশি। এর আগে রাজশাহীর একটি সরকারি কলেজে ছিলেন। সেখানে কয়েক বছর চাকরি করেছেন।
তার মতো একজন মানুষ কিভাবে ঢাকায় পোস্টিং পেল সেটা একটা বিস্ময়। ঢাকায় পোস্টিংয়ের জন্য যেখানে লাখ লাখ টাকার তদবির হয় সেখানে আতিকুল হক পোস্টিংই চাননি। এ নিয়ে তিনি কখনো ভাবেনওনি। 
তারপরও তার ঢাকায় বদলির আদেশ আসে। শীতের এক সকালে আতিকুল হককে ডেকে বদলির খবর জানান কলেজের প্রিন্সিপাল কে আর এম আকরাম।
আকরাম সাহেবকে দেখলে মনে হবে তিনি ভুল করে শিক্ষকতায় চলে এসেছেন। তার আসলে যাওয়ার কথা ছিল সেনাবাহিনীতে। 
খুব রাশভারি স্বভাবের মানুষ। সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকেন। সহজে হাসেন না। কিন্তু যখন হাসেন তখন চারপাশ কাঁপিয়ে হাসেন। তার গোঁফযুগল এম এ জি ওসমানীর কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রায় পাকা গোঁফ নিচে নামতে নামতে বিদ্রোহী হয়ে আবার ওপরের দিকে উঠে গেছে। বিদ্রোহী গোঁফ প্রিন্সিপাল কে আর এম আকরামের ব্যক্তিত্বকে ওজনদার করেছে।

প্রিন্সিপাল আকরাম সাহেব দু আঙুলের মাঝে একটা খাম নিয়ে ওপর-নিচ করছেন। আতিকুল হককে দেখে একবার তাকালেন। ইশারায় তাকে বসতে বললেন।
তারপর সমস্ত মনযোগ আবার নিজের দু আঙুলের মাঝে রেখে খাম ওপর-নিচ করতে লাগলেন।
তুমি ঠান্ডা স্বভাবের সেটা জানতাম। বাট তুমি তো নট ওনলি ঠান্ডা বাট অলসো গভীর জলের মাছ। অবশ্য গভীর জলে থাকলে তো ঠান্ডা না হয়ে উপায় নেই। সেখানে তো আর সূর্যের আরো পৌঁছায় না। যৎ দেশে যদাচার। হা হা হা।
প্রিন্সিপাল কে আর এম আকরাম ঘর কাঁপিয়ে হাসেন।
কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যারের কথার মানেটা ধরতে পারে না আতিকুল হক। সে খামের ওঠা-নামার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তুমি যে ভেতরে ভেতরে পোস্টিং পাওয়ার চেষ্টা করছো তাতো কখনো বলোনি। একেবারে ঘটনা ঘটার পরে জানলাম। এনি ওয়ে, কংগ্রেচুলেশান।
ওঠানো-নামানো বন্ধ করে চিঠিটা আতিকুল হকের দিকে এগিয়ে দেন তিনি।
খানিকটা বিস্মিত হয়ে খামটা নেয় সে। 
বদলির আদেশ তার জন্য অপ্রত্যাশিত। বদলির জন্য তদবির তো দূরের কথা এ বিষয়ে সে নিজে কখনো ভাবেওনি। 
তাছাড়া রাজশাহীতে সে ভালোই আছে। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোনোর কিছুদিনের মধ্যেই বিসিএসে হয়ে যায় তার। সেখান থেকে সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে রাজশাহীতে আসে। 
রাজশাহী তার নিজের শহর। বাড়ি থেকে কলেজ একটু দূরে হলেও সে বাড়িতেই থাকতো। সকাল সকাল গরম ভাত খেয়ে কলেজের দিকে রওয়ানা দিতো। গরম ভাতে যে এত মজা ইউনিভার্সিটির হলে থাকতে থাকতে সে ভুলেই গিয়েছিলো। গরম ভাত আসলে এক ধরনের নেশা। যারা গরম ভাত খেয়ে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে তারা ঠান্ডা ভাত খেতে পারে না।

শোনো আতিক, ক্যারিয়ারে সবাই উন্নতি চায়। বড় শহরে যাবে বড় বড় অপোরচুনিটি আসবে সামনে এটাই স্বাভাবিক। তবে সবাইকে টপকে তুমি কিভাবে পোস্টিংটা বাগিয়ে নিলে এটা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। ইউ আর এ কোল্ড ডিপ ফিস। তুমি অতি গভীর জলের চিল ফিস। হা হা হা।
আগের কথা এবং হাসির পুনরাবৃত্তি করেন প্রিন্সিপাল স্যার। তারপর ইশারায় টেবিলে রাখা ধোঁয়া ওড়া চা খেতে বলেন আতিককে।
নাও, চা খাও।
নাকি গভীর জলের মাছরা চা খায় না। হা হা হা।
চায়ের কাপটা এগিয়ে নিয়ে খামটা খোলে আতিকুল হক।
তার বদলির আদেশ।

ঢাকা যাওয়ার তদবিরে আতিকুল হক যে কলেজের শিক্ষক সে কলেজেরই দুজন হেভিওয়েট ক্যান্ডিডেট ছিলেন। খুব ওপর থেকে তদবির হয়েছে তাদের জন্য।
একজনের তদবির করেছেন লোকাল এমপি কাম ভূমি ও জলাশয় উপমন্ত্রী। 
জায়গামতো ফোন দিয়ে তিনি বলেছেন, যার জন্য তদবির করা হচ্ছে সে তার নিকটাত্মীয়। কোন দিকের আত্মীয় সেটা খোলাসা করে না বললেও মন্ত্রীর কথায় আন্তরিকতার ছাপ ছিলো। তিনি আত্মীয়তার দরদ আর ক্ষমতার জোর দুটো মিশিয়ে টেলিফোনে বলেছেন, আমার আত্মীয়র বিষয়টা দেখবেন। আত্মীয় বলে বলছি না। যোগ্য লোককে যোগ্য স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটু ধাক্কা দেয়াই তো আমাদের কাজ।

দ্বিতীয় জনের তদবিরকারী পজিশনে ছোট হলেও দাপটের দিক দিয়ে কম না। তিনিও লোকাল এমপি। সংরক্ষিত নারী আসনের। নির্বাচিত এমপিরা এক আসনের এমপি। সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিদের ভাগে আছে দশটি করে আসন।
দাপটের কারণ অবশ্য এটা না। মহিলা এমপি’র স্বামী বড় নেতা। দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ায় নির্বাচন করতে পারেননি। সেই ক্ষতি সমন্বয় করতে স্ত্রীকে এমপি বানানো হয়েছে। স্ত্রী চলেন স্বামীর কথায়। দাপট সেখান থেকেই আসে।
ভূমি ও জলাশয় উপমন্ত্রী আর মহিলা এমপির একই নির্বাচনী আসন। মহিলা এমপির স্বামী দুর্নীতির মামলার কারণে নির্বাচন করতে না পারায় বর্তমান জলাশয় মন্ত্রী নমিনেশন পেয়েছেন। তাদের বিরোধ বহু  আগের। সেই নির্বাচনকালীন সময় থেকে। 
বর্তমান জলায়শ মন্ত্রী একসময় নারী এমপি’র স্বামীর অনুচর ছিল। মাঝখান থেকে সে নমিনেশন বাগিয়ে নিয়ে মন্ত্রী হয়ে গেছে। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস অনেকে খায়। এই লোক হাওর ডিঙিয়ে মাছ চাষ করেছে। 
বিরোধ জিইয়ে রাখতে নতুন এমপিকে জলাশয় মন্ত্রী করেছে দলের হাইকমান্ড। আবার পুরান নেতাকেও অখুশি করেনি। স্ত্রীর মাধ্যমে তাকেও পুষিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের দ্বন্দও পুষে রাখা হয়েছে। এতে দলের লাভ। কারও একচ্ছত্র আধিপত্য থাকে না। কেউ দল থেকে চলে গেলেও কোনও ক্ষতি নেই। আরেকজন তো আছে। আরেকজন একা হয়ে গেলে তার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার জন্য নতুন আরেকজন তৈরি করা হবে।

ভূমি ও জলাশয় উপমন্ত্রীর তদবিরের খবর যখন অন্য পক্ষের কানে যায় তখন তারাও একজনের জন্য তদবির শুরু করেন।
ফোনে না। নারী এমপির পক্ষে তার স্বামী জায়গা মতো চলে যান। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন ভূমি ও জলায়শ মন্ত্রীর চেয়ে এ বিষয়ে তার স্ত্রীর তদবিরের অধিকার বেশি। কারণ নালা-নর্দমার সাথে শিক্ষার কোনও সম্পর্ক নেই। শিক্ষার সাথে সম্পর্ক শিক্ষিত মানুষের। তার স্ত্রী সংস্কৃতি বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সম্মানিত সদস্য। শিক্ষা আর সংস্কৃতি খুব ক্লোজলি রিলেটেড। বদলির তদবির করার রাইট যদি কারও থাকে সেটা আছে তার স্ত্রীর।

পোস্ট একটি। বিপরীতে জোরালো তদবির দুটি। এছাড়া আগে যারা ক্ষমতায় ছিল, এখন বিরোধী, তাদেরও তলে তলে তদবির আছে। ক্ষমতা তো আজ আছে কাল নেই। সুতরাং বিরোধীদেরও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

যারা বদলি করবেন তারা পড়েন বিপদে। তারা দুই ক্ষমতাবানকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একজনের নাম সিলেক্ট করতে অনুরোধ করেন।
এতে ফল হয় উল্টো। আমার লোকের যদি বদলি না হয় তাহলে ওর লোকেরও হতে পারবে না। দু’পক্ষ থেকেই পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়। এবং তারা নিজের তদবিরের কথা ভুলে গিয়ে প্রতিপক্ষের লোকের যাতে বদলি না হয় সেটা ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এক্ষেত্রে তারা সফল হন।
অদল-বদল করা যাদের দায়িত্ব তারা ঝামেলায় যান না। যতজনের নামে তদবির হয়েছে সব ফাইল একপাশে সরিয়ে রেখে তদবিরহীন একটি নাম বেছে নেন তারা।
উঠে আসে আতিকুল হকের নাম।

[উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক]

চলবে...
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank